Alapon

আমি যে স্বপ্ন দেখি



তখন খোলাফায়ে রাশেদিনদের সময়কাল চলছিল। তাঁরা মুসলিম বিশ্ব সম্প্রসারনে মনোযোগ দিলেন। তৎকালীন খলিফা আল্লাহর রাসূলের অন্যতম প্রিয় সাহাবী হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) কে, সেনাপ্রধান করে আলেকজান্দ্রীয়া অভিযানে পাঠান। আলেকজান্দ্রিয়া ছিল মিশরের একটি প্রাচীন শহর। সেই সময় নগর রাষ্ট্রের প্রচলন ছিল। তখন এই নগরকে ঘিরেই একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। আলেকজান্দ্রিয়া খৃষ্টান প্রধান দেশ। হযরত আমর তাঁর বাহিনী নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার সীমানায় তাঁবু স্থাপন করলেন।

হযরত আমর আলেকজেন্দ্রীয়ার শাসকের কাছে দূত পাঠালেন। বললেন, “যদি তোমরা আমাদের বস্যত স্বীকার কর এবং জিজিয়া কর দিতে রাজি থাকো, তবে তোমরা নিরাপদ। আর যদি রাজি না থাকো তবে যুদ্ধ অনিবার্য ।” আলেকজান্দ্রিয়ার শাসক দেখলেন, মুসলিমরা সংখ্যায় কম। সেই তুলনায় তার দ্বিগুন সৈন্য রয়েছে। হযরত আমর (রাঃ) এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম সেনাবাহিনীর তেমন আধুনিক অস্ত্রও নেই। ভিন্ন দিকে তার বিপুল সংখ্যক সৈন্য আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। সেই সমীকরন শেষ করে, আলেকজান্দ্রিয়ার শাসক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত্ গ্রহণ করলেন। তিনি তার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসলেন। তার বাহিনী যখন তাঁবু স্থাপন করল তখন চারদিকে শুধুু আলেকজান্দ্রিয়ার সৈন্যদেরই তাঁবু দেখা যায়। ভিন্নদিকে সেই তুলনায় মুসলিমদের ক্যাম্প ছিল খুবই ছোট।

যুদ্ধ শুরুর প্রাককালে হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) তাঁর সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষন দিলেন। তিনি বললেন, ‘হে আমার প্রাণপ্রিয় মুজাহিদগন। তোমরা কি বিচলিত হয়েছো? শত্রু পক্ষের বিশাল বাহিনী দেখে তোমরা কি নিজেদেরকে দুর্বল বোধ করছ? তাহলে শুনে রাখো, যদি আল্লাহপাক আমাদেরকে সাহায্য না করেন তবে তাদের চেয়ে কয়েকগুন বেশি সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েও আমরা বিজয় আনতে পারবো না। আর যদি আল্লাহপাক আমাদেরকে সাহায্য করেন, এই সৈন্যই যথেষ্ঠ। আমরা আল্লাহর সাহায্যে এই সৈন্যদিয়েই বাতিল শক্তির মোকাবেলা করে বিজয় নিশ্চিত করতে পারবো ইনশা আল্লাহ। এরপর আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লেন। 

প্রথম অবস্থায় মুসলিম বাহিনী দারুন মার খেল। তারপর আমর ইবনুল আস (রাঃ) তাঁর বাহিনীকে পুনরায় উজ্জেবিত করে বীর বীক্রমে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লেন। মুসলিম সৈন্যদের এতো দৃঢ়চেতা মনোবল এবং সামরিক কৌশলের কাছে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকল আলেকজেন্দ্রীয়ার বাহিনী। এক সময় রাজা নিহত হলে বাকিসব সৈন্যরা দিকবেদিক পালিয়ে যায়। শহরে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রইল খৃষ্টান নারী,শিশু এবং খৃষ্টান পাদ্রীরা।

আলেকজান্দ্রীয়ার নারী শিশু এবং খৃষ্টান পাদ্রীরা ভাবল তাদের আর রক্ষে নেই। কারণ তারা বিগত সময়ে দেখেছে, পরাজিত জাতির সঙ্গে তাদের সেনাবাহিনী কি ভয়ানক আচরন করেছিল। তাদেরকে কচুকাঁটা করেছিল। মুসলিমরা হয়তো এইবার তাদেরকে কচু কাঁটা করবে। কিন্তু তাদের সকল ভয় এবং ভাবনা মিথ্যা প্রমানিত হল।

সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রাঃ) বললেন, নারী এবং শিশুরা নিরাপদ। তাদেরকে কেউ আঘাত করবে না। আর যারা আমাদেরকে জিজিয়া কর দিতে রাজি আছো তারাও নিরাপদ। সেনাপতির এই আদেশ আলেকজান্দ্রিয়ার মানুষরা নিজ কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা ইসলামের মহানুভবতা এবং মহত্ব দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। 
 


