Alapon

দিল্লিতে পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় মুসলিম নিধনযজ্ঞ



সরকারি বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পৈশাচিক মুসলিম নিধনযজ্ঞে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্ববাসী। চারদিনের টানা সহিংসতায় মুসলিমদের ঘর-বাড়ি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মসজিদ, মাদ্রাসা পর্যন্ত পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা। কোথাও কোথাও অ্যাসিড হামলা চালিয়ে অনেককে অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ওই সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৪৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে এখনো দিল্লির অলিগলি, নালা নর্দমা থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন কয়েকশ মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কয়েক দশকের মধ্যে দিল্লির বুকে এমন ভয়ঙ্কর হামলা আর হয়নি। থমথমে দিল্লিতে এখনো বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন ভীতসন্ত্রস্ত মুসলিমরা।

পুলিশ প্রশাসন, সরকার বা রাজনীতিকদের আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না তারা। কারণ, সহিংসতার সময় এরা সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি খোদ পুলিশই দিল্লির মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে কারফিউ জারি করা হয়েছে। তারপরেও মুসলিমদের আতঙ্ক কাটছে না। এই আতঙ্কের দুই কারণ, দাঙ্গার সময় পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা আর ক্ষমতাসীনদের নীরবতা। জ্বলন্ত বাড়িঘর ফেলে তাড়া খাওয়া মানুষ সহায়তার আর্তি জানিয়ে মিনিটে চারটি করে ফোন করেছে দিল্লির পুলিশকে। কিন্তু তখনো পুলিশ কিছু করেছে বলে মনে করে না আক্রান্ত মানুষ। রাজনীতিকদের নীরবতা ছিল আরও ভয়ানক। রাজধানীর একাংশ যখন জ্বলছে-পুড়ছে, লম্বা হচ্ছে লাশের সারি, তখনো দিনের পর দিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ততক্ষণে গুজরাট দাঙ্গার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে দিল্লিতে। ২০০২ সালের ওই দাঙ্গার সময় ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি, আজ তিনি দিল্লির ক্ষমতায়। আর সেখানেই দাঙ্গা। কথায় কথায় টুইট করেন যে মোদি, তিন দিন ধরে সেখানেও লিখেননি একটা লাইন। তিন দিনের উন্মত্ত দাঙ্গায় রাজধানীর এক পাশ যখন মৃত্যুপুরী, তখন মুখ খুললেন তিনি। শুধু বললেন ‘দিল্লির ভাইবোনদের’ শান্ত থাকতে। কিন্তু যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনকে (এনআরসি) ঘিরে বিক্ষোভ-সংঘর্ষ থেকে এ দাঙ্গা, তা নিয়ে একটা শব্দও বের হলো না তার মুখ থেকে।

দাঙ্গার সময় সকাল-বিকেল একের পর এক বৈঠক করেছেন মোদির ডান হাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু তিনিও তখন মুখ খোলেননি। উল্টো দাঙ্গার জন্য দোষ চাপিয়েছেন বিরোধী দলগুলোর ওপর। ওডিশার ভুবনেশ্বরে সিএএপন্থীদের এক সমাবেশে অমিত শাহ বলেছেন, ‘বিরোধী দলগুলো ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তারা বলছে, সিএএ-এর ফলে মুসলিমরা নাগরিকত্ব হারাবে। তারা মানুষকে খ্যাপাচ্ছে, দাঙ্গা বাধাতে উস্কানি দিচ্ছে।’

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলও উপদ্রুত এলাকায় ঘুরে মানুষকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করেছে। দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্টজন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাদের আশঙ্কা ভারতের সহিংসতা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দিল্লিতে জারি হয়েছে ‘শ্যুট অ্যাট সাইট’ (দেখা মাত্র গুলি)-এর অর্ডার। এমনকি কেউ উস্কানিমূলক মন্তব্য করলেই তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের পাশাপাশি সিআরপিএফ, এসএসবি, সিআইএসএফ এবং পুলিশের যৌথ বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের এমন সহিংসতার জন্য সবাই অমিত ও মোদিকে দায়ী করছেন। এদিকে দিল্লির সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। দিল্লিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

