Alapon

বিদেশী সাংবাদিকদের চোখে ১৯৭২--৭৫ এর বাংলাদেশ...


আলীমুদ্দিন ছাতা মেরামতের কাজ করে। এ সময়টা তার জন্য ব্যাস্ততার মৌসুম। রোজ বিকেলে বঙ্গোপসাগরের কালো মেঘ পদ্মার উপর দিয়ে ভেসে যায় , আর মানিকগঞ্জে মুষলধারে বৃষ্টি নামে।

শহরের প্রধান বাজারের রাস্তায় আলীমুদ্দিন এক পায়ের উপর আর এক পা আড়াআড়িভাবে রেখে বসে ছেঁড়া ছাতা সেলাই করে , জোড়াতালি দেয় এবং ছাতার শিক মেরামত করে। সাইড বিজনেস হিসাবে পুরান তালা মেরামত করে , পুরান চাবিও সরবরাহ করে।

এমন মৌসুমেও আলীমুদ্দিন ক্ষুধার্ত। বলল, "যেদিন বেশী কাজ মেলে, সেদিন এক বেলা ভাত খাই। যেদিন তেমন কাজ পাই না সেদিন ভাতের বদলে একটা চাপাতি খাই। আর এমন অনেক দিন যায় যপদিন কিছুই খেতে পাই না।"

তার দিকে এক নজর তাকালেই বুঝা যায় , সে সত্যি কথাই বলছে। সবুজ লুঙ্গির নীচে তার পা দুটিতে মাংস আছে বলে মনে হয় না। আলীমুদ্দিন যে ছাতা মেরামত করে , সেই ছাতার মতোই তার নিজের পাঁজর ও মেরুদণ্ড বের হয়ে আছে।

ঢাকার ৪০ মাইল উত্তরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জ। ১৫ হাজার লোকের বসতি। তাদের মধ্যে আলীমুদ্দিনের মতো আরো অনেক আছে। কোথাও একজন মোটা মানুষ চোখে পড়ে না। কালু বিশ্বাস বলল," আমাদের মেয়েরা লজ্জায় বের হয় না-তারা অর্ধনগ্ন।"

মানিকগঞ্জে এ অবস্থা কেনো? মানুষের খাবার নেই , কাপড় নেই। " মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে জিনিসপত্রের বেড়েই চলেছে। চাল-ডাল কেনার সামর্থ কারো নেই। সরকার বলেছিল আজাদীর পর সুদিন আসবে।

আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছে। আমি আমার এই পা হারিয়েছি। সরকার কিছুই করে নাই"--কথা গুলো বললো মনসুর আলী। মনসুর আলী একজন চাষী। বয়স পঁয়তাল্লিশ। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা হয়ে লড়েছে। একটা পা হারিয়েছে।

বাঁশের ক্র্যাচ ও লাঠির মাঝে দেহের সমতা রাখতে গিয়ে মনসুর আলীর হাত কাঁপছিল। ঘাড়ে ঝুলানো জীর্ণ থলি থেকে লাল সুতায় বাঁধা,শত হাতের ছোঁয়ায় বিবর্ণ একটা কাগজ বের করে দেখাল। শিরোনামায় লেখা রয়েছে " প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ ও ওয়েলফেয়ার ফান্ড "।

মনসুর আলী বলল , শহরের সরকারী কর্মচারীরা তাকে বলেছে, "এ ফান্ড থেকে টাকা পাওয়ার কথা ভুলে যাও।" সে অভিযোগ করলো, "আমি ভিক্ষুক নই , কিন্ত বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে খাবার ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছি। নইলে আমি মরে যাব।

আলীমুদ্দিনের কাহিনী গোটা মানিকগঞ্জের কাহিনী , বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের কাহিনী ,শত শত শহর-বন্দরের কাহিনী । এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে ৫০ লাখ টনেরও বেশী খাদ্যশস্য বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।কিন্ত যাদের জন্য পাঠানো হয়েছে তারাই পায়নি। খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব বেড়ে গেছে কিন্ত লোকের আয় বাড়েনি , বরং কমেছে।

