Alapon

মানবাধিকার ও চলমান বিশ্ব...


তোমার অন্তর এত অন্ধকার কেন? প্রশ্নটি বর্তমান সময়ের সমালোচিত ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রয়্যাম্পের প্রতি।অবশ্য তিনি এ প্রশ্নের একটি স্মারকমাত্র।আগে মুসলিমবিদ্বেষী হলেও সম্প্রতি তার মুসলিম নিষিদ্ধ প্রস্তাবের কারণে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছেন রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।
বর্তমানে সব জায়গায় এক নীরব অস্থিরতা বিরাজমান।সাহসীরা জীর্ণতায় আক্রান্ত। কবির ভাষায়-
এই উন্মাদ খুনের গঙ্গায়/এই মুক্তিহীন রক্ত উপত্যকায়য়/আজ কেউ ভালো নেই,কেউ না।
উপর্যুক্ত ভাবনাযুক্ততার কারণ,মানবাধিকার দিবসকে ঘিরে।

১ম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় নতুন রাস্ট্রের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমুহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।১৯৪০ সালে H.G Welles তার New World Order বইয়ে মানবাধিকারের একটি সনদপত্র ঘোষণার পরামর্শ দেন।১৯৪১ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কংগ্রেসের নিকট ৪টি স্বাধীনতার সমর্থন করার আবেদন করেন।১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে আটলান্টিক ঘোষণায় দস্তখত করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল চার্চিলের ভাষায় -মানবাধিকারের ঘোষণার সাথে সাথে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর লিখিত সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সং্যোজন আরও সুস্পষ্টরূপ ধারণ করে।ফ্রান্স তার ১৯৪৬ সালের সংবিধানে ১৭৮৯ সালের মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র শামিল করে।একই বছর জাপান মৌলিক অধিকারকে সংবিধানের অংশে পরিণত করে।১৯৪৭ সালে ইটালি তার সংবিধানে মানবাধিকারের গ্যারান্টিদান করে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচালিত চেষ্টা সাধনার ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালের ১০ ডিসেম্ভর জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয়।মতামত যাচাইয়ে এর অনুকূলে ৪৮ ভোট হয়।৮টি দেশ মতামত যাচাইয়ে অংশ নেয়নি যার মধেয়্য রাশিয়াও ছিল।এ ঘোষণা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে তার মূল্যায়নের জন্য মানবাধিকার কমিশন নামে স্বতন্ত্র কমিশন হয়।১

আমরা মনে করি, ৪৭ ধারা সম্বলিত মদিনা সনদই মানবাধিকারের মূল দলিল।মদিনা সনদেই সর্বপ্রথম জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অধিকারের কথা বলা হয়।প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকারলাভ সম্পর্কিত ধারাটি বেশ আক্র্ষণীয়।মদিনা সনদ সম্বন্ধে পি কে হিট্রি বলেন,রক্তের সম্পর্কের পরিবর্তে ধর্মের ভিত্তিতে সুশৃনখল সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা আরবের ইতিহাসে এই প্রথম।আজকের জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদেরও পথিকৃৎ মদিনা সনদ।

বাস্তবতা হচ্ছে এতসব আয়োজনের পরেও আজ পৃথিবী মানবাধিকার অবমাননার চারণভূমি।অবৈধ ইসরাইল আর তার দোসরদের পাপাচারে মানবতা আজ নিগৃহীত। ফিলিস্তিনের রক্তের উপর দঁাড়িয়ে মানবতা আজ নেতিবাচক এক উপাখ্যান রচনা করেছে।ইন্তিফাদা সংগ্রামে সংগ্রামী এই জনপদ রক্তসাগরে রূপধারণ করেছে।অন্ত্র্ঘাতী আর নির্মম হামলায় নিষ্পাপ শিশুগুলো অকালেই ঝরে যাচ্ছে।শিয়া-সুন্নী বিরোধ কাজে লাগিয়ে আরব কে ধংস করার আয়োজন সম্পন্নপ্রায়।সিরিয়া আজ জীবন্ত এক জাহান্নাম।স্বার্থের প্রয়োজনে নিষিদ্ধ মারনাস্ত্র সেখানে প্রয়োগ করা হচ্ছে।বসনিয়ায় সার্বদের গণহত্যা এক ঘৃণিত দলিল।
মারণাস্ত্রের অজুহাতে ইরাককে প্রায় শেষ করে দেয়া হয়েছে।অথচ আজ পর্যন্ত সেখান থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।৯/১১ নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। অথচ কাল্পনিক অভিযোগে আফগানিস্তানের ভগ্নদশা করা হয়েছে।ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এ শতাব্দীর নতুন কালিমা।আমির খানকে দেশ ছাড়তে হয়েছে বাধ্য হয়েই।উগ্র হিন্দুত্ববাদী অশুভ অসুর শক্তি ভারত জুড়ে ডানা মেলে আছে।গো-মাংস খাওয়ার অপরাধে নির্মম বলির শিকার হচ্ছে ভারতবাসী মুসলিমরা।বিজেপি নেতার পক্ষ হতে মুসলিম নারীদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার হুমকি দেয়া হয়েছিল।এর প্রয়োগও বিশ্ববাসী মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছে।বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে ঘৃণ্য এক ইতিহাসের সৃজন করা হয়েছে।হায়দারারাবাদ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রকে ক্ষমতার জন্য শেষ করা হয়েছে।এর অধিবাসী মুসলমানের উপর ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয়েছিল।জালিওয়ালানাবাগ হত্যাকান্ড নিয়ে রবিন্দ্রনাথও কথা বলেছেন।
আসলে মাহমুদুর রহমান ঠিকই বলেছেন-মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই।