থমথমে দিল্লিজুড়ে এখনো আতঙ্ক
দিল্লিতে গত কয়েক দশকের মধ্যে হওয়া ভয়াবহতম সহিংসতার পর এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে সব থেকে বেশি সংঘর্ষ হওয়া বাবরপুর, জাফরাবাদ ও মৌজপুর এলাকায়। পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত শান্ত হলেও আতঙ্ক কাটছে না দিল্লির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অংশের বাসিন্দাদের। রাজধানীর অংশ হলেও বেশ কয়েকটি এলাকা পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে নগরীতে। অন্তত ৩০০০ বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে এসব এলাকায়। আধপোড়া বাড়িগুলো ভয়াবহ এ দাঙ্গার সাক্ষী হয়ে আছে কিন্তু তাতে নেই কোনো বাসিন্দা। ফাঁকা হয়ে আছে দোকান, কারখানা আর বসতবাড়িগুলো। কয়েকজন আছেন পাহারা দিচ্ছেন যাতে লুটপাট না চলতে পারে। তবে কার্যত সেখানে লুণ্ঠন চলছে বলে অভিযোগ পাহারায় থাকা অনেকের। বলছেন, এখনো পুলিশ নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনকি যখন গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে দাঙ্গাকারীরা একের পর এক বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল তখনো পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। রাতে আগুন লাগাতে আসতে পারে এই ভয়ে গত ক’দিন ধরে ঘুমাতে পারছেন না তারা। গত কয়েক দিনের সহিংসতার সঙ্গে কারা জড়িত তা তদন্ত করতে দুটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ড, ভাঙচুরসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অপরাধে এখন পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছে ৪৮টি এফআইআর। এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল ও কাদের উস্কানিতেই দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা খুঁজে বের করতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, দিল্লির প্রশাসন ও পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। আগামী ৩০শে এপ্রিল এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে নতুন করে দায়ের হওয়া আরও তিনটি পিটিশনের শুনানি হয়েছে দিল্লি হাইকোর্টে। ওই মামলায় দিল্লি পুলিশ, দিল্লি সরকার ও কেন্দ্রকে নোটিশ পাঠিয়েছে আদালত। নতুন দায়ের হওয়া পিটিশনের একটিতে বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ও আসাদুদ্দিন ওয়াইসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আর্জি জানানো হয়েছে। সহিংসতায় উস্কানিমূলক মন্তব্যের অভিযোগেই তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরের আবেদন জমা পড়ে।

যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা
ঘটনার সূত্রপাত ২২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকেই। জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের কাছে শাহিনবাগের আদলে কয়েকশো মহিলা সেই দিন সিএএর বিরুদ্ধে ধরনায় বসেন। ওই অবস্থান বিক্ষোভের কারণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ওই রাস্তা। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের কাছে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন করা সত্ত্বেও তাতে কোনও ফল মেলেনি।

ওই বিক্ষোভ চলাকালীন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র পথ অবরোধের বিরুদ্ধে একটি ভিডিও পোস্ট করে সিএএ সমর্থকদের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টা নাগাদ মৌজপুর চৌকে আসতে বলেন। এরপরেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ জাফরাবাদ এলাকায় সিএএ বিরোধী এবং সিএএ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। দু’পক্ষের থেকেই একে অপরকে লক্ষ্য করে শুরু হয় পাথর ছোড়া। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়ে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে হয় পুলিশকে।

সন্ধ্যে নাগাদ কপিল মিশ্র আরও একটি ভিডিও টুইট করেন, যেখানে তাকে উত্তর-পূর্ব দিল্লির ডিসিপি ভিসি প্রকাশের সঙ্গে দেখা যায়। কপিল হুমকি দিয়ে বলেন যে তিনি এবং তার সমর্থকরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন এবং তিনি চলে যাওয়ার পরও দিল্লি পুলিশের কোনও নিষেধ শুনবেন না তারা। সিএএ বিরোধীরা যে রাস্তা আটকে রেখেছেন তা যেনতেন প্রকারের খোলার ব্যবস্থা করবেন তিনি। এরপর রাতে প্রকাশিত আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ কিছু লোক ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে একটি ট্রাকে করে ইট বয়ে নিয়ে চলেছে। পরের দিন সকাল থেকেই ওই অঞ্চলগুলোর পরিস্থিতি উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক হিংসা। মৌজপুরে এক ব্যক্তিকে পুলিশের সামনেই গুলি চালাতে দেখা যায়। তার ছবি ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। এই ঘটনার পর থেকেই ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয় গোটা এলাকা জুড়ে।

দিল্লির মসজিদে আগুন দেয় পুলিশ
দিল্লিতে মসজিদে মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে বহু বাড়ি-ঘর এবং দোকান-পাটেও হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। দিল্লির সহিংসতায় দুর্বৃত্তদের সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতা বন্ধের চেষ্টা না করে উন্মত্ত জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে জয় শ্রী রাম বলে স্লোগান দিচ্ছিল পুলিশ। একই সঙ্গে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তারা। ফারুকিয়া নামের একটি ছোট মসজিদের দেখাশুনা করেন মোহাম্মদ আব্বাস (৮৫)। তিনি জানিয়েছেন, বিকালে নামাজের পর একদল পুলিশ কর্মকর্তা মসজিদের ইমাম এবং তার ওপর হামলা চালায়। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা তাকে দেশদ্রোহী বলে গালাগালি দিচ্ছিল। তার চোখের সামনেই ওই পুলিশ সদস্যরা মসজিদ ভাংচুর করেছেন এবং আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। এরপরেই সেখান থেকে মোহাম্মদ আব্বাসকে একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সে সময় তার সারা শরীর রক্তাক্ত ছিল। তিনি বলেন, তারা আমাকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। আমার হাত ভেঙে গেছে।

চার বিজেপি নেতা শনাক্ত
দাঙ্গায় বিজেপি নেতাদের উস্কানির ভিডিও জমা হয়েছে হাইকোর্টে। ভিডিও দেখার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ইতিমধ্যে চার বিজেপি নেতাকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের উস্কানিমূলক বক্তব্যের ভিডিও দেখেছেন দিল্লির আদালত। ওই চার ব্যক্তি ছাড়া যারা উস্কানি দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। যে চার নেতার বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা হলেন, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, অভয় বার্মা ও পরবেশ ভার্মা।

পঠিত : ৬২৫ বার

মন্তব্য: ০