Alapon

উসমানীয় খলিফা কানুনী সুলতান সুলায়মান খান...


এই মহান সুলতান ১৪৯৪ সালের ৬ই নভেম্বর উত্তর-পূর্ব তুরস্কের ট্রাবজোন নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সুলতান সেলিমের পুত্র, তাঁর মা হাফসা সুলতান।

মাত্র ৭ বছর বয়সেই সুলায়মানকে পাঠানো হয় রাজধানী ইস্তান্বুলের রাজকীয় নিবাস তোপকাপি প্রাসাদে। সেখানে তিনি অল্প বয়স থেকেই ইতিহাস, সাহিত্য,যুক্তিবিদ্যা,ইসলাম,দর্শন ও সমরবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি একইসঙ্গে তুর্কি, আরবি, চাগতাই, ফার্সি ও সার্বিয়ান ভাষায় দক্ষ ছিলেন। এখানেই তিনি তার বাল্যবন্ধু ও সঙ্গী পার্গালির সঙ্গে পরিচিত হন। যিনি ইতিহাসে পার্গালি ইব্রাহিমপাশা নামে বেশি পরিচিত। বাল্যকালেই বিশ্বাধিপতি আলেকজান্ডারের ন্যায় বিশ্বসাম্রাজ্য নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তিনি ।

যুবরাজ থাকা কালেই সুলায়মান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তখনই তাঁর সততা ও যোগ্যতার কথা সর্বত্র আলোচিত হতো। তিনি খলিফা হওয়ার পর সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সুলতান সুলায়মান ছিলেন একজন নিষ্টাবান মুসলিম। তৎকালীন এক ভেনেশিয়ান দূত বার্তোলোমিও কোন্তারিনির মুখ থেকে তার বিবরণ পাওয়া যায় এমন যে," সুলতানের ব্যবহার ছিল বন্ধুসুলভ, কোমল ও পরিমার্জিত। সুলতান বই পড়তে পছন্দ করতেন, তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ও সকলের প্রতি ন্যায় বিচার করতে পছন্দ করতেন"।

শাহজাদা হিসেবে সুলায়মানের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক দায়িত্বের জীবন শুরু হয় ১৭ বছর বয়সে। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তিনি উত্তরপূর্ব ইজমিরের দুটি সানজাক (জেলা) ক্রিমিয়া ও মানিসার গভর্নর হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ২৬ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন।

১৫২০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর বিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নেন৷ তার পিতা ইয়াভুজ সুলতান সেলিম খানের মৃত্যুর পর ইস্তান্বুলে উসমানী সালতানাত বা অটোমান সাম্রাজ্যের ১০ম সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহন করেন সুলতান সুলায়মান খান। তখন তার বয়স ২৬ বছর। তাঁকে দেখা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মতে, “তিনি লম্বা, মাংশপেশী বহুল, সুন্দর গায়ের রঙ। তাঁর ঘাড় লম্বা, বদন সুশ্রী, চোখা নাক, সন্তুষ্টচিত্ত, গায়ের চামড়া কোমল। তাঁকে বলা হয়েছিল জ্ঞানী সুলতান, অধ্যয়নপ্রিয় এবং সকল প্রজা আশা করেছিল তাঁর শাসনে ভালো কিছু পাবে।”

ষোড়শ শতাব্দীর পৃথিবীতে সুলায়মান ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী সুলতান। তিনি উসমানীয় সালতানাতের দশম এবং সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী শাসনরত সুলতান,
সুলতান সুলায়মানের শাসন আমলে অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির এতটা বিস্তার লাভ করে ৷ যিনি প্রাচ্যে “আল কানুনি বা আইন প্রণেতা” এবং প্রাতীচ্যে “ম্যাগনিফিসেন্ট বা মহামতি” নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালকে (১৫২০-৬৬) উসমানীয় খিলাফতের স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের প্রায় ৮০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন ৷ বিশাল রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি তিনি কলা, শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছিলেন।

সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহনের পরপরই চারদিক দিয়ে যুদ্ধের হুংকার আসতে থাকে সালতানাতের দিকে। অসীম মেধা ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি এক একটি যুদ্ধ জয় করেন এবং ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা তিন মহাদেশে উসমানী সালতানাতের প্রভাব বিস্তার করেন।

