Alapon

কতটুকু পথ সফর করলে কসর নামাজ আদায় করতে হবে?


বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় আমাদের প্রতিনিয়ত সফর করতে হয়। তাই সফর এবং কসরের শরীয়া বিধিবিধান আলোচনার দাবী রাখে।

কুরআন এবং হাদীসে সফরের সময় নামাজ কসর বা সংক্ষিপ্ত করার কথা স্পষ্ট উল্লেখ থাকলে কতটুকু দূরত্বে কসর আদায় করতে হবে এব্যাপারে কোন স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। ইসলামি চিন্তাবিদরা বিভিন্ন এনালাইসের মাধ্যমে একটি দূরত্ব নির্ধারনের চেষ্টা করেছেন। বেশিরভাগের মতামত হচ্ছে ৪৮ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করলে কসর নামাজ আদায় করতে হবে। এছাড়া আরো কিছু মতামত আছে। কিন্তু প্রতিটি সংখ্যা নির্ধারনী এনালাইসিসেই বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে।

কোরআন এবং হাদীসে সফর এবং কসরের কোন স্পেসিফিক বর্ননা না থাকায় স্কলাররা কয়েক ধাপে দুরত্ব নির্ধারনের চেষ্টা করেন। প্রথমে তারা সফর এবং সময়ের বর্ননাসংক্রান্ত হাদীস অনুসন্ধান করেন।সেখান থেকে তারা প্রাচীন আরবের সেই দুরত্বকে ধাপে ধাপে আধুনিক দুরত্বে পরিবর্তন করেন। আর সমস্যা হচ্ছে এই রুপান্তরের প্রতিটা ধাপেই রয়েছে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

হাদীসে উল্লেখ আছে, মহিলারা যেন কোন মাহরাম পুরুষ ব্যতীত ৩ দিনের বেশি সফর না করে। আবার ২ দিন, ১ দিনের বর্ননাও সহিহ হাদিসে আছে। এই হাদিসে কি কসরের কোন উল্লেখ আছে? নেই। শুধুমাত্র সফর এবং দূরত্ব উল্লেখ আছে। স্কলারটা এই হাদিসটিকেই কসরের দুরত্বের জন্য এনালাইসিস করে।
এখন বিভিন্ন স্কলার বা মাজহাব বিভিন্ন বর্ননাকে মূল ধরে তাদের গবেষনা চালায়। কেউ ১ দিন, কেউ ২ দিন আবার কেউ ৩ দিন। এখন ১ দিন মানে কতটুকু দূরত্ব? দুরত্ব পরিমাপের এই পদ্ধতি প্রাচীন আরবদের। সেখান থেকে এখন আধুনিক দুরত্ব পরিমাপক ইউনিটে রুপান্তর করতে হবে।

সাহাবীরা ১ দিনের দুরত্ব বলতে কি বুঝতো? ইসলামপূর্ব আরবে দূরত্ব পরিমাপক ইউনিটকে বলা হতো "বারিদ"। বারিদ বলতে বুঝায়,একজন ঘোড় আরোহী কোন বিশ্রাম ছাড়া গড়ে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। এখন ১ দিনের সফর কত বারিদ? এখানেও প্রায় ১৫ টি বিভিন্ন মত রয়েছে। কোন কোন সাহাবী এবং তাবিউন ৪ বা ৮ বারিদকে ১ দিনের সফর বলেছেন।

ফিকহ বইসমূহ যখন লেখা হয়, তখন কেউই বারিদ ব্যবহার করেনা। তখন দূরত্ব পরিমাপক হিসেবে "ফারসাখ" প্রচলিত। ফারসাখ হলো পার্সীয়ান শব্দ। এখন আবার বারিদকে ফারসাখে রুপান্তর করতে হবে। এখানেও প্রায় ৫ টি মত। বেশিরভাগের মতে ১ বারিদ সমান ৪ ফারসাখ।

এরপরে যখন পরবর্তী স্কলাররা আসলো, তখন ফারসাখও বিলুপ্ত। দুরত্ব পরিমাপক হিসেবে তখন ব্যবহার করে "মিল"। রোমানদের মাধ্যমে মিল দুরত্বের প্রচলন হয়। মিল এসেছে মিলিয়া থেকে যার অর্থ হচ্ছে হাজার। রোমান সৈন্যদের ১ হাজার পদ দূরত্বকে বলা হতো মিল। আরবরা রোমানদের মিল বা মাইল ব্যাবহার করলেও একই দুরত্ব বুঝাতো না। তাদের মাইল কিছুটা ছোট। কারন আরবদের পদ দুরত্ব রোমানদের পদ দূরত্ব থেকে কম। আবার তখন এক এক দেশে এক এক ধরনের মাইল। আধুনিক যুগেও জলপথের নটিক্যাল মাইল আর ভূমিপথের মাইল ভিন্ন।