আবদুল হাদীর মতো মধ্যবিত্ত লোকদেরও একই কাহিনী। হাদী স্থানীয় বাংলাদেশ কৃষি বাংকের একাউন্টেন্ট। মাসিক উপার্জন তার ১৬ পাউন্ডের সামান্য বেশী।হাদীর বয়স তিরিশ , বিবাহিত। তার তিনটি শিশু- সন্তান আছে।

ব্যাংকের সামনে কর্দমাক্ত রাস্তার ওপাশে একটি করোগেটেড টিনের শেডের এক অংশে হাদী সপরিবারে বাস করেন। খাওয়া-দাওয়া বাসা ভাড়া বাবদ যা খরচ হয় তা তার উপার্জনের দ্বিগুন। হাদী বললেন," এভাবে আর কতদিন চলবে জানি না।"

মানিকগঞ্জের প্রায় সকলের মতো হাদীও গত মার্চ মাসের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিলেন। কিন্ত এখন হাদী বলতে লাগলেন, " রেশনের দোকানেও কিছু পাওয়া যায় না ওদিকে সরকারী মহলে অর্থের একটানা অপব্যয় চলছে। আগামী নির্বাচনে যে কেউ ভাত-কাপড় দিতে পারবে তাকেই ভোট দেব।"

হাদীর হিসাব মতে মানিকগঞ্জে মুজিবের সমর্থন শতকরা ৬০ ভাগ কমে গেছে। বাংলাদেশে যে এতো বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী পাঠান হয়েছে,তার কি হলো? " কি হয়েছে তা সকলেই জানে। সব ভারতে পাচার হয়ে গেছে।"

হাদী জবাব দিলেন। সর্বত্রই শোনা যায় যে , প্রচুর পরিমান গম ও চাল ভারতে পাচার হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এই দশ মাস পর্যন্ত ধারনা করা হতো যে , স্হানীয় রাজনৈতিক চাইরা রিলিফের গম ও চাল আত্মসাৎ করে কালোবাজারে বিক্রি করেন। এখন এসব কালোবাজার পর্যন্ত পৌছায় না , পথেই উধাও হয়ে যায়।

বিদেশ থেকে যে খাদ্যশস্য আসে , তা চাটগাঁ বন্দরে তদারক করে জাতিসংঘের বাংলাদেশস্থ রিলিফ অফিস। যেই মাত্র জাহাজ থেকে খাদ্যশস্য , ময়দা , চিনি , রান্নার তেল ইত্যাদি নামানো হলো , অমনি তাদের তদারকি শেষ হয়ে গেল।

বলেন বিতরণ ব্যবস্থার কর্তৃত্ব বাংলাদেশ সরকারের হাতে। শেখ মুজিব অভ্যন্তরীণ বিলি-বন্টনে বিদেশীদের তদারকি বরদাশত করতে রাজি নন। যদিও বিতরণের সুবিধার জন্য জাতিসংঘই বাংলাদেশ সরকারকে ৭২৩টি লরী খয়রাত দিয়েছে। এসব লরীর কয়েকশ' ঢাকা ও চাটগাঁ রাস্তায় পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। অনেক রাজনীতিবিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ব্যাক্তিগত বাহন হিসেবেও সেগুলো ব্যবহার করছেন।

চাটগাঁয়ের গুদাম থেকে খাদ্যসামগ্রী দেশের অভ্যন্তরে নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা বন্দরে আনীত হয়। সেখান থেকে তা গরুর গাড়ী , লরী , ট্রেন ও ছোট ছোট নৌকায় করে স্থানীয় সরবরাহ ডিপোতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই পর্যায়েই বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। প্রাইভেট ডিলাররা তাদের বরাদ্দ ঠিকিই নেয় কিন্তু রেশনের দোকানগুলোতে সম্ভবতঃ অর্ধেক মাত্র সরবরাহ করে।খাতাপত্রে কিন্তু দেখায় যে পুরা সাপ্লাই দেয়া হয়েছে। বাদবাকী খাদ্যশস্য তারা সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেয়।

বিদেশ থেকে সাহায্যস্বরূপ যে চাল ও গম আসে,সরকার যা ক্রয় করেন এবং দেশে যা উৎপন্ন হয় , সব মিলে দেশের সকল মানুষের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার তিক্ততম পরিহাস যে , যাদের প্রয়োজন তারাই পায় না!
.
Ahmed Musa Belal

পঠিত : ১১২৫ বার

মন্তব্য: ০