Alapon

ভালোবাসার দাস...


ভালোবাসার মানুষকে ‘অতিরিক্ত’ ভালোবাসার ফলে মানুষ তার উপাসনা শুরু করে। হবার কথা ছিলো সে তার প্রেমিক, হয়ে যায় সে তার প্রভু। সেই মানুষটা তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, তাকে ঘিরেই তার জীবনটা ‘তাওয়াফ’ করে।

প্রেমিক যুগল বা দম্পতির মধ্যকার এমন ভালোবাসাকে খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তার কবিতার দুটো লাইন প্রায় সময়ই ফেসবুকে ঘুরতে দেখি। স্বামী স্ত্রীকে ট্যাগ করে বা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডকে ট্যাগ করে পোস্ট করে।

“তোমার হাতে বন্দী আমার ভালোবাসার কাশ,
তাই তো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস।”

পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অতিরিক্ত ভালোবাসাকে ‘উপাসনা’ বলছি, এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? কিংবা, কবিতার লাইন কি মানুষ আক্ষরিকভাবে নেয়? প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। তারপর চেক করবো, আমি-আপনি আসলেই কোনো ব্যক্তির বা বস্তুর ‘দাস’ কি-না।

‘প্রেম হারাম’ এই আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হলো ‘প্রেম শিরক কি-না?’ এই প্রেম-ভালোবাসা যে শুধুমাত্র অবিবাহিত প্রেমিক যুগলের মধ্যকার ভালোবাসা, এমন না; এটা হতে পারে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তানের জন্য ভালোবাসা, পিতা-মাতার জন্য ভালোবাসা, সম্পদের জন্য ভালোবাসা।

খুব সাধারণভাবে, মানুষ যাকে ভালোবাসা, সে তার আনুগত্য করে। সে হয় মুখে বলে অথবা মনে মনে ধরে নেয়- তুমি যা বলবে, আমি সব মানবো, সব শুনবো। একটা পর্যায় পর্যন্ত এই আনুগত্যটা থাকা দরকার, প্রয়োজনও বটে। কিন্তু আনুগত্যটা যখন সীমাতিক্রম করে তখন সমস্যার সূচনা ঘটে।

ভালোবাসার মানুষের জন্য মানুষ মন উজাড় করে দেয়। তার মনোরঞ্জনের জন্য যা যা করা লাগে সে করে। এমনকি সে কোনো একটা হারাম কাজ করার সময় সেটাকে আর হারাম মনে করে না। ভালোবাসার মানুষের জন্য হারাম কাজ করতে গিয়ে মানুষ কখনো বলেও বসে- আমি এটা এজন্য করছি, যাতে সে সন্তুষ্ট হয়, আর সে সন্তুষ্ট হলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন।

আমার পরিচিতি এক দম্পতির কথাই বলি। আঙ্কেলের দাঁড়ি রাখার ইচ্ছা। তো বললাম, দাঁড়ি রাখছেন না কেন? তিনি বললেন, তোমার আন্টি অপছন্দ করে। আমি বললাম, আপনার তো লক্ষ্য থাকবে আল্লাহর পছন্দের কাজ করা। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাই বলে কি বউকে কষ্ট দিয়ে আল্লাহর প্রিয় হবো?

আবার অনেক পরিবারে আন্টিরা পর্দা করতে চান। ঘরে এবং বাইরে। ঘরে হয়তো ঠিকমতো পর্দা করতে পারেন, কিন্তু কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবার সময় তারা বউ সেজে যান। তো, তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করি, আন্টি, যেখানে পর্দা করা সবচেয়ে দরকার, সেখানে পর্দা করছেন না কেনো? তিনিও একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, তোমার আঙ্কেল এগুলো পছন্দ করেনা না। তিনি বলবেন, আমি তো হুজুর না, তুমি কেনো হুজুরের বউ হচ্ছো?

তারমানে, ভালোবাসার নামে, ভালোবাসা রক্ষা করার জন্য আমরা আল্লাহর কোনো বিধান মানতে পারছি না। আল্লাহর বিধান মানার চেয়ে ভালোবাসার মানুষকে তুষ্ট রাখতেই আমরা বেশি মনোযোগী।

...

বিখ্যাত দানশীল হাতিম তা’ঈর পুত্র আদী ইবনে হাতিম তা’ঈ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) খ্রিস্টান ছিলেন। গলায় স্বর্ণের ক্রুশ ঝুলিয়ে প্রথম যখন রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আসেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন কুর’আনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন।

“তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেম ও দরবেশদেরকে ‘রব’ হিশেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহর ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। তারা যে শরীক করে, তিনি তা থেকে পবিত্র।” [সূরা আত-তাওবাঃ ৯:৩১]

এই আয়াতটি শুনে তো আদীর (রাঃ) চক্ষু চড়কগাছ। তিনি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