Alapon

নবীর ভালোবাসার কাছে হার মেনেছিল সব...


মক্কার এক হ্যান্ডসাম যুবক, আরবের সবথেকে দামি আর স্টাইলিশ ড্রেস পড়তেন। সব থেকে সেরা আতর ব্যবহার করতেন। বড়লোকের সন্তান। সে সময়কার সবচেয়ে স্টাইলিশ জুতা থাকতো তাঁর পায়ে। তখনকার যুগে ইয়ামেনী জুতা ছিল সারা বিশ্বে বিখ্যাত। আর যুবকের পায়ে থাকত ইয়ামেনী জুতার মধ্যেও সবচেয়ে দামী জোড়াটি। যুবকের নাম মুসআব ইবন উমাইর (রাঃ)। উষর আরবকে কেউ জাগাতে পারেনি, রোমক-পার্সী কেউ না। সপ্তম শতাব্দীর সেই সময়টা ছিল ইতিহাসের অন্ধকারময় সময়। এমন সময়ে আরবভূমি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের ছোঁয়ায় জেগে উঠল। এর প্রভাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারলেন না মুসআব ইবন উমাইর (রাঃ)।

মক্কায় মুহম্মদ (সাঃ) নামের একজন সকল দেব-দেবীর উপাসনা ছেড়ে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করা শুরু করলেন। মুসআব (রাঃ) চিন্তা করলেন বিষয়টা তলিয়ে দেখা দরকার। ইতিমধ্যেই তিনি খবর পেলেন মুহাম্মাদ এবং তাঁর সঙ্গীরা কুরাইশদের অত্যাচার থেকে বেঁচে আলোচনা করার জন্য মক্কার উপকন্ঠে আরকাম নামের একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর বাড়িতে মিলিত হচ্ছেন। এই হলো সেই বিখ্যাত দারুল আরকাম বা আরকামের গৃহ, যেখান থেকে রাসুলুল্লাহ্ (সঃ) গোপনে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং মিলিত হচ্ছিলেন তাঁর সাহাবীদের সাথে। কৌতুহলী মুসআব (রাঃ) তাঁর কৌতুহল মেটাবার জন্য এ বাড়ীটিতে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। মুসআব (রাঃ) এমন এক বরকতময় সন্ধায় সেখানে উপস্থিত হলেন যে, তিনি দারুল আরকামে উপস্থিত হতে না হতেই রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর উপর নতুন ওহী নাযিল হলো। তিনি দেখলেন, আল্লাহ্’র রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) সেই ওহীখানা তিলাওয়াত করে উপস্থিত সকলকে শুনালেন। উপস্থিত সকল শ্রোতার অন্তরে যেন সেই ওহীর মর্মবাণী তৎক্ষণাত পৌঁছে গেল। তিলাওয়াতকৃত কুরআনের বানীর সুতীব্র আকর্ষণ মুসআব (রাঃ) এর দেহমনপ্রাণ কে ভীষণভাবে আন্দোলিত করলো। ইতিমধ্যে মুসআব (রাঃ) রাসুলুল্লাহ্ (সঃ) এর সামনে এসে পড়েছেন। তিনি মুসআব (রাঃ) কে স্বাগত জানালেন এবং তাঁর একটি বরকতময় পবিত্র হাত মুসআব (রাঃ) এর বুকের ওপর রাখলেন। মুসআব (রাঃ) যেন দারুন এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়লেন। মুসআব (রাঃ) এর অন্তর ভীষণ উত্তেজনায় আপ্লুত হল। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন তার পরবর্তী জীবনের প্রাণ-প্রিয় নেতার কাছ থেকে।

