Alapon

চেঙ্গিস খান এবং মঙ্গল সাম্রাজ্যের উত্থান....


৬১৫ হিজরি।

চেঙ্গিস খানের দূত এসেছে সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারেজম শাহের কাছে। চেঙ্গিস খানের সাথে খাওয়ারেজম শাহের এটিই প্রথম যোগাযোগ। এর আগ পর্যন্ত চেঙ্গিস খানের জীবন কেটেছে গোবি মরুভূমিতে।

চীনের ক্যাথি সাম্রাজ্য ছাড়া আর কোনো সভ্যতার সাথে পরিচয়ও হয়নি তার। চীন জয়ের পর তিনি নিস্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছিলেন গোবিতেই। কারাকোরামকে গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন সমৃদ্ধ শহর হিসেবে, তাই স্বাগতম জানালেন সব অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের।

ব্যবসায়ীদের কাছে তিনি শুনলেন নানা দেশের গল্প। তাদের কাছেই তিনি জানলেন, তাঁর সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমানার ওপারে রয়েছে দারুণ এক উপত্যকা। সেখানে রয়েছে প্রশস্ত নদী, যা শীতে কখনো জমে যায় না। ওখানে রয়েছে প্রাচীন সব শহর ও স্থাপত্য। সেখানকার জীবনযাপন অবশ্যই উন্নত ।

কারণ সেই এলাকা থেকে আসা কাফেলাগুলো নিয়ে এসেছে লোহার তৈরী পাতলা তলোয়ার, ঘোড়ার সুন্দর লাগাম, সাদা কাপড় ও লাল চামড়ার তৈরী সুগন্ধী। সেই দেশের নাম খাওয়ারেজম। সেখানকার শাসকের উপাধি খাওয়ারেজম শাহ। চেঙ্গিস খান তাই দূত মারফত পত্র পাঠালেন খাওয়ারেজম শাহর কাছে। পত্রের ভাষ্য ছিল-

‘তোমার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও শক্তি সম্পর্ক আমি জেনেছি। আমি তোমার সাথে সম্পর্ক রক্ষা জরুরি মনে করি। তুমি আমার কাছে পুত্রের মত স্নেহাস্পদ। তুমি জেনেছ আমি চীন জয় করে এসেছি, তুর্কি গোত্রগুলোকেও করেছি পরাজিত।

আপাতত আর কোনো যুদ্ধের ইচ্ছে নেই আমার। আমার দেশ যোদ্ধায় পরিপূর্ণ একটি দেশ, আর এখানে রয়েছে রুপোর খনি। আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে বানিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে দুই দেশের মানুষই উপকৃত হবে’।

আপাতদৃষ্টিতে এটি সাধারণ পত্র মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত সুক্ষ্ম খোঁচা খাওয়ারেজম শাহ ঠিকই অনুভব করেছিলেন। চেঙ্গিস খান পত্রে তাকে পুত্র বলেছিল। আর এশিয়াতে নিজের করদরাজ্যের শাসকদেরকেই পুত্র বলে সম্বোধন করা হয়।

এছাড়া পত্রে তুর্কিদের পরাজিত করার কথাও ছিল সুলতানের জন্য অপমানের। কারণ তিনি নিজেও ছিলেন তুর্কি গোত্রের। তবে সুলতান নিজের মনোভাব প্রকাশ না করে দূতদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেন। চেঙ্গিস খান কিছু উপহার পাঠিয়েছিল, এসব তিনি গ্রহণ করলেন।

চেঙ্গিস খানের দূতদের মধ্যে কয়েকজন ছিল মুসলমান। বিশেষ করে আলি খাজা বুখারি ও মাহমুদ ইলওয়াজ ছিল খাওয়ারেজমের বাসিন্দা। তারা কোনোভাবে কারাকোরাম গমন করে এবং চেঙ্গিস খানের দরবারে চাকরি নেয়। মাহমুদ ইলওয়াজের চটপটে স্বভাব ও বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ সুলতান আলাউদ্দিনের মন জয় করে।

