Alapon

সাদেক হোসেন খোকা : এক জনপ্রিয় নেতার প্রস্থান



সাদেক হোসেন খোকা বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিংবদন্তি গেরিলা যোদ্ধা। গণমানুষের নেতা। নগরপিতা। একাধিকবারের মন্ত্রী। সকল মহলেই অসম্ভব জনপ্রিয় এক মানুষ। পোড়খাওয়া রাজনীতিক। ক্রীড়া সংগঠক।

দোষগুণ মিলিয়েই অন্যরকম এক মানুষ। তবে সব ছাপিয়ে বেশকিছু ব্যতিক্রমী গুণের জন্য এই মানুষটি দেশবাসীর মানসপটে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনেক কাল। আপাদমস্তক রাজনীতিক বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বিজয় এনে দিয়ে তিনি দেশপ্রেম ভুলে যাননি। বিজয় অর্জনের পর থেকে বেঁচে থাকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশমাতৃকার জন্য আকুল ছিলেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে জনদরদি এই মানুষটিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে। এক জটিল কর্কট রোগ মানুষটিকে কেড়ে নিয়েছে জীবন সায়াহ্নের কিছুকাল আগেই। কিন্তু কি এমন ব্যতিক্রমী গুণ খোকাকে তৃণমূলে অসম্ভব জনপ্রিয় করেছিল?

কর্মীবান্ধব খোকার মাঠে ময়দানের ঘটনাবহুল অনেককিছুই ছিল অবাক করার মতো। তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় চট্টগ্রামের প্রয়াত নগরপিতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর। অনেকটা একইরকম গুনের অধিকারী ছিলেন খোকাও। যখন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন নি সেইসময় থেকেই তিনি ছুটে যেতেন এলাকার মানুষের নানা সমস্যায়। এমনকি মন্ত্রী ও নগরপিতা হওয়ার পরও দেখেছি এলাকার মানুষের পারিবারিক সবরকম শালিশি বৈঠক বাসায় বসে তিনি নিজেই সমাধান করে দিচ্ছেন। এলাকার কোন মানুষের অনুষ্ঠানাদির দাওয়াত এলে বড় রকমের সমস্যায় না পড়লে কখনও মিস করতেন না। এক ফাঁকে না এক ফাঁকে খোকা ভাই ঠিক হাজির হয়ে যেতেন। জুম্মার নামাজে তিনি একেকদিন একেক মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। নামাজ শেষে সকলের সঙ্গে কুশলাদি ও সৌজন্যতা বিনিময় ছিল খোকা ভাইয়ের নৈমিত্তিক ঘটনা। এলাকাবাসীও অপেক্ষায় থাকত খোকা ভাইয়ের এই চমকটির জন্য। যতদিন দেশে ছিলেন এটাই ছিল খোকা ভাইয়ের রুটিন।

তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৯১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। নির্বাচনী সব হিসাবনিকাশ ভুল প্রমাণ করেছিলেন সেদিন। সেবার নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্ধী ছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন পনেরো দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা। সূত্রাপুর- কোতোয়ালী মিলে ছিল এই সংসদীয় আসন। একদিকে এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্য ও অন্যদিকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে পাল্লা ভারি ছিল শেখ হাসিনারই। কিন্তু ফল প্রকাশের পর সব উলটপালট হয়ে গেল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা।

একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি সমালোচনার উর্ধে এমনটি হয়তো নয়। ওয়ান ইলেভেনে পট পরিবর্তন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার প্রথমার্ধে নগরপিতার আসনে থেকে মিশ্র আলোচনারও জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তখন বলাবলি ছিল, তিনি কি সমঝোতা করে টিকে ছিলেন? যদিও পরে দেখা গেছে, তিনিও মামলা থেকে রেহাই পাননি। বিএনপির জোটবব্ধ রাজনীতিতে জামায়াতের সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনায় খোকা ভাই ছিলেন বরাবরই মুক্তিযুদ্ধপন্থি গ্রুপে। প্রতিপক্ষ অনেক সময়ই তাকে কোনঠাসা করতে চেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যুৎবব্ধ হয়ে রাজনীতি করার জন্য। কিন্তু তিনি বরাবরই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শক্তির অধিকার নিশ্চিতে লড়াইয়ে অগ্রণীদের একজন। তার প্রমাণও রেখেছেন দৃঢ়ভাবে।

যখন নগরপিতা ছিলেন ঢাকার অনেক রাজপথের নাম বদলে দিয়েছিলেন। লাল সবুজের অক্ষরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করেছিলেন। নিজ দলীয় চাপ থাকা সত্বেও দলমতের উর্ধে ওঠে তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সড়কের নামকরণ করেছিলেন। ঢাকার রাজপথে আজও জ্বলজ্বল করছে খোকার রেখে যাওয়া সেইসব সাক্ষ্য। মুক্তিযোদ্ধা সি আর দত্ত সড়ক, রাশেদ খান মেনন সড়ক, মেজবাহ উদ্দিন সাবু সড়ক। খোকার সেই কর্মের প্রমাণ বয়ে চলেছে। বোধকরি এটি বাংলাদেশের ইতিহাসেই ব্যতিক্রম ঘটনা।

পঠিত : ১৪০৮ বার

মন্তব্য: ০