সেই মহান নেতা, যাঁর মুখের নির্দেশে শিষ্যরা সাগরে ঝাঁপ দিতেও দ্বিধা করত না। তাঁর নির্দেশের মোকাবিলায় সবকিছুই তুচ্ছ। প্রাণপ্রিয় মাকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করলেন মুসআব (রাঃ)। তার মা চেষ্টা করলেন ছেলেকে কড়া পাহারায় বন্দী করে রাখতে।কিন্তু যার হৃদয় রাসূল(সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ তাকে কে বন্দী করবে? বন্দীদশা থেকে পালালেন তিনি। প্রাণপ্রিয় মাকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করলেন মুসআব (রাঃ)। গন্তব্য এবার আফ্রিকার দিকে। জীবনের এক নতুন অধ্যায় তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আবিসিনিয়ায়। সে অধ্যায় সংগ্রামের, সে অধ্যায় চরমতম দারিদ্রের যা তাঁর উজ্জ্বল ত্বককে বিবর্ণ করে দিয়েছিল। স্টাইলিশ ড্রেস পড়ুয়া মুসাআব খুশি মনে পরিধান করলেন বস্তার মত পোশাক!!

আবিসিনিয়া থেকে মুসআব (রাঃ) আবার একদিন মক্কায় ফিরে এলেন। তিনি মক্কার পথে হেঁটে চলেছেন আর লোকজন কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে নতুন মুসআব (রাঃ) কে দেখছে। এতে তিনি নিজেও কিছুটা পুলকিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, লোকজন দেখুক যে মুসআব (রাঃ) একসময় জাহিলয়্যাতের চরম ভোগ-বিলাসে জীবন কাটিয়েছে সে মুসআব (রাঃ) এ নয়, এতো দ্বীন-ইসলামের এক নগণ্য খাদেম যার অনুসরণীয় একমাত্র আদর্শ হলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আর চাওয়া হচ্ছে বিশ্বজাহানের একমাত্র রব্ব, মহান আল্লাহ্ সুবহানাল্লাহু তা’লার সন্তুষ্টি।

তার মা খুনাইসও খবর পেলেন ছেলে ফিরে এসেছে। দীর্ঘদিন পর মা আর ছেলের দেখা হলো। দু’জনেই আবেগাপ্লুত ছিলেন। খুনাইস আশা করেছিলেন ছেলে মুহাম্মাদের (সাঃ) প্রচার করা অদ্ভুত বিশ্বাস ত্যাগ করে ফিরে এসেছে, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি বুঝলেন তাঁর এই ধারণা ভুল। ক্রোধে তিনি ফেটে পড়লেন। মুসআব (রাঃ) কে নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য তিনি শেষ চেষ্টা করবেন বলে স্থির করলেন এবং এটা কোন সহজ কায়দায় ছিল না, তিনি ছেলেকে আবার বন্দী করে বেঁধে ফেলার জন্য ভৃত্যদের ডেকে আদেশ করলেন। মুসআব (রাঃ) মায়ের সকল অত্যাচার কোন প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিয়েছিলেন সবসময়। কিন্তু এবার তিনি মাকে শপথ করে বললেন, কেউ যদি তাকে বন্দী করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের সবাইকে তিনি হত্যা করবেন। খুনাইস জানতেন তাঁর ছেলে কখনও অনর্থক কথা বলে না। তার উপর তার ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তাও তাঁকে অবাক করেছিল।

মা আর সন্তানের বিচ্ছেদ ধীরে ধীরে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল যদিও দু’জন দু’জনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। মা-পুত্র দু’জনই এহেন পরিণতি মেনে নিতে পারছিলেন না, কিন্তু এর মাধ্যমে ঈমানের উপর মুসআব (রাঃ) এর এবং কুফরের উপর খুনাইসের অটল দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। খুনাইস মুসআব (রাঃ) এর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মুসআব (রাঃ) পরিবারের বিশাল ঐশ্বর্য আর বিত্তের উত্তরাধিকারী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। দু’জনের শেষ কথোপকথনে খুনাইস বললেন, “যে পথে তুমি পা বাড়িয়েছ, তুমি সে পথেই চলে যাও। তবে জেনে রাখো, আজ থেকে আমি আর তোমার মা নই।”

এতো কর্কশ কথা শুনেও মুসআব (রাঃ) ঘাবড়ে গেলেন না, রেগেও গেলেন না। বরং শান্ত কণ্ঠে বললেন, “মা, আপনাকে আমি জানি আর আমি ভালোবাসি আপনাকে। আমি আপনাকে ‘আশহাদু আল্-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু-নেই কোন ইলাহ্-দাসত্ব, আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্’র বান্দাহ্ ও রাসূল’-এ সাক্ষ্য দেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।”