সুলায়মান তাঁর ৪৬ বছরের রাজত্বকালের ১০ বছর ৩ মাস যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ১৩ টি সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তার যুদ্ধ যাত্রা শুরু হয় ১৫২১ সালে সিরিয়ার দামেস্কে নিযুক্ত বিদ্রোহী গভর্নরের বিরুদ্ধে। তাকে পরাজিত করেই সুলতান নজর দেন কিংডম অব হাঙ্গেরির দিকে। সার্ব, ক্রোয়েট ইত্যাদি রাজ্যের পতনের পরে একমাত্র হাঙ্গেরিই ছিল ইউরোপে ক্ষমতা বিস্তারে অটোমানদের পথের কাটা। হাঙ্গেরির তৎকালীন রাজধানী বেলগ্রেড ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর, যা সুলতান সুলায়মানের প্রপিতামহ সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। ১৫২১ সালের আগস্ট মাসে তিনি বেলগ্রেড অবরোধ করেন। কয়েক সপ্তাহ তীব্র গোলাবর্ষণের পর বেলগ্রেডের পতন হয়।

বেলগ্রেডের পতনে ইউরোপব্যাপী খ্রিষ্টান রাজ্যসমূহে ভয়ের সঞ্চার করে। এরপর সুলতান সুলায়মান ভূমধ্যসাগরে অভিযান পরিচালনা করেন। মাল্টা ও রোডস দ্বীপপুঞ্জে তখন ছিল খ্রিষ্টান ক্রুসেডার নাইটস হস্পিটলারদের শক্ত ঘাঁটি। এখান থেকে তারা বিভিন্ন সময় মুসলিম ব্যবসায়িক জাহাজে হামলা ও লুটতরাজ করত। সুলতান এদেরকে দমনের জন্য ৩০০টি রণতরীর এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। অপরদিকে তিনি নিজে ৮০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনর উপকূল দিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। ১৫২২ সালের গ্রীষ্মে তিনি রোডস দ্বীপ অবরোধ করেন পরবর্তী ৬ মাসব্যাপী তীব্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দ্বীপটি দখল করেন। তিনি এসময় আটক খ্রিষ্টানদের মুক্তি দেন ও তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

এসব অভিযানের মাধ্যমে সুলায়মান যখন ইউরোপে ভীতির সঞ্চার করেছেন সে সময়ে ১৫২৫ সালে ফরাসী রাজা ফ্রান্সিসের দূত সুলায়মানের দরবারে আসে এবং বলে ফরাসীরাজ আপনাকে হাঙ্গেরী আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সুলায়মান রাগান্বিত হন এবং গর্বিত কন্ঠে এক অভিনব ভঙ্গিতে বলেন, “আমি, প্রাচ্য ও প্রাতীচ্যের সুলতানদের সুলতান; স্বাধীনতাকামীদের স্বাধীনতাদাতা; পৃথিবীর সকল সুলতানের মুকুটের বণ্টনকারী; পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র ছায়া; সৃষ্টির নায়ক, রোমান, পারস্য ও আরবদের রাজ্যের অধীশ্বর; ভূমধ্য ও কৃষ্ণ সাগরের অধিপতি; রুমেলিয়া, আনাতোলিয়া, কার্মানিয়া,রুম,দিয়ারবাকির, পারস্য, আজারবাইজান, দামেস্ক, আলেপ্পো, কায়রো, মক্কা, মদীনা, জেরুজালেম, আরব, ইয়েমেন ও অন্যান্য দেশ যা আমার গর্বিত পূর্ব পুরুষেরা বিজয় করেছে এবং আমার প্রজ্জলিত তরবারি যেসমস্ত অঞ্চল গ্রাস করেছে সেগুলোর শাসক; আমি, সুলতান সেলিম খানের পুত্র সুলতান সুলায়মান খান! ফরাসীরাজ ফ্রান্সিস অপমানজনক শর্তে সুলায়মানের মিত্রতা লাভ করেন।

১৫২৬ সালে সুলায়মান হাঙ্গেরি আক্রমণ করেন এবং বুদাপেস্ট দখল করে পূর্ব ইউরোপকে পদানত করেন।১৫২৬ সালে মোহাকসের যুদ্ধে তিনি আবারো হাঙ্গেরিকে পরাজিত করেন। এ যুদ্ধে হাঙ্গেরিয়ান রাজা দ্বিতীয় লুইস মৃত্যুবরণ করেন। একে একে তিনি তৎকালীন সকল পরাশক্তিসমূহকে পরাজিত করেন।ইউরোপের শক্তিশালী হাবসবুর্গ সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে পারস্যের সাফাভিদ শাহ সকলেই তার কাছে পরাজিত হয়। সুলতান সুলেমানের সেনাবাহিনী রোমান সাম্রাজ্য এবং হাঙ্গেরির পতন ঘটায়। পারস্যের সাফাভী শাসক প্রথম তাহমাস্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং মধ্য প্রাচ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নেন।