এরপর আমীরুল মুমেনীন হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) কে আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর নিয়োগ করেন। আমর ইবনুল আস (রাঃ) গভর্নর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করলেন। খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম নিজেদের মত করে পালন করার সুুযোগ পেল। এর মাঝে একদিন ঘটল বিপত্তি। রাতের আধারে কে বা কারা খৃষ্টান গির্জায় প্রবেশ করে, যীশুখৃষ্টের মূর্তির নাক ভেঙ্গে দিয়েছে। এই নাক ভাঙ্গার কারণে খৃষ্টান পাদ্রীরা ভিষণ নাখোশ হল। তারা গভর্নর আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর দরবারে অভিযোগ দায়ের করল। তারা হযরতের কাছে উপযুক্ত বিচার প্রার্থনা করল। গভর্নর হযরত আমর বললেন, আপনারা কি বিচার পেলে খুশি হবেন? খৃষ্টান পাদ্রীরা কিছুক্ষন ভেবে বলল, যেহেতু তোমরা আমাদের ধর্মীয় প্রধানের নাক ভেঙ্গে দিয়েছো। সেহেতু আমরাও তোমাদের রাসূল (সঃ) এর মূর্তি বানিয়ে তাঁর নাক ভেঙ্গে দিতে চাই। 



এই কথাশুনে, হযরত আমর তাঁর কোমরের কোশবদ্ধ তরবারিটি বের করে বললেন, খামোশ। তোমরা যে কথা উচ্চারণ করেছো, দ্বিতীয়বার সেই কথা উচ্চারণ করলে তোমাদের একজনেরও গর্দান থাকবে না। আমার প্রিয় রাসূল (সঃ) সারাটি জীবন এই মূর্তি এবং মূর্তিপূজারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। আর আজ কিনা তোমরা সেই রাসূলের মূর্তি বানাতে চাও। এটা সম্ভব নয়। তোমরা অন্য কিছু চাও! কিন্তু আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর এরূপ অগ্নিদৃষ্টি দেখে ভয়ে পাদ্রীরা আর কোন কথা বলতে পারছিল না। তখন হযরত আমর বললেন, তোমাদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ছিল আমার উপর। কিন্তু আমি তা ব্যবস্থা করতে ব্যার্থ হয়েছি। এই ব্যার্থতা আমার। তাই আগামী জুম্মাবার বড় মাঠে যদি আমার নাক কর্তন করা হয়, তবে কি তোমরা সন্তুষ্ট হবে? খৃষ্টান পাদ্রীরা সর্ব সম্মতভাবে মতামত দিল, হ্যাঁ! আমরা সন্তুষ্ট থাকবো। 

পরের জুম্মাবার! জুম্মার নামায পড়ে সবাই বড় মাঠে উপস্থিত হল। মাঠে একটি মঞ্চস্থাপন করা হয়েছিল। যেখানে হযরত গর্ভনরের নাক কর্তন করা হবে। হযরত আমর মঞ্চে উঠে নিজের তরবারিটি পাদ্রীর হাতে তুলে দিলেন। বললেন, এইবার আপনি আপনার প্রতিশোধ গ্রহণ করুন। ঠিক সেই মুহুর্তে উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একজন সিপাহী চিৎকার করে বললেন, মূর্তির নাক আমি ভেঙ্গেছি। তোমরা আমার গভর্নরের নাক কর্তন করবে না। আমি আসছি। আমাকে শাস্তি দাও। আমার নাক কর্তন কর। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত খৃষ্টান পাদ্রীরা হতভম্ব হয়ে গেল। হাতের তরবারিটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, কি উত্তম তোমাদের সেই রাসূল (সঃ) যিনি তোমাদেরকে এরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। কতই না উত্তম তোমাদের গভর্নর। আর কতই না মহৎ শিক্ষা তোমাদের ইসলাম তোমাদেরকে দান করেছে।

সুবহান আল্লাহ। মুসলিম শাসকদের প্রকৃত চেহারা ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর মতই। যার কারণে সেই মধ্যযুগেও রাষ্ট্রগুলোতে সুখ শান্তির অভাব ছিল না। কিন্তু আধুনিক এই যুগে, বিশ্বায়নের এই যুগে আমর ইবনুল আস (রাঃ) দের মত শাসকের বড়ই অভাব। হযরত আমরদের মত শাসক না থাকার কারণেই সারাবিশ্বে এতো অশান্তি। তাই আমি এমন একজন শাসকের স্বপ্ন দেখি, যিনি বিশ্বে শান্তি স্থাপন করতে পারবেন। তাই আমি স্বপ্ন দেখি, ‘এমন যদি হতো, আমার দেশের শাসক হতো, উমররেই মত হত, আবু বক্করের মত।

পঠিত : ৬৭২ বার

মন্তব্য: ০