“আকাশের ছুটন্ত তারকার শপথ, আমার অন্তর, চিন্তাশক্তি যদি লোপও পেয়ে যায় তবুও আমি তোমার এ দ্বীন গ্রহণ করবো না।” তার মা জবাব দিলেন।

মুসআব (রাঃ) আবার ঘর ছাড়লেন। পেছনে ফেলে এলেন বিপুল ঐশ্বর্য আর বিলাসিতার জীবন। আরব্য অঞ্চলের যে-ই তাঁর এ অবস্থার কথা শুনত, ভীষণ অবাক হয়ে ভাবত এও কিভাবে সম্ভব!

বাড়ী-ঘর ছাড়া মুসআব (রাঃ) ঘুরে বেড়ান মদীনার পথে পথে। অনাহারে, অর্ধাহারে, অপুষ্টিতে তার গায়ের চামড়া এমনভাবে উঠে গিয়েছিল যেমন সাপ তার খোলস পরিবর্তন করে।

একদিন মুসআব (রাঃ) রাসুলুল্লাহ্ (সঃ) এর কাছে এলেন যেখানে রাসুলুল্লাহ্ (সঃ) কে ঘিরে মুসলিমদের একটি দল বসে ছিল। দূর থেকে মুসআব (রাঃ) কে আসতে দেখে উপস্থিত লোকদের দৃষ্টি নত হয়ে গেল। দলের অনেকেই কেঁদে ফেললেন। কারণ মুসআব (রাঃ) এর পরণে ছিল একটি তালি দেয়া জীর্ণ জুব্বা।

ইসলাম পূর্ব মুসআব (রাঃ) এর ছবি তাদের হৃদয় পটে ভেসে উঠলো। এই কি সেই মুসআব (রাঃ)! একদিন যার গায়ে থাকত আরবের সবচেয়ে দামী পোষাক, আরবের বিলাসিতা আর সৌন্দর্যের মডেল ছিল সে। সে ছিল বাগানের উৎকৃষ্ট কোমল, চিত্তাকর্ষক ও সুগন্ধীময় ফুলের ন্যায়। রাসুলুল্লাহ (সঃ) মুসআব (রাঃ) এর দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হলেন। তার দিকে চেয়ে স্মিত হেসে উপস্থিত সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এ মুসআব (রাঃ) কে আমি মক্কায় তার বাবা-মার সাথে দেখেছি। তাঁরা ওকে খুব যত্ন করতেন এবং তাঁর সাচ্ছন্দের জন্য সবকিছুই করেছেন। কুরাইশদের মধ্যে কোন যুবকই তাঁর মত ছিল না। এরপর এ সমস্ত কিছু সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করে এসেছে এবং নিজেকে সে রাসূলের কাজে নিবেদিত করেছে।”

বদর যুদ্ধে বন্দীদের মধ্যে একজন বন্দীর নাম ছিল আবু আজিজ ইবনে উমাইর। এ আবু আজিজ ছিল মুসআব (রাঃ) ইবনে উমাইর এর ভাই। যুদ্ধবন্দী থাকাকালীন সময়কার কথা আবু আজিজ পরে বর্ণনা করেন – “বন্দী থাকা অবস্থায় আমি একদল আনসারের দায়িত্বে ছিলাম। তারা যখনই খেতে বসছিল তখনই আমাকেও রুটি এবং খেজুর খেতে দিচ্ছিল, এ ছিল রাসূলের নির্দেশ পালন, যে নির্দেশে তিনি তাদেরকে আমাদের সাথে ভাল আচরণ করতে বলেছিলেন। আমার ভাই মুসআব (রাঃ) একসময় আমার পাশ দিয়ে গেলেন এবং আনসারদের যে ব্যক্তিটি আমার বন্দীত্বের দায়িত্বে ছিল তাকে বললেন, “একে শক্ত করে বাঁধ, এর মা হলেন একজন অত্যন্ত সম্পদশালী মহিলা এবং তিনি এর বিনিময়ে প্রচুর মুক্তিপণ দিতে সক্ষম।”