১৫২৯ সালে সুলায়মান ভিয়েনা অবরোধ করেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার দরুন শহর দখল করতে পারেন নি ৷অস্ট্রিয়ানরা সন্ধি করে সুলায়মানের হাত থেকে রক্ষা পায় ৷ ১৫৩৪ সালে তিনি কুর্দিস্থান ও তাব্রিজ দখল করেন। উত্তর আফ্রিকায় এসময় সুলায়মানের সেনারা আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, বার্কা, ত্রিপলি বিজয় সম্পন্ন করেন। ১৫৩৭ থেকে ১৫৪০ সনে পোপের নেতৃত্বাধীন পবিত্র সংঘ সুলায়মানের নৌ সেনাপতি খায়েরুদ্দীনের নিকট নৌযুদ্ধে পরাজিত হয়, এভাবে ভেনিস সুলায়মানের হস্তগত হয়।

শুধু সেনাবাহিনী ই নয় তার আমলে শ্রেষ্ঠ উসমানীয় নৌবাহিনী ছিল অদ্বিতীয় ৷ নৌসেনাপতি কাপুদান পাশা হিজির খায়রেদ্দীন বার্বারোসার নেতৃত্বে নৌশক্তিতেও উসমানীয়রা প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে উঠে। তিনি উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়া সহ বড় বড় অঞ্চলগুলো স্পেনিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে দখল করে নেন। অটোমান নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর পর্যন্ত তাদের আধিপত্য বজায় রাখে। ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর, লোহিত সাগর সর্বত্র তাদের সগর্ব বিচরণ ছিল। এমনকি ভারত মহাসাগরে ইন্দোনেশিয়ার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলোকে ডাচদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি অভিযান পাঠান সুলতান সুলায়মান।

১৫৪৩ সালে রোমান সম্রাট ৫ম চার্লস ও আর্ক ডিউক ফার্ডিনান্ডকে ধরাসায়ী করার উদ্দেশ্যে সুলায়মান আবারো হাঙ্গেরি আক্রমণ করেন। ১৫৪৭ সালে আদ্রিয়ানোপলের সন্ধির মাধ্যমে এই যুদ্ধ শেষ হয়। সুলায়মানের হাঙ্গেরী বিজয় সম্পন্ন হয় তবে ফার্ডিনান্ডকে বাৎসরিক ৩০,০০০ ফ্লোরিন্স প্রদানের বিনিময়ে হাঙ্গেরীর উত্তর-পশ্চিম অংশ শাসন করতে দেন। এই সন্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এই চুক্তিতে সুলায়মান ৫ম চার্লসকে রোমান সম্রাট হিসেবে স্বাক্ষরের পরিবর্তে স্পেনের রাজা হিসেবে স্বাক্ষর করান এবং নিজে রোমের কাইজার হিসেবে স্বাক্ষর করেন। স্পেন ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীর এই আঁতাতকে ধরাসায়ী করে সুলায়মান একটি কবিতা রচনা করেন। যাতে তিনি লিখেছেন, “আল্লাহ্‌র দাস, পৃথিবীর বাদশা, আমি সুলায়মান, ইসলামের সকল নগরীতে প্রার্থনায় লোকে উচ্চারণ করবে আমার নাম, আমি বাগদাদের শাহ, তাবৎ রোমান ভূখণ্ডের কাইজার, মিশরের সুলতান, হাঙ্গেরীর গর্বিত রাজতন্ত্রকে দাসে পরিণত করে আমি লুটেছি হাঙ্গেরির সম্মান।”

সুলায়মান ভারত মহাসাগর থেকে পর্তুগীজ আধিপত্য বিলোপ করতে চেয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যে ১৫৪৮ সালে তুর্কিরা ইয়েমেন, এডেন ও লোহিত সাগরের দক্ষিণাংশ হস্তগত করে। ভারত মহাসাগর থেকে পর্তুগীজদের পুরোপুরি বিতাড়িত করতে না পারলেও তাদের শক্তি খর্ব করতে তিনি সক্ষম হন ৷ ১৫৬৬ সালে সুলায়মান হাঙ্গেরিকে পরিপূর্ণভাবে শায়েস্তা করার নিমিত্তে ৭ম বারের মত হাঙ্গেরি আক্রমণ করেন এবং জিতেগভার দূর্গ অবরোধ করেন কিন্তু তাঁর সেনারা দূর্গ দখল করার পূর্বেই ৬ সেপ্টেম্বর সুলেয়মান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্র ২য় সেলিম খান সিংহাসনে বসার পূর্ব পর্যন্ত সুলায়মানের মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখা হয়৷ ইতিহাসবিদরা মনে করেন, সেনাবাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে যাবে একারণে তথ্য গোপন রাখা হয়।