এখন ১ আরব মাইল কতটুকু দূরত্ব? এখানেও বিভিন্ন মত। অনেকের মতে মিল হচ্ছে ১২০০০ আরব পদ দূরত্ব। কারো মতে মিল হচ্ছে খালি চোখে যতদুর দেখা যায়। আবার কারো মতে যত দূর থেকে মানুষকে দেখলে পুরুষ নাকি মহিলা সেটি বুঝা যায়না। এই রুপান্তরে কেউই নিশ্চিত না। এটি সায়েন্টিফিক কিছু না, অনুমান মাত্র।

নিউটন পরবর্তী জ্ঞান-বিজ্ঞান বিপ্লবের সময় যখন প্রথম রানী এলিজাবেথ আসলেন, তখন সংবিধানে দুরত্ব পরিমাপক নির্ধারক আইন পাশ করা হয়। সেখানে ১ মাইল সমান ৫২৮০ ফুট নির্ধারন করা হয় এবং ফুট বা অন্যান্য ইউনিট নির্ধারন করা হয়।

এখন পেছন ফিরে অধিকাংশ মতামত দেখি। ১ দিনের সফর (২,৩ দিনের হাদিসও আছে) সমান ৪ বারিদ (আরো অনেক মত আছে)। ৪ বারিদ সমান ১৬ ফারসাখ ( আরো মত আছে)। অনুমান করা হয়, ১ ফারসাখ সমান ৩ মাইল। তাহলে ১৬ ফারসাখ সমান ৪৮ মাইল। এই সেই ম্যাজিক্যাল ৪৮ মাইল!! ৪৮ মাইল সমান ৭২ কিলোমিটার।
এখন মহিলাদের সফর সংক্রান্ত একটি হাদিসকে কয়েকটি অনুমাননির্ভর ধাপে পরিবর্তন করে আধুনিক দুরত্বে রুপান্তর করে কসরের দূরত্ব নির্ধারন করা হলো। আর কসরের ফতোয়াতে সাধারনত এই দুরত্বকেই বর্ননা করা হয়।

সকল স্কলারদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, এর কোন ধাপই আল্লাহ ও রাসুলের থেকে নাজিলকৃত না। আবার এক এক মাজহাবে এক এক দুরত্ব। তবে আশার বিষয় হচ্ছে সব স্কলার এই বেশিরভাগ মতে একমত না। তাই এই ইস্যুতে আরো এনালাইসের সুযোগ আছে।

যারা এই ৪৮ মাইল বা নির্ধারিত দুরত্বের মতের বিরুদ্ধে, তাদের মধ্যে অন্যতম ইবনে তাইমিয়া। তার মতে সফর বা কসর কোন নির্দিষ্ট দুরত্ব দিয়ে নির্ধারিত না। এটি মানুষের ফ্রেম অব মাইন্ড। মানুষের নিজের বিবেকই নির্ধারন করবে সে সফরে আছে কি না।স্বাভাবিকভাবেই আমরা সফরের জন্য কিছু প্রস্তুতি নেই। আমাদের ব্যাগ গুছানো, আমাদের সফরের প্রস্তুতি আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি। এজন্য কোন মুফতিকে জিজ্ঞাসার প্রয়োজন নেই। যার যার সফর তার নিজের অবস্থা দিয়ে নিজেই নির্ধারন করবে। আর সেই অবস্থানুযায়ী কসর নামাজ আদায় করবে।

ইসলামে কসরের বিধান রাখা হয়েছে নামাজকে সহজ করার জন্য। সেখানে অনেক কিন্তুর মধ্য দিয়ে আসা নির্দিষ্ট দুরত্ব সেই উদ্যেশ্যকে ব্যাহত করে। তাহলে একজন মানুষকে সবসময় দুরত্ব পরিমাপক যন্ত্র নিয়ে ঘুরতে হবে যে তার ৪৮ মাইল হলো কি না। এতে যে সহজের জন্য কসরের বিধান রাখা হয়েছে, সেটি আরো জটিলতর হবে। আবার উটে বা প্রানীতে ৪৮ মাইলের সফর বিমানে ৪৮ মাইলের সফর থেকে ভিন্ন। জলে সফর স্থলে সফর থেকে ভিন্ন।

তাই অনেক স্কলারের মতো আমার মত হচ্ছে সফর এবং কসর কোন নির্ধারিত দুরত্ব না। আল্লাহ ও তার রাসুল কোন দুরত্ব নির্ধারন করেননি। সফর হচ্ছে ফ্রেম অব মাইন্ড। মানুষের মানষিক অবস্থা। আর সেই অবস্থার ভিত্তিতেই যে যার মতো কসর নামাজ আদায় করবে। আল্লাহু আলাম।

মূল : ড. ইয়াসির ক্বাদি
মূলভাব অনুবাদ : ড. এনামুল হক মনি

পঠিত : ১৫০৮ বার

মন্তব্য: ০