Alapon

করোনা ভাইরাস কি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আজাব?


সাহাবীদের সময়ে একবার মহামারি প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন অনেক সাহাবী। তার মধ্যে একজন ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী।

৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব রা:। প্লেগ দেখা দিয়েছিলো সিরিয়ায়-প্যালেস্টাইনে। ইতিহাসে যা ‘আম্মাউস প্লেগ’ নামে পরিচিত। উমর রা: সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। ‘সারগ’ নামক জায়গায় পৌছার পর সেনাপতি আবু উবাইদাহ রা: খলিফাকে জানালেন, সিরিয়ায় তো প্লেগ দেখা দিয়েছে।

উমর রা: প্রবীণ সাহাবীদেরকে পরামর্শের জন্য ডাকলেন। এখন কী করবো? সিরিয়ায় যাবো নাকি যাবো না? সাহাবীদের মধ্য থেকে দুটো মত আসলো। একদল বললেন, “আপনি যে উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন, সে উদ্দেশ্যে যান”। আরেকদল বললেন, “আপনার না যাওয়া উচিত”।

তারপর আনসার এবং মুহাজিরদের ডাকলেন পরামর্শ দেবার জন্য। তারাও মতপার্থক্য করলেন। সবশেষে বয়স্ক কুরাইশদের ডাকলেন। তারা এবার মতানৈক্য করলেন না। সবাই মত দিলেন- “আপনার প্রত্যাবর্তন করা উচিত। আপনার সঙ্গীদের প্লেগের দিকে ঠেলে দিবেন না।”

উমর রা: তাঁদের মত গ্রহণ করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মদীনায় ফিরে যাবেন। খলিফাকে মদীনায় ফিরে যেতে দেখে সেনাপতি আবু উবাইদাহ রা: বললেন, “আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন?”

আবু উবাইদাহর রা: কথা শুনে উমর রা: কষ্ট পেলেন। আবু উবাইদাহ রা: ছিলেন তাঁর এতো পছন্দের যে, আবু উবাইদাহ রা: এমন কথা বলতে পারেন উমর রা:সেটা ভাবেননি।

উমর রা: বললেন, “ও আবু উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলতো! আর হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি।”

আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের দিকে ফিরে যাওয়ার মানে কী? উমর রা: সেটা আবু উবাইদাহকে রা: বুঝিয়ে বলেন, “তুমি বলতো, তোমার কিছু উটকে তুমি এমন কোনো উপত্যকায় নিয়ে গেলে যেখানে দুটো মাঠ আছে। মাঠ দুটোর মধ্যে একটি মাঠ সবুজ শ্যামল, আরেক মাঠ শুষ্ক ও ধূসর। এবার বলো, ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, তুমি সবুজ মাঠে উট চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তা-ও আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো।”

অর্থাৎ, উমর রা: বলতে চাচ্ছেন, হাতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভালোটা গ্রহণ করা মানে এই না যে আল্লাহর তাকদীর থেকে পালিয়ে যাওয়া।

কিছুক্ষণ পর আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা: আসলেন। তিনি এতক্ষণ অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি এসে রাসূলু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদীস শুনালেন।

“তোমরা যখন কোনো এলাকায় প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেও না।” সহীহ বুখারীঃ ৫৭২৯

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসটি সমস্যার সমাধান করে দিলো। উমর রা: হাদীসটি শুনে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

মদীনায় ফিরে উমর রা: আবু উবাইদাহকে রা: চিঠি লিখলেন। “আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন। আমার এই চিঠিটি যদি রাতের বেলা আপনার কাছে পৌঁছে, তাহলে সকাল হবার পূর্বেই আপনি রওয়ানা দিবেন। আর চিঠিটি যদি সকাল বেলা পৌঁছে, তাহলে সন্ধ্যা হবার পূর্বের আপনি রওয়ানা দিবেন।”

চিঠিটা পড়ে আবু উবাইদাহ রা: বুঝতে পারলেন। খলিফা চাচ্ছেন তিনি যেন প্লেগে আক্রান্ত না হন। অথচ একই অভিযোগ তো তিনি উমরকে রা: করেছিলেন।