সুলতান সুলায়মান একদিকে যেমন যুদ্ধ জয় করেছেন অন্যদিকে তিনি রাজ্যের মানুষের শান্তি ও উপকারের জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক উন্নতি ও পরিবর্তন করেন।সঠিক ন্যায়বিচার ও আইন প্রণয়নের জন্য সাধারণ মানুষ তাকে কানুনী সুলতান উপাধি দেয়। ইসলামের শরিয়াহ আইনকে ঠিক রেখে জনগণ ও প্রত্যেক ধর্মের মানুষের জন্য ন্যায়বিচার করার লক্ষ্যে ও সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তিনি প্রধান মুফতির সহায়তায় সুলেমান লিগ্যাল কোড বা আইন নীতি প্রণয়ন করেন যার মূলে ছিলো ইসলামিক আইন। যাকে কানুন-ই উসমানী নামেও ইতিহাসে বলা হয়ে থাকে। তিনি রাজ্যের খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য দেন। খাজনা বা ট্যাক্স ব্যবস্থার উন্নতি ও পরিবর্তন করে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করেন অন্যদিকে জনগণের জীবন মান উন্নয়ন করেন।তিনি ইউরোপের রোমান ক্যাথলিকদের দ্বারা নির্যাতিত অর্থোডক্স খ্রিষ্টান ও ইহুদীদের আশ্রয় দেন। সুলতান অপরাধের ভিন্নতা ও মাত্রার উপর ভিত্তি করে জরিমানা ও অন্যান্য শাস্তির ব্যবস্থা করেন ।

সুলতান সুলায়মানের শাসনামলে উসমানী সালতানাত শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় এক সোনালী যুগে প্রবেশ করে।তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী মানুষ। তিনি দেশব্যাপী সকল মসজিদে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। রাজধানী ইস্তান্বুল ও আশেপাশে প্রচুর মক্তব ও মাদ্রাসা তৈরী করেন যেখানে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা হয়। যা উক্ত সময়ে ইউরোপের কোনো দেশে করা প্রায় অসম্ভব ছিল৷

দৈনন্দিন জীবনে তিনি ইসলামের অনুশাসনগুলো নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। সকল মুসলিম নাগরিক যাতে নিয়মিত সালাত ও সাওম পালন করে সে দিকে তার সজাগ দৃষ্টি ছিলো। সালাত ও সাওম পালনে শৈথিল্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিলো। আল কুরআনের আটটি খন্ড নিজের হাতে কপি করে সুলাইমানিয়া মসজিদে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করেন। তিনি কাবার ও সংস্কার করেন। তিনি দুর্নীতিবাজদের বরখাস্ত করে সৎ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দেন ৷ তিনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন। ইতিহাসবিদ লড ক্রিজ বলেন, "সুলতান সুলায়মানের ন্যায়পরায়নতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল"।

শিল্পচর্চার দিক দিয়েও তিনি অনেক সচেতন ছিলেন। তার আমলে প্রায় ৬০০ জনের অধিক শিল্পী ও কলাকুশলী রাষ্ট্রীয় সহায়তায় কাজ করতেন। সুলতান নিজেও একজন কবি ছিলেন। তিনি ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় বেশ কয়েকটি কবিতা ও গজল রচনা করেন। যার মধ্যে অন্যতম "মুহিব্বি" ও আমার সুলতান মুহাম্মদ। তার আমলে ইউরোপীয়, তুর্কি, আরবী ও ফার্সি কালচারের এক অনন্য মিশ্রণ সৃষ্টি হয়।