আবু আজিজ যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে মুসআব (রাঃ) এর দিকে ফিরে তিনি বললেন, “আপনি আমার ভাই, আমার ব্যাপারে এই কি আপনার নির্দেশনা?!” “তিনি হলেন আমার ভাই, তুমি নও”, সাথের আনসার সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন মুসআব (রাঃ)।

এতো ইস্পাত দৃঢ়তা থাকার পরেও মুসআব (রাঃ) কি ভাবতে পেরেছিলেন অন্তিম মুহূর্তে এমন ব্যাথা সইতে হবে তাঁকে? উহুদের প্রান্তর। খুনী মরুভূমির সূর্য যেন আগুন ঢালছে। চারদিকে তরবারীর ঝঙ্কার। কিছু সঙ্গীর ভুলে প্রাণপ্রিয় নেতার জীবন শঙ্কার মুখে। কী করবেন মুসআব (রাঃ)? হ্যাঁ এটাই একমাত্র পথ। তাঁর চেহারা যে অনেকটা তাঁর নেতার মত। নেকড়ের মত চিত্‍কার করতে শুরু করলেন মক্কার ধনীর দুলাল সেই সুদর্শন যুবক। যাতে শত্রুরা তাঁকে তাঁর নেতা ভেবে ভুল করে। সব আঘাত তিনি সহ্য করতে পারেন, মাকে ত্যাগ করে আফ্রিকায় পাড়ি জমাতে পারেন, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু নেতার দেহে একটি আঘাত তাঁর সহ্যের বাইরে। তাঁর চীৎকারে মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহীর দিকে মুশরিকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল এবং তারা প্রথমে এ পতাকাকে ভূলন্ঠিত করে পরবর্তি লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিল। একজন মুশরিক সেনা তার ওপর আক্রমণ করলো। একহাতে মুসলিম বাহিনীর পতাকা আর অন্যহাতে তরবারী নিয়ে তিনি প্রচন্ড বেগে লড়াই করতে থাকেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে এক অশ্বারোহী মুশরিক সেনা তরবারীর আঘাতে মুসআব (রাঃ) এর ডান হাত তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তিনি তৎক্ষনাত বাম হাতে পতাকা তুলে ধরলেন।

যুদ্ধের প্রান্তরে তলোয়ার ঝনঝনানি ভেদ করে একটা আওয়াজ শোনা গেল – “মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিহত হয়েছে…!!” কী করবেন মুসআব (রাঃ)? তাঁর পথপ্রদর্শক, তাঁর নেতা যে তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তিনি এখন বড় একা। তিনি জানতন না যে ওটা ছিল বিভ্রান্ত শত্রুর ভুল উক্তি। মুসআব (রাঃ) বলে উঠলেন, “ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল-আর মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল! তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।”

যে সকল মুসলিম একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, তারা সবাই যেন জেগে উঠলেন। ইতিমধ্যে আরেক মুশরিক সেনা তাঁর বাঁ হাতটি বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তিনি এবার বাহু দুটির অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা আঁকড়ে ধরে রাখলেন এবং চীৎকার করে বলতে লাগলেন- “মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে” তবুও ইসলামের পতাকাকে ভুলুন্ঠিত হতে দিলেন না। এমতাবস্থায় ইবনে কামিয়া নামের এক নরাধম এসে একটি তীক্ষ্ণ বর্শা দ্বারা তাঁর দেহে আঘাত করলো, বর্শাটি তাঁর দেহটাকে এফোঁর ওফোঁর করে ফেলল। এবার মুসলিম বাহিনীর পতাকা মাটিতে পড়ে গেল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যে কথাটি (‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল – মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে) বলে গেছেন, পরবর্তিতে সে কথা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে আল্লাহ্ কুরআনের একটি আয়াত (সূরা আলে ইমরান, ১৪৪) হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন এবং পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ কথাটি আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে সংরক্ষিত থাকবে।