তিনি অন্য দূতদের থেকে আলাদা করে মাহমুদ ইলওয়াজকে দরবারে ডেকে নিলেন। সুলতানের আশা ছিল, মাহমুদ ইলওয়াজ যেহেতু জন্মসূত্রে খাওয়েজমের বাসিন্দা এবং মুসলমান তাই সে অবশ্যই সুলতান আলাউদ্দিনের পক্ষে কাজ করবে। সুলতান তাই মাহমুদের সাথে নির্জন কক্ষে দেখা করলেন।

মাহমুদ ছিল খুবই ধুরন্ধর ও বাকপটু ব্যক্তি। কিছুক্ষণের আলাপেই সে সুলতানের মন জয় করে নেয়। সে সুলতানকে বুঝাতে সক্ষম হয়, সে চেঙ্গিসের দরবারে কাজ করলেও সে মূলত খাওয়রেজম সাম্রাজ্যের হিতাকাঙ্ক্ষী। সুলতান এবার নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন

‘চেঙ্গিস খান কি আসলেই চীন জয় করেছে?’

'হ্যা এটা সত্য' মাহমুদ জবাব দিল।

‘তাঁর সেনাবাহিনী কি আমার সেনাবাহিনীর মত বিশাল?’ সুলতান আবার প্রশ্ন করলেন।

‘কোথায় আপনার সেনাবাহিনী আর কোথায় তাঁর সেনাবাহিনী। এ যেন সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় একজন সৈন্য, কিংবা সূর্যের মোকাবেলায় তারা। আপনার বাহিনীর সাথে তাঁর বাহিনীর কোনো তুলনাই হয় না’ মাহমুদ ইলওয়াজ কৌশলে সুলতান আলাউদ্দিনকে ভুল তথ্য দিল।

কিন্তু সুলতান তাঁর দেয়া বিশ্বাস করলেন এবং আত্মতুষ্টিতে ডুবে গেলেন। তবে তিনি আপাতত চেঙ্গিস খানের সাথে কোনো বিভেদে জড়ানোর চেয়ে ব্যবসায়িক চুক্তি করে নেয়াই ভালো মনে করলেন। চুক্তি হয়ে গেল। দূতদেরকে বিদায় দেয়ার সময় আবারও তিনি মাহমুদ ইলওয়াজকে একান্তে ডেকে নিলেন। তাকে বললেন,

‘তুমি তো আমার দেশেরই লোক। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তুমি চেঙ্গিসের দরবারে কাজ করবে ঠিক তবে তুমি হবে আমার গোয়েন্দা। তুমি তাঁর দরবারের খোঁজখবর নিয়মিত আমাকে জানাবে’ । মাহমুদ ইলওয়াজ রাজি হয়ে যায়। সুলতান তাকে অনেক উপঢৌকন দেন।

পরবর্তী দিনগুলিতে মাহমুদ ইলওয়াজ সুলতানকে অনেক তথ্য পাঠিয়েছিল। প্রতিটি তথ্যই ছিল ভুল। সুলতান বোকার মত এসব তথ্যে বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন।চেঙ্গিস খানের বাহিনী সম্পর্কেও তাঁর ছিল ভুল ধারণা। ফলে তাঁর যুদ্ধপ্রস্তুতিতে বিরাট ঘাটতি থেকেছিল। (তারিখে ইবনে খালদুন, শাজারাতুজ জাহাব)

প্রায় আটশো বছর পার হয়েছে। এখনো সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারেজম শাহের সেই ভুলের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা। বাকপটুদের কথার উপর আস্থা রেখে হচ্ছি প্রতারণার শিকার। একদিকে কর্মমুখর মানুষগুলোর প্রতি আমাদের মনে থাকে দ্বিধা ও সংশয়, বারবার ভাবি ‘এরা কাদের এজেন্ট?’, অন্যদিকে কর্মহীন বাকপটুদের আসন দেই মনের গোপন কোঠায়। আশা রাখি , একদিন তাদের হাতেই ফিরবে সুদিন।

এখনো আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি ভুলের সেই অখন্ড বৃত্তে...

ইমরান রাইহান

পঠিত : ৮২৬ বার

মন্তব্য: ০