Alapon

ওয়াজ-মাহফিলে টাকা নেওয়া আর শিক্ষকতা করে বেতন নেওয়া কি এক বিষয়?


ওয়াজ-মাহফিলে টাকা নেওয়া আর শিক্ষকতা করে বেতন নেয়া এক নয়। কারণ, ওয়াজ মাহফিলের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো মানুষকে ইসলামের পথে আনা, কিন্তু শিক্ষকতার মৌলিক উদ্দেশ্য মানুষকে ইসলামের পথে আনা নয়। শিক্ষকতার অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মাঝে একটি উদ্দেশ্য হতে পারে মানুষকে ইসলামের পথে আনা, কিন্তু সে উদ্দেশ্যটি শিক্ষকতার মৌলিক কোনো উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষকতার মৌলিক উদ্দেশ্য হলো দক্ষতা ও যোগ্যতা শেয়ার করা। একজন অমুসলিমও মুসলিমকে শিক্ষা দিতে পারেন, কিন্তু হেদায়েত দিতে পারেন না।

ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ওয়াজ করে টাকা নেয়া ও শিক্ষকতা করে বেতন নেয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

আমরা জানি, বদরের যুদ্ধে অনেক অমুসলিম যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব বড়লোক ছিলেন, এবং কেউ কেউ খুব গরিব ছিলেন। যেমন, মুত্তালিব ইবনে ওয়াদাআ সেই যুগেও চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ দিয়ে তার বাবাকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন।[১] অন্যদিকে, আবু ইযযা সহ বেশ কিছু অমুসলিম এতই গরিব ছিলেন যে মুক্তিপণ দিয়ে কেউ তাদেরকে ছাড়িয়ে নিতে আসেনি।[২] ফলে, রাসূল (স) তাদেরকে এই শর্তে মুক্তি দিলেন যে, তারা ১০জন করে মুসলিম শিশুকে শিক্ষা দান করবে। অর্থাৎ, গরিব অমুসলিমরা যেহেতু টাকা দিতে পারছে না, তাই শিক্ষার বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো। তাই, শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ, অথবা, অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার এই পদ্ধতি রাসূল (স) থেকেই অনুমোদিত ও প্রচলিত ছিলো।

টাকার বিনিময়ে শিক্ষা সম্ভব হলেও, টাকার বিনিময়ে হেদায়েত দেয়া সম্ভব নয়। কারণ, শিক্ষক থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়, এবং এর বিনিময়ে শিক্ষককে টাকা দেয়া যায়। কিন্তু হেদায়েত যেহেতু কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে, তাই হেদায়েতের জন্যে যারা মানুষকে ডাকে, তারা এর জন্যে কোনো টাকা-পয়সা দাবি করতে পারেন না। হেদায়েত হলো শিক্ষার অনেক ঊর্ধ্বে, ফলে টাকার বিনিময়ে হেদায়েতের আদান-প্রদান করা যায় না। আর এ জন্যেই নবী-রসূলগণ মানুষকে হেদায়েতের দিকে ডাকার বিনিময়ে কোনো কিছু গ্রহণ করতেন না।

এবং এ বিষয়ে কোর'আনে আল্লাহ বলেছেন –

اتَّبِعُوا مَنْ لَا يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُمْ مُهْتَدُونَ

"কেবল তাঁদের অনুসরণ করো, যারা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান বা টাকাপয়সা চায় না। এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত।" [সূরা ৩৬/ইয়াসিন - ২১]

অর্থাৎ, যারা টাকার বিনিময়ে ওয়াজ-মাহফিল করে, তাদের কথা শুনা যাবে না এবং তাদের অনুসরণ করাও যাবে। কারণ, তাদের থেকে আর যাই হোক হেদায়েত পাওয়া যাবে না।