যুদ্ধ শেষ হল। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধময়দান ঘুরে ঘুরে শহীদ মুসলিমদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এবং তাদের জানাজার আয়োজন করছিলেন। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে তিনি প্রিয় মুসআব (রাঃ) এর কাছে এলেন। মুসয়াবকে (রাঃ) দেখে তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। মুসআব (রাঃ) এর দেহকে ঢেকে দেবার জন্য একখন্ড কাপড় চাওয়া হলেও একমাত্র তার পোশাকটি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না। যে জামাটি তাঁর ছিল সেটি দিয়ে তাঁর পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে পড়ছিল এবং মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে পড়ছিল। অবশেষে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন – “জামাটি দিয়ে ওর মাথা ঢেকে দাও এবং পা ইখজির (এক প্রকার ঘাস) দিয়ে ঢেকে দাও।”

উহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর প্রিয় অনেক মানুষকে হারিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন তাঁর চাচা হামযা, যার দেহকে কাফিররা পৈশাচিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছিল। কিন্তু মুসআব (রাঃ) এর দেহের সামনে এসে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) ভীষন আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন তখনকার কথা যখন তিনি মুসআব (রাঃ) কে প্রথম দেখেছিলেন মক্কায়। তখন সে ছিল মক্কার সবচেয়ে স্টাইলিশ যুবক, তাঁর গায়ে ছিল সময়ের সেরা এবং দামী পোষাক, অথচ আজ তাঁর মৃতদেহটিকে ঢেকে দেবার জন্য একটি পূর্ণ কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কুরআনের সে অনন্যসাধারণ সে আয়াতগুলো পড়লেন মুসআব (রাঃ) এর জন্য- “মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।” (কোরআন, ৩৩:২৩)

রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এরপর এরপর অশ্রুশসিক্ত চোখে যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকে মুসআব (রাঃ) এবং তার অন্য শহীদ সাথীদের লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহর রাসুল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তোমরা হলে শহীদ এবং কিয়ামাতের দিন এ মর্যদা নিয়েই তোমরা উত্থিত হবে।”

সত্যিই, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এ স্বীকৃতি একজন মুমিনের জন্য পৃথিবীর সেরা প্রাপ্তি, যা মুসআব (রাঃ) অর্জন করে আল্লাহর কাছে পৌঁছেছিলেন।

আমাদের কাছে হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হতে পারে অনেক অর্থ – বিত্ত,আভিজাত্য। আমাদের যাদের কাছে দুনিয়ার জীবনই মুখ্য তাদের কাছে ধনী এক যুবকের পরিবারকে ত্যাগ করা, আভিজাত্যকে ত্যাগ করা, বিলাসিতার জীবনকে ত্যাগ করে দারিদ্রতাকে বরণ করা, নেতার মৃত্যুর কথা শুনে যুদ্ধ থেকে না পালিয়ে জীবন বিলিয়ে দেয়া নিছক বোকামী ও হেয়ালীপনা ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু যাদের কাছে আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনটা ছিল বিশাল সাগরে এক ফোঁটা জল, তাদের কাছে এতো কষ্টের বিনিময়েও জান্নাত ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আমাদের কাছে এটা হয়তো এটা নিছক গল্প, কিন্তু এটা তো তাদের গল্প যারা এক ফোঁটা জলের বিনিময়ে রূপকথাকেও হার মানিয়েছিলেন। পরম মমতায় জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আগলে রেখেছিলেন ইসলামের পতাকা।

আমরা যারা পরকালকে উপেক্ষা করে দুনিয়াতে সামান্য কিছু অর্জন করে নিজেকে হিরো ভাবা শুরু করি আল্লাহর শপথ আমরা কখনোই সফলকাম নই, সফলকাম তো তারা যারা আভিজাত্যের পোশাক ছেড়ে দারিদ্র্যের পোশাক পড়েছিলেন।

সফলকাম তো তারা, যারা এক ফোঁটা পানির বিনিময়ে পুরো সমুদ্র কিনে নিয়েছিলেন।

লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

পঠিত : ১৫৪০ বার

মন্তব্য: ০