Alapon

করোনা আতঙ্ক, বিপদে তাওয়াক্কুল ও মসজিদের দরজায় তালা...


করোনার এই বিপদের মধ্য সবচেয়ে বেশী আলোচনার বিষয় হচ্ছে তাওয়াক্কুল। এটা আরবি শব্দ যার আভিধানিক বাংলা হল 'ভরসা'। বিপদের দিনে সঠিক-বেঠিক সিদ্ধান্তহীনতায় মানুষ দুদোল্যমান হয়ে পড়ে। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন হয়ে উঠে। মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। অনেকে নিজের দৃঢ়তায় অটল থাকতে পারেনা। বেশীর ভাগ মানুষ হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের সর্বনাশ করে। প্রতিটি মানুষের জীবনে এ ধরণের ক্রান্তিকাল মোকাবেলা করতে হয়। যারা মুসলিম, তাদেরকে কোরআন-হাদিসে এ ধরণের সমস্যা মোকাবেলার জন্য গাইড লাইন দেওয়া আছে। অতীত ইতিহাসের বহু নবীদের দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছে। লক্ষ্য একটাই বিপদ কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে। বিপদ মোকাবেলার অর্থ এই নয় যে, তিনি এই বিপদ জয় করতে পারবেন। এখানে জয়-পরাজয় দুটোই ঘটতে পারে। নবীদের জীবনেও এমনটা ঘটেছে। তাই মানুষ নিজের বিবেক, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, জ্ঞান, দূরদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে তার কি করা উচিত। তারপর ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে আল্লাহর উপর আস্থাশীল হবার ঘোষণা দিবে এবং শেষ পর্যন্ত এটার উপরই সে একনিষ্ঠ ভাবে বহাল থাকবে। এটার নামই তাওয়াক্কুল।

মূলত তাওয়াক্কুল একটা নিয়তের নাম হলেও কার্যকরণ নিজের হাতেই বাস্তবায়ন করতে হয়। আসমান থেকে আল্লাহ করে দিবেন ব্যাপারটা সে ধরণের নয়। অনেকে এই জায়গায় এসে ভুল করে আল্লাহর সমালোচনা করার সুযোগ নেয়। দেখুন বাংলা ভাষায় আমরা কখনও বলে থাকি এভাবে, "আমি একটা ব্যবসায়ে নামতে চাচ্ছি, পুরো ক্যাপিটালটাই ওখানে চলে যাবে। মার খেলে তো সর্বস্বান্ত হয়ে যাব, জিতলে তো আমি রাজা। আপনি যদি একটু ভরসা, নির্ভরতা দেন তাহলে কাজটা শুরু করতে পারি।" এই ধরণের কথাবার্তা জগত সংসারে আমরা হরহামেশা করে থাকি। মূলত এটাই তাওয়াক্কুল।

সারাদেশের করোনা সংক্রান্ত বিপদ। মধ্য প্রাচ্য সহ বহু দেশেই মসজিদের নামাজ না পড়ে, ঘরে পড়ার আহবান করা হচ্ছে। সরকারের হাতে এসবের চাবিকাঠি বলেই সকল মসজিদ এখানে বন্ধ। তবে সকল মসজিদে রীতিমত আজান হচ্ছে। সে আজান শুনেই আমাদের কর্মব্যস্ততা আগের মতই চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এটা নিয়ে রীতিমত মানুষ পেরেশান। সাধারণ মুসলমানদের কেউ ভাবছেন যেহেতু এটা আল্লাহ প্রদত্ত একটি পরীক্ষা, তাই এই পরীক্ষা মোকাবেলা করেই উৎরাতে হবে। এটাই ইমানের দাবী। আর যারা মসজিদে যাচ্ছেন না তারা দুর্বল ইমানদার অধিকন্তু তারা বে-নামাজি হিসেবে গণ্য হবে। তাই করোনাকে পরোয়া না করে আল্লাহকে ভয় করে ও তার উপর ভরসা করে, অনেক মানুষ মসজিদে যাচ্ছে। জামায়াত কায়েম করছে, দোয়া মাহফিলের ব্যবস্থা করছে, সবাইকে মসজিদে গিয়ে জামায়াত করার উৎসাহ দিচ্ছে। এটাকেই অনেকে তাওয়াক্কুল মনে করছেন। আসলে এটা তো তাওয়াক্কুল নয় বরং আল্লাহকে উল্টো পরীক্ষা করার সমতুল্য। ইসলামী কিছু মৌলিক নীতিমালা আছে, যেমন "সৃষ্টির অংশ হয়ে কখনও স্রষ্টাকে পরীক্ষা করা যাবে না। কোন শর্তারোপ করা যাবে না। শর্ত সাপেক্ষে এবাদত করা যাবে না।" মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক সোজা-পরিষ্কার। হ্যাঁ কিংবা না। কেননা আল্লাহর কাছে বান্দা না হলেও চলবে কিন্তু বান্দার জন্য আল্লাহকে চাই। তাই আল্লাহর মতিগতি বুঝার জন্য কোন এবাদত চলে না। মানুষ কোন পূর্বশর্ত ব্যতিরেকে আল্লাহর গোলামী করবে। এটাই একমাত্র চুক্তি। ব্যাপারটি বুঝার জন্য নিচের ঘটনাটি অনুধাবন করা যায়।

বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে এক অঞ্চল। যে যার মত করে দলে দলে মানুষ পালাচ্ছে। এক বুজুর্গ সুযোগ পেয়েও না পালিয়ে তার ঘরে বসে রইল। পানিতে যখন ভূমি তলিয়ে গেল, তখন সে চিন্তা করল, আমিতো আল্লাহকে ভালবাসি, নিশ্চয়ই তিনি আমাকেও ভালবেসে থাকবেন। তাই খোদায়ী সাহায্য আসমান থেকে না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই দাড়িয়ে থাকব। হাঁটু পরিমাণ পানি হলে এক ব্যক্তি ভেলা নিয়ে এল তাকে উদ্ধার করতে। বুজুর্গ বলল, সে তার ভেলায় উঠবে না, কেননা সে আল্লাহর সাহায্যের জন্য অপেক্ষায় আছে। কোমর পরিমাণ পানি হলে আরেক ব্যক্তি নৌকা নিয়ে এসে তাকে তুলতে চাইল। যথারীতি তিনি তাকেও একই উত্তর দিল। বুক পরিমাণ পানি হলে এক ব্যক্তি বিরাটকায় এক পাতিলে চড়ে তথায় আসল। তাকে টেনে তুলতে চাইল! না তিনি যথারীতি একই কথা বলে তাকেও ফিরিয়ে দিল, মানুষটি অবশেষে পানিতে ঢুবে মারা গেল। মৃত্যুর পরে ফেরেশতারা তাকে প্রশ্ন করল কিসে তাকে প্রতারিত হতে সাহায্য করল? সে উত্তর দিল, আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তার সাহায্যের আশায় অপেক্ষায় ছিলাম! তখন ফেরেশতারা বলল, "সে জন্যই তো আল্লাহ তোমার জন্য তিন তিন বার উদ্ধারকারী পাঠিয়েছিল"!

আল্লাহর সাহায্যের ধরণ বুঝতে সাধারণ মানুষের অক্ষম! এমনকি নবী-রাসুলদের কাছে আসমানি বাণী পৌছার পরও ফেরেশতা দিয়ে ডেমোনেষ্ট্রেশণের ব্যবস্থা করা লাগে। সাধারণ মানুষ সে সব বুঝব কিভাবে? যেখানে সে তার নিজের স্বপ্নের মর্মবাণীও বুঝতে পারেনা! তাই আমাদের আজ সতর্ক হতে হবে এই মর্মে যে, আমি এবাদতের কথা বলে, মসজিদে গিয়ে আরো মানুষকে আমার ভাইরাস ছড়িয়ে দিলাম। এ জন্য আমাকে পাকড়াও করা হবে। ওয়াজ নসিহতের কথা বলতে গিয়ে, তা শুনতে গিয়ে একটি সমাজের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে আসলাম, এটার নাম তাওয়াক্কুল নয়। এটা হল মানুষের সাথে শত্রুতা এবং নিজের কর্মকাণ্ডের অজ্ঞতা। কোন ঘোষণায় কোথাও নামাজ পড়তে নিষেধ করা হয়নি বরং নামাজের জামায়াত আমরা ঘরে বসে মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র, স্বজন নিয়ে পড়তে পারি। ঘরকে আলোকিত করতে পারি। এটাও তো একটা ব্যতিক্রমী সুযোগ।

আমরা যাতে বাস্তবতাকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করি এবং ধর্মীয় জ্ঞানকে ভাষা দৃষ্টিতে চিন্তা না করে গভীরে যাবার চেষ্টা করি। আমরা যেন বুঝতে চেষ্টা করি, আল্লাহর কাছে তার একজন বান্দার মূল্য, মসজিদের চেয়েও বেশী। তিনি তার বান্দাদের খুবই ভালবাসেন। সেখানে যদি নিজেদের অদূরদর্শিতার কারণে নিজেরা তো মরলাম কিন্তু তার সাথে হাজারে মানুষকে ঢুবিয়ে গেলাম। এটা কোনভাবেই তাওয়াক্কুল হয়না বরং বিরাট গুনাহের কাজ। রোগের প্রসার ঘটাতে দুনিয়াতে ইসলাম আসেনি। সারা দেশ যখন বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়, মসজিদে হাঁটু পানি ঢুকে, তখন মসজিদ গুলোতে আজান-নামাজ বন্ধ হয়ে যায়। নিজের বিবেক কে প্রশ্ন করুন তো, আমি কিংবা আপনি সেদিনের এই দৃশ্য দেখে, আজকের মত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলাম কিনা। এই প্রশ্ন আল্লাহ করতে পারেন।

তাই আসুন মানবতার কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়ি। নিজেদের পরিশুদ্ধ করি। অন্যের জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করার অভ্যাস গড়ে তুলি। কোন ভাবে করোনা দ্বারা আমি অসুস্থ হয়ে গেলেও আমার দ্বারা যাতে কেউ সংক্রমিত না হয় সেটাই মুসলিমের চরিত্র হওয়া উচিত। মুমিনের অন্যতম চরিত্রের একটি হল, তার, হাত, মুখ দ্বারা অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। একই ভাবে তার খাসিয়ত, রুচি, আচরণ থেকেও অন্যরা নিরাপদ থাকবে। তাহলে জীবন সার্থক হবে।

পঠিত : ৩৮৬ বার

মন্তব্য: ০