প্রতিউত্তরে আবু উবাইদাহ রা: লিখেন- “আমিরুল মুমিনিন! আমি তো আপনার প্রয়োজনটা বুঝতে পেরেছি। আমি তো মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে অবস্থান করছি। তাদের মধ্যে যে মুসিবত আপতিত হয়েছে, তা থেকে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে চাইনা, যতোক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেন। আমার চিঠিটি পাওয়ামাত্র আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে এখানে অবস্থানের অনুমতি দিন।”

চিঠিটি পড়ে উমর রা: ব্যাকুলভাবে কান্না করেন। তাঁর কান্না দেখে মুসলিমরা জিজ্ঞেস করলো, “আমিরুল মুমিনিন! আবু উবাইদাহ কি ইন্তেকাল করেছেন?” উমর রা: বললেন, “না, তবে তিনি মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে।” আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, আব্দুল মা’বুদ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪

কিছুদিন পর আবু উবাইদাহ রা: প্লেগে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হবার অল্পদিনের মধ্যেই শাহাদাতবরণ করেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “(প্লেগ) মহামারীতে মৃত্যু হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য শাহাদাত।” সহীহ বুখারীঃ ২৮৩০

আবু উবাইদাহ রা: ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী। আশারায়ে মুবাশশারার একজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর খলিফা নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলে আবু বকর রা: আবু উবাইদাহকে রা: প্রস্তাব করেন। উমর রা: ইন্তেকালের আগে কে পরবর্তী খলিফা হবেন এই প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, “যদি আবু উবাইদাহ বেঁচে থাকতেন, তাহলে কোনো কিছু না ভেবে তাঁকেই খলিফা বানাতাম।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্লেগ সম্পর্কে বলেন, “এটা হচ্ছে একটা আজাব। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের উপর ইচ্ছা তাদের উপর তা প্রেরণ করেন। তবে, আল্লাহ মুমিনদের জন্য তা রহমতস্বরূপ করে দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তি যদি প্লেগে আক্রান্ত জায়গায় সওয়াবের আশায় ধৈর্য ধরে অবস্থান করে এবং তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে, তাহলে সে একজন শহীদের সওয়াব পাবে।” সহীহ বুখারীঃ ৩৪৭৪

আবু উবাইদাহর রা: ইন্তেকালের পর সেনাপতি হন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরেক প্রিয় সাহাবী মু’আজ ইবনে জাবাল রা: সবাই তখন প্লেগের আতঙ্কে ভীত-সন্ত্রস্ত। নতুন সেনাপতি হবার পর মু’আজ রা: একটা ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেনঃ

“এই প্লেগ আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো মুসিবত নয় বরং তাঁর রহমত এবং নবীর দু’আ। হে আল্লাহ! এই রহমত আমার ঘরেও পাঠাও এবং আমাকেও এর যথেষ্ট অংশ দান করুন।” হায়াতুস সাহাবাঃ ২/৫৮২

দু’আ শেষে এসে দেখলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়পুত্র আব্দুর রহমান প্লেগাক্রান্ত হয়ে গেছেন। ছেলে বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে কুর’আনের ভাষায় বলেনঃ “আল-হাক্কু মির রাব্বিকা ফালা তাকুনান্না মিনাল মুমতারিন- সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং, তুমি কখনো সন্দেহ পোষণকারীর অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” সূরা বাকারাঃ ২:১৪৭

পুত্রের সান্ত্বনার জবাব পিতাও দেন কুর’আনের ভাষায়ঃ “সাতাজিদুনী ইন শা আল্লাহু মিনাস সাবিরীন- ইন শা আল্লাহ তুমি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবে।” সূরা আস-সাফফাতঃ ৩৭:১০২

কিছুদিনের মধ্যে তাঁর প্রিয়পুত্র প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শহীদ হন, তাঁর দুই স্ত্রী শহীদ হন। অবশেষে তাঁর হাতের একটা আঙ্গুলে ফোঁড়া বের হয়। এটা দেখে মু’আজ রা: প্রচন্দ খুশি হন। আনন্দে বলেন, “দুনিয়ার সকল সম্পদ এর তুলনায় মূল্যহীন।” অল্পদিনের মধ্যে তিনিও প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শহীদ হন। আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ৩/১৫১-১৫২

