Alapon

হাই সোসাইটির বিদ্যা-শিক্ষা ও আমাদের ভাষার দৈন্যতা...


গুলশানের এক অভিজাত ক্লাবে দাওয়াত ছিল। দেশের হাই প্রোফাইল মানুষদের পাদচারণায় মুখর থাকে এর অঙ্গন। দাওয়াতের একটি অংশে ছিল শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। বেশ কিছু শিশু এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। দৃশ্যত তারা সবাই আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলেরই ক্ষুদে ছাত্র/ছাত্রী বৃন্দ। এই স্কুলের শাখাও গুলশানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা জোনের আওতায়। আমি প্রবাসে থাকলেও, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখাপড়া করে আসছিলাম। তাই আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত এই স্কুলটি সম্পর্কে আমার আগে থেকেই জানা-শোনা ছিল। যেহেতু নামী-দামী স্কুলের ক্ষুদে দেশীয় শিক্ষার্থীদের খুবই কাছেই পেয়ে গেলাম, তাই তাদের নিয়ে আমার আগ্রহ একটু বেড়েই গিয়েছিল। যদিও আমি প্রবাসে একই স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিলাম।

বলে রাখা ভাল, আমাদের দেশের যে কয়টি স্কুলে লেখাপড়া করাটা ব্যয়বহুল, তার মধ্যে এই স্কুলটিও একটি। ধরে নিতে পারেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর পিছনে বছরে অন্যূন দশ লক্ষ টাকা শুধু স্কুলের পিছনেই খরচ হবে। আনুষঙ্গিক খরচ, যাতায়াত, টিফিন, টিউশনি ফি যোগ করলে অর্থের আকার দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে! আমার এই প্রবন্ধের লক্ষ্য ধনীদের টাকার হিসাব কষা কিংবা ধনীদের বিরুদ্ধে জনমত বিভ্রান্ত করা নয়। বরং এই উপমার উদ্দেশ্য হচ্ছে কিছু সচেতন বাবা মা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কেরিয়ার গড়তে একেবারে শিশুকাল থেকেই কতটুকু যত্নশীল হয় সেটা তুলে ধরা।

শিশুদের একজনকে বাংলায় প্রশ্ন করেছিলাম, সে কিসের ছবি আঁকছে? আমার দিকে তাকাল কিন্তু কোন উত্তর দিতে ব্যর্থ হল। আরেক জনকে প্রশ্ন করলাম সে কিসের ছবি বানাচ্ছে। কোন উত্তর নাই! কিন্তু চেহারার ভাষাটা এমন যে, আমার কথা বুঝতে পারলে তারা উত্তর দিবে; পরক্ষণে বুঝে নিলাম, তারা বাংলাদেশের স্কুলে পড়লেও বাংলা জানেনা কিংবা আমার প্রশ্ন তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। মেহমানের সাড়িতে তাদের মায়েদের দিকে চোখ পড়ার পর বুঝলাম, বেচারিরা আমার বাংলা প্রশ্নের কারণে বিরক্ত-বোধ করছেন!

এবার ইংরেজিতে প্রশ্ন করলাম, যথারীতি একই নির্লিপ্ততা! এবার তাজ্জব না হয়ে পারলাম না! কৌতূহল বেড়ে গেল, ভাবলাম সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলায় বারণ আছে কিনা? আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ার পেরেশানি দেখে আমার ছেলেটি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, বাবা কি হয়েছে? তাকে বিস্তারিত বলায় সে জানাল, তাদের সাথে কথা বলতে হলে আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজি বলতে হবে।

তাহলে তুমি কি ইতিমধ্যেই তাদের সাথে কথা বলেছ? সে জানাল, তাদের সাথে বিস্তারিত পরিচয় পর্ব বহু আগেই সাড়া হয়েছে! পরে দেখলাম ঠিকই তারা নিজেদের মধ্যে আমেরিকান উচ্চারণে কথা বলছে। উল্লেখ্য আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে ইংরেজিতে কথা চললেও দু’দেশের উচ্চারণ রীতি কিছুটা ভিন্ন। এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেহেতু আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড এ পড়ছে, তাই হুবহু আমেরিকার মত বিশুদ্ধ কথা বলে যাচ্ছে। পিতা-মাতার কঠোর নজরদারী ও শিক্ষার্থীদের গভীর অধ্যবসায় না থাকলে এই কৃতিত্ব অর্জন মোটেও সহজতর নয়। এজন্য নিজেদের মধ্যেই আলাদা একটি সোসাইটি গড়ে তুলতে হয়। (ব্রিটিশ আমেরিকান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলাদা পোষ্টে আরও পরিষ্কার করা হবে)

শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরষ্কার পাওয়া ছবিগুলো সুন্দর লেগেছে, দারুণ রং, ছবির উজ্জ্বলতা চিক চিক করছিল। তবে তিনটি ছবির মধ্যেই বিলাসী, আয়েশি মানুষের জীবন যাত্রার চিত্র পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। প্রথম পুরষ্কার পাওয়া ছবির শিশুটি এঁকেছিল, একটি ডিম্বাকার খাবার টেবিলে ছয়জন রমণী খেতে বসেছে। দামী চেয়ার, মহিলাদের অলংকার এমনকি ডাইনিং টেবিলের অগণিত খাবারের ছবি এবং কিছু উচ্ছিাস্টাংশ! পেশাদার শিল্পীর তত্ত্বাবধান ছাড়া এত ক্ষুদে শিক্ষার্থী পক্ষে এ ধরনের ছবি আঁকা সম্ভব নয়। আর যিনি অংকন শিখিয়েছেন তিনি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পছন্দ, চরিত্র, ইচ্ছা ও অভিলাষকে তাদের সন্তানদের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা দেখিয়েছেন।

সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে এসব ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অর্থ-বিত্ত কিংবা উচ্চ বেতনের শিক্ষক দ্বারা পাঠদানের ব্যাপারে কোথাও কার্পণ্য করেনি কিন্তু নিজের দেশের ভাষা, মায়ের ভাষার প্রতি এত অবজ্ঞা দেখে আমি যতোধিক তাজ্জব হয়েছি ততোধিক ব্যথিত হয়েছি। ব্রিটেন আমেরিকার ইংরেজি পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সিলেটী, নোয়াখালী কিংবা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করতে দেখিনি কিন্তু নিজ দেশে বাংলাকে অবহেলিত হতে দেখেছি। বাচ্চাকে ইংরেজিতে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষিত বানিয়ে, অবশেষে কত পিতা-মাতাকে বুক থাপড়াতে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই।

ইতিহাসে ইংরেজির চেয়ে বাংলার কাহিনী কিন্তু ভারী। ষোড়শ শতাব্দীর একজন নাট্যকার শেক্সপিয়র কে নিয়ে ইংরেজেরা গৌরব বোধ করলেও একই শতাব্দীর শুরুর মহাকবি আলাওলকে নিয়ে আমরা গৌরব করতে জানিনা। আর দ্বাদশ শতাব্দীর রাজকবি আবদুল হাকিমের কথা এখন নাইবা তুললাম। আমরা নিজের গৌরব ভুলে অন্যের রঙ্গে রাঙ্গাবার ক্ষেত্রে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

লিখেছেন: নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৮৬১ বার

মন্তব্য: ০