তাঁর সময়ে স্থাপত্যকলায় ব্যাপক এগিয়ে যায় উসমানীয়রা। বিখ্যাত নির্মাণ ও স্থাপত্য শিল্পী মিমার সিনান এসময় দৃষ্টিনন্দন ও চমকপ্রদ স্থাপত্যকলা দিয়ে তৈরি করেন সুলাইমানিয়া মসজিদ, সেলিমিয়া মসজিদ ইত্যাদি যা আজও তুরস্কের সৌন্দর্য বর্ধণ ও ইতিহাসের সোনালী যুগের সাক্ষ্য বহন করছে। পাশাপাশি তিনি কাবার সংষ্কার, মক্কা-মদিনার যোগাযোগ উন্নয়ন ইত্যাদি বহুবিধ কাজ করেন । রাষ্ট্রের সব জায়গায় বহু মসজিদ,রাস্তা,ব্রিজ, হাসপাতাল, গোসলখানা ইত্যাদী তৈরী করেন৷ রাজ্যের প্রশাসনিক উন্নতি বিধানকল্পে তিনি অসংখ্য রাস্তা, সেতু ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করেন। জেরুজালেমের বিখ্যাত ভগ্ন দেয়াল ও প্রস্থর গম্বুজের সংস্কার করেছিলেন। ইসলামের প্রসিদ্ধ নগরী মক্কা, মদীনা, জেরুজালেম, দামেস্ক ইত্যাদির উন্নয়নকল্পে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এছাড়াও সুলায়মান অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর দরবারে কবি, সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীদের যথেষ্ঠ কদর ছিল।

আইন প্রণয়ন, শাসন বিধি প্রণয়ন, সামরিক সাফল্য, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সব মিলিয়ে তিনি ঐ সময়ের রাজন্যবর্গের মধ্যে ছিলেন অনন্য ৷ তিনি যে শুধু সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন সেটাই না, সাম্রাজ্যের সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক প্রণালী তৈরি করেছিলেন তিনি।
প্রাচ্যে আইন প্রণেতা হিসেবে তাঁর যে খেতাব তাঁর কারণ ছিল কুরআনের আইন এবং ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে সুলতানী আইনের প্রচলন করেছিলেন, যদিও দ্বিতীয় মুহাম্মদের সময় থেকেই এই আইন প্রচলিত হয়ে আসছিল কিন্তু সুলায়মান তা কানুন আকারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তী তাঁর উত্তরাধিকারীরা সেটা অনুসরণ করেছেন এমনকি আধুনিক তুরস্কে তার কিছু অনুসরণ করা হয়। তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র উৎকৃষ্ট প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল, লোক প্রশাসন, ভূমি প্রশাসন, খাজনা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদির সুস্পষ্ট নির্দেশনা তাঁর সুলতানি আইনে দেয়া ছিল।

সুলায়মান প্রকৃতই মহানুভব শাসক ছিলেন, তাঁর রাজ্য অন্য ধর্মের লোকেরা পেয়েছিলেন শান্তি, বিধর্মীদের তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন অতিরিক্ত করের বোঝা থেকে। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন একজন ইহুদী। তাঁর আদালতে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলে পেত ন্যায়বিচার। ১৫২৬ সালে সংঘটিত মোহাকসের যুদ্ধে হাঙ্গেরিরাজ ২য় লুই যখন সুলায়মানের নিকট পরাজিত হয়ে যুদ্ধের প্রান্তরে মৃত্যুবরণ করেন তখন সুলায়মান বলেছিলেন, “আমি তাঁর বিরুদ্ধে তরবারি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এটা আমার ইচ্ছে ছিল না যে আমি তাঁর লাশ দেখব, যেখানে সে জীবনের স্বাদ ও আভিজাত্যের মর্যাদা ভোগ করছিল।”

সুলায়মানকে এখন পর্যন্ত বিবেচনা করা হয় একজন আদর্শ প্রশাসকের প্রতীক হিসেবে। ইউরোপে সেই সময় তার সমকক্ষ কোন শাসক ছিল না। যদিও তাঁর বিস্তৃত সাম্রাজ্যের এক বিশাল অংশ তাঁর পূর্ব পুরুষেরা জয় করেছিলেন, তবুও বিজেতা হিসেবে তাঁর কৃতিত্বকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তাঁর সমকালীন পৃথিবীতে সুলায়মান যে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন অন্য কোন সুলতান হয়তো তা পারেননি। তাঁর জীবনের শেষ ৩০ বছর তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুলতান হিসেবে বিবেচনা করা হত। তাঁর সেনারা ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনা, তাঁর প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল প্রশংসনীয়, তাঁর আইন ছিল সর্বোৎকৃষ্ট৷ সত্যিই তিনি ছিলেন মহানুভবতার নিদর্শন।

সংগৃহিত...

পঠিত : ১৫৭৯ বার

মন্তব্য: ০