করোনা ভাইরাস অনেক জায়গায় মহামারি আকার ধারণ করেছে। সারাবিশ্বে এখন আলোচিত টপিক হলো করোনা ভাইরাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে ব্যস্ত। বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দর, স্টেশনগুলোতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কা’বা ঘরের তাওয়াফ সাময়িক স্থগিত রাখা হয়েছে (এখন খুলে দেওয়া হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ )। সবমিলিয়ে পুরো বিশ্ব একটা আতঙ্কের মধ্যে আছে। গতকাল আমাদের বাংলাদেশেও এই রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

ঠিক এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠছে- করোনা ভাইরাস কি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আজাব?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস থেকে দেখতে পাই, প্লেগকে তিনি বলেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব, আবার বলেছেন এটা মুমিনদের জন্য শর্তসাপেক্ষে রহমত। একই মহামারি ভাইরাস কারো জন্য হতে পারে আজাব, আবার কারো জন্য হতে পারে রহমত। তাই বলে, একে ঢালাওভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব কিংবা ঢালাওভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত বলার সুযোগ নেই।

মহামারি ভাইরাস যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব হয়ে থাকে, তাহলে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী আল্লাহর আজাবে ইন্তেকাল করেছেন? সাহাবীদের বেলায় আল্লাহ সাধারণভাবে ঘোষণা করেছেন- আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি। তাহলে সুহাইল ইবনে আমর, মু’আজ ইবনে জাবাল, ফদল ইবনে আব্বাস, ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান, আবু মালিক আশ’আরী রা: সাহাবীগণ আল্লাহর আজাবে নিপতিত হয়েছেন?

উত্তর হচ্ছে- না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস অনুযায়ী ঐ মহামারিকে তারা রহমত হিশেবে নিয়েছিলেন। মহামারিতে মৃত্যুবরণ করাকে তারা শাহাদাত হিশেবে দেখেছেন। যার ফলে মু’আজ ইননে জাবাল রা: সেই রহমত পাবার জন্য দু’আ পর্যন্ত করেন।

মহামারি থেকে বাঁচার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করবো, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী চলবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্লেগের ব্যাপারে প্রথমে সতর্ক করেন- যেসব জায়গায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেসব জায়গায় যাবে না। তারপর বলেছেন, যেখানে আছো সেখানে প্লেগ দেখা দিলে অন্যত্র যাবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস, উমরের রা: আমল থেকে দেখতে পাই- মহামারির বেলায় প্রতিরক্ষার দিকে সতর্ক হবার শিক্ষা।

আবার অন্যন্য সাহাবীরা যখন প্লেগে আক্রান্ত হয়েছেন, তখন ধৈর্যধারণ করে, রহমত মনে করে আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নিয়েছেন। যার প্রতিদানস্বরূপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস অনুযায়ী তাঁদের মৃত্যু হলো- শাহাদাতবরণ।

করোনার ব্যাপারে যথাযথ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার , আল্লাহর কাছে দু’আ করবো, নিজেদের গুনাহের জন্য মাফ চাইবো। তারপরও যদি আল্লাহ না করুক, করোনায়-আক্রান্ত হই তাহলে ধৈর্য ধরবো।

আল্লাহর হুকুমের উপর সন্তুষ্ট হবো এবং শাহাদাতের পেয়ালাপানে উন্মুখ থাকবো। আল মাহমুদের মতো বলবো ‘ভালো মন্দ যা কিছু ঘটুক, মেনে নেবো এ আমার ঈদ’। কারন

আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরন, সব বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। সূরা আল আনাম: ১৬২

আল্লাহ বাংলাদেশকে এই বিপদ থেকে হেফাজত করুক। বিশ্বমানবতাকে এই মহামারি থেকে মুক্তি দিক।

পঠিত : ৮৭৬ বার

মন্তব্য: ০