মানবাধিকার ও চলমান বিশ্ব-২

নিরপরাধ নারী ও পুরুষ হত্যা মার্কিনী ও ইসরাইলীদের কাছে কখনও কোন সমস্যারূপে দেখা দেয়নি।ভিয়েতনামের মাই লাইয়ে ও অন্যত্র যুক্তরাস্ট্র তার প্রমাণ দিয়েছে।১৯৪৮ সালে ইরগুন নামক সন্ত্রাসী ইহুদী প্রতিষ্ঠানের নেতা মেনাহেম বেগিম দির ইয়াসিন নামক আরব পল্লীর ২৫০ জন নারী শিশুকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল।স্ব্ররচিত দ্য রিভিল্ট গ্রন্থে বেগিন এ সংবাদ বিশ্ববাসীকে দিয়েছেন।১৯৬৭ সালের যুদ্ধে গাজা ও পশ্চিম তীর দখলের পর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ইসরাইল মোট ১৬২১২ আরব পরিবারের বাড়িঘর লন্ড-ভন্ড করে দেয়।মোট প্রায় ৪০ লাখ প্যালেস্টাইনি আরবের মাঝে ইসরাইলী আরবের সংখ্যা ৬৫০০০০ জন।ইসরাইলী সামরিক বাহিনী শাসিত পশ্চিম তীর ও গাজায় বসবাস করছে ১০ লাখ,জর্ডানে ১০ লাখ,লেবাননে ৪৫০০০০ জন এবং বাকিরা আছে উপসাগরীয় সিরিয়া,মিশর ও ইরাকে।২

জীবনের নিরাপত্তা সম্বন্ধে কুরআন বলে,"নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধবংসাত্বক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করল,আর কেউ প্রাণ রক্ষা করল সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করল(মায়েদা-৩২)।অন্যত্র আল্লাহ বলেন,"আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করনা(বনী ইসরাইল-৩৩)।ইসলামী আইন ক্বতল বিল হাক্ক(সংগত কারণে হত্যা) ৬টি ক্ষেত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ রয়েছে(আন আম-১৫২,বাকারা ১৭৮-১৭৯,ফুরকান-৬৮)।
ন্যায়বিচার লাভের অধিকার প্রতেয়্যকের আছে।সূরা আরাফের ১৫২ আয়াতে আল্লাহ এ নির্দেশনা দিয়েছেন।কিন্তু,আজ আমাদের দেশে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড নির্বিচারে হচ্ছে।HRSC 'র রিপোর্ট মতে,এপ্রিল ১ হতে জুন ৩০ পর্যন্ত ৩০ জন ক্রসফায়ারে মারা গেছেন।৩ এভাবে বিচারহীন হত্যাকান্ডের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
৪টি রাস্ট্রীয় মূলনীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি সাংবিধানিক অধিকারেরও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল।সময়ের সাথে সাথে তা আরো বৃদ্ধি করা হয়েছিল।কিন্তু আজ সকল রাজনৈতিক অধিকার অনেকাংশে কেড়ে নেয়া হয়েছে।বিরোধী মত গণতন্ত্রের প্রাণ।কিন্তু বিরোধী মত দলনে প্রজাতন্ত্রকে লজ্জাহীনভাবে ব্যাবহার করা হচ্ছে।
বাকস্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত।জিয়াউর রহমান পশ্চিমা বিশ্ব সফর করে বাকস্বাধীনতার মর্ম উপলদ্ধি করে মুক্তাজ্ঞন প্রতিষ্ঠা করেন।এখানে যে কেউ এসে যে কারো সমালোচনা করতে পারত।এর পূর্বে মাত্র ৪ টি পত্রিকা চালু রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়।বর্তমান সরকারের শাসনামলে বন্ধ দিগন্ত টিভি,ইসলামিক টিভি ও আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ হলেও দীর্ঘ সময়েও তা খুলে দেয়া হয়নি।আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান নির্মম আক্রোশের শিকার।সাম্রাজ্যবাদ,আধিপত্যবাদ বিরোধী আপোষহীন এ মানুষটি খুব শীঘ্রই মুক্তি পাবেন এরকম কোন লক্ষণও নেই।

দার্শনিক রূশো বলেছিলেন, Man borns free but everywhere in chain.বস্তুত আজকের অশান্ত পৃথিবীতে মানুষ একরকম অশান্তি নিয়েই বাস করছে।কালো আর ধলো প্রভেদ,আশ্রাফ আর আতরাফের মোচন করে সামেয়্যর গান গেয়ে এগিয়ে চলাই হোক মানবাধিকার দিবসের প্রত্যয়।

১.ইসলামে মানবাধিকার-মুহাম্মদ সালাহুদ্দীন।
২.the question of palestain-article by edward said-1982
৩.HRSC bulletin.

লিখেছেন: সাইফুল সুজন

পঠিত : ৫৬২ বার

মন্তব্য: ০