অনেকে বলেন, ওয়াজ-মাহফিলটা আসলে শিক্ষার মতোই। এ কথাটা শতভাগ ঠিক নয়। কারণ, একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে এমনভাবে শিক্ষা দেন, যাতে শিক্ষা শেষ হলে ছাত্রটি উস্তাদের চেয়ারে বসতে পারে। কিন্তু, একজন ওয়াজ-মাহফিলের বক্তা কখনোই শ্রোতাদেরকে এমন কিছু শিক্ষা দিতে পারেন না, যাতে অনেকগুলো ওয়াজ শুনলে শ্রোতা বক্তার আসনে বসে ওয়াজ করতে পারবে। শিক্ষা এবং ওয়াজের মধ্যে পার্থক্য এটাই। শিক্ষক তার নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা শেয়ার করেন, কিন্তু ওয়াজকারী তার দক্ষতা ও যোগ্যতা শেয়ার করেন না, বরং মানুষকে হেদায়েতের দিকে আহবান করেন।

তর্কের খাতিরে ধরুন মেনে নিলাম, ওয়াজ মানে শিক্ষা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন শিক্ষক ১ ঘণ্টা ক্লাস করে যত টাকা পান, একজন বক্তা ১ ঘণ্টা ওয়াজ করে কি সে পরিমাণ টাকা নিতে রাজি হন? ধরুন, একজন শিক্ষকের মাসে বেতন ২০ হাজার টাকা। তিনি মাসে কমপক্ষে ২৫ দিন ক্লাস করেন, এবং প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ক্লাস করেন। তাহলে প্রতি ঘণ্টায় তার বেতন হলো ৮০ থেকে ১০০ টাকা। বাংলাদেশের কোনো বক্তা কি ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে ওয়াজ করবেন? যদি না করেন, তাহলে ওয়াজ আর শিক্ষা কি একই?

শিক্ষার সাথে ওয়াজকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। একই যোগ্যতার একজন শিক্ষকের ১ ঘণ্টা শিক্ষকতার চেয়ে একজন বক্তার ১ ঘণ্টার বক্তব্যে যদি বেশি টাকা নেন, তাহলে বুঝতে হবে, সে ওয়াজ মানে আসলে কোনো শিক্ষা নয়, বরং গলাকাটা ব্যবসা।

আমাদের দেশের মতো তুরস্কে কোথাও কোনো ওয়াজ-মাহফিলে বক্তাকে টাকা-পয়সা দেয়া হয় না। বরং, যিনি ওয়াজ-মাহফিল করেন, তিনি নিজেই নিজের টাকা দিয়ে বা কোনো ফাউন্ডেশন থেকে টাকা নিয়ে শ্রোতাদের চা-পানি-খাবারের আয়োজন করেন। আমার এক শিক্ষকের তথ্যমতে, কেবল ইস্তানবুলেই প্রতি রাতে কমপক্ষে ৫০০টি ছোট-বড় ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন হয়; কিন্তু কোথাও বক্তাকে টাকা-পয়সা দেয়া হয় না, সর্বোচ্চ বক্তার আসা-যাবার খরচ দেয়া হয়।

এতগুলো কথা বলার কারণ হলো, অনেকে ওয়াজ ও শিক্ষাকে এক করে ফেলেন। টাকার বিনিময়ে শিক্ষা দেয়ার নিয়ম রাসূল (স) থেকে চালু থাকলেও, টাকার বিনিময়ে ওয়াজের নিয়ম রাসূল (স) থেকে চালু নেই, বরং নিষেধ আছে। ওয়াজের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার এই বিদায়াতটি বাংলাদেশে নতুনকরে শুরু হয়েছে, যা আগে কখনো ছিলো না।
_____

(১) ইবনে কাছির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইফা, ৩য় খণ্ড, পৃ -৫৩৭
(২) প্রাগুক্ত, পৃ - ৫৪১

@জোবায়ের আল মাহমুদ

পঠিত : ১০৮৬ বার

মন্তব্য: ০