Alapon

ক্রসেড ও মুসলিম দুনিয়ার নিয়তি...


মুসলিম ও ইউরোপিয় সভ্যতার নিয়তি নির্ধারনে ক্রৃসেড (১০৯৫-১৪৯২) ঐতিহাসিক এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ক্রুসেড বিজয় মুসলিম সভ্যতার জন্য আপাত গৌরবের কারণ হলেও এই বিজয় দীর্ঘমেয়াদে মুসলমানদের পশ্চাদপদতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে ক্রুসেডে পরাজয় ইউরোপিয় সভ্যতার জন্য আপাত গৌরবহানিকর হলেও, এই পরাজয় ইউরোপকে দিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার নতুন দিশা।

ক্রুসেডে দুই প্রতিপক্ষই লড়াই করেছে ধর্মের নামে। দুই প্রতিপক্ষই যার যার 'সত্য দ্বীন' প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ ছিলো। যার যার পক্ষে যোদ্ধাদের ধর্মের বাণী দিয়ে উজ্জিবিত করেছিলো ওলামা ও যাযকরা। উভয় পক্ষের দাবি ছিলো ঈশ্বরের সহায় তাদের সাথে আছে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় দুই পক্ষই বিজয়ের আশা করেছিলো। ধর্মবাদিতার চরমে পৌঁছে গিয়েছিলো ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য। এইরকম পরিস্থিতি দর্শন-বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত সময় নয়। বরং ধর্মবাদিতার প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠার মোক্ষম সময়।

ইসলামের আশায়ারি ঘরাণার উদ্ভব ঠিক এই সময়েই। ইমাম গাজ্জালির হাত ধরে এই ধারা মুসলিম দুনিয়ায় প্রভাব ও প্রতাপ বিস্তার করে। রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কোনো ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মব্যক্ষা ইতিহাসে খুব সামন্যই প্রভাব রেখে যায়। ইউরোপে প্রটেস্টাণ্ট মুভমেন্টের সমান্তরাল ধর্মব্যাখ্যা আগেও এসেছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক সমর্থনের অভাবে মেইনস্ট্রীম ক্যাথলিকদের পীড়নে সেইসব টিকতে পারে নাই। কিন্তু প্রটেস্টাণ্ট মুভমেন্ট সমর্থন পেয়েছিলো যাযকতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হইতে চাওয়া ইউরোপিয় প্রিন্সদের কাছ থেকে।

ইমাম গাজ্জালির দর্শন ও বিজ্ঞান বিরোধী চিন্তাধারা তৎকালিন রাজনৈতিক অবস্থার সমর্থন পেয়েছিলো। ধর্মযুদ্ধের ডামাঢোলে মুসলমানদের যে স্পিরিট জরুরি ছিলো সেইটা আশায়ারি ঘরণা সরবরাহ করতে পেরেছিলো। মুসলমানদের যুদ্ধজয়ে আশায়ারি ঘরণা ছিলো আধ্যাত্বিক প্রেরণার উৎস।

যুদ্ধ বিজয়ে মুসলমানদের মধ্যে ইতোমধ্যে উল্থান হওয়া ধর্মবাদিতা আরো শক্তি অর্জন করতে থাকে। কারন মুসলমানদের এই বিশ্বাস গভীরতর হয় যে আল্লাহ তাদের সহায় ছিলেন কারন তাদের দ্বীনই সত্য। পিছিয়ে পড়তে থাকে বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চা। দার্শনিক ও বিজ্ঞানিদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে আলেমরা যাদের জ্ঞান কোরান, হাদিস, ফিক্বাহর মধ্যে সীমিত।

ক্রুসেড পরবর্তী সময়ে এই ধর্মবাদিতা আরো প্রকট হতে থাকে। মুসলমানদের ইসলাম চিন্তা একটা ঘেরাটোপে আটকে যায়। ইসলামের নতুন কোনো ইন্টারপ্রেটেশন গৃহিত হয়নি মুসলিম সমাজে। কারন অক্ষরবাদি আলেমদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা যেকোনো নতুন ইসলাম চিন্তাকে বাতিল ও ভ্রান্ত বলে খারিজ করে দিয়েছে।

মুসলিম সমাজ জীবন যাপনের দিক দিয়ে যতো আধুনিক হোক না কেনো ইসলাম চিন্তায় এরা অক্ষরবাদি আলেম সমাজের প্রভাব অতিক্রম করতে পারে না। ফলে ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ বা ইবনে খলদুনের চিন্তা মুসলিম দুনিয়ায় ডমিনেন্ট হয়ে উঠে নাই। কিন্তু মাজহাবি ইমামগণ ইসলাম চিন্তার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন।

পক্ষান্তরে যুদ্ধে পরাজয় ইউরোপীয় খ্রীস্চানদের ধর্ম নিয়া নতুন করে ভাবতে শেখায়। যে ঈশ্বর সহায় হবেন বলে যাজকরা প্রচার করেছিলো, সেই ঈশ্বর কতটা সহায় হয়েছেন তা নিয়ে তারা সংশয়গ্রস্থ হয়েছে। ফলে দুনিয়া বিষয়ে ইউরোপ প্রেগমেটিক হয়ে উঠে। ইতিহাস বোঝাপড়ায় বস্তুবাদী ধারা বিকশিত হয়। ধর্মবাদিরা রাজনীতিতে প্রত্যাখ্যাত হয়। ততদিনে মুসলিম দুনিয়া থেকে দর্শন ও বিজ্ঞান পৌঁছে গিয়েছিলো ইউরোপে।

এই ধারাবাহিকতায়, যাজকদের চেয়ে দার্শনিক ও বিজ্ঞানিরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। নতুন জ্ঞানের চর্চা ইউরোপে নতুন জাগরণ নিয়ে আসে। নব নব আবিষ্কারে, নব নব দার্শনিক বয়ানে ইউরোপ এগিয়ে যেতে থাকে। দুনিয়ার নেতৃত্ব ধীরে ধীরে তাদের হাতে এসে যায়।

@Mokarrom

পঠিত : ৬৫৬ বার

মন্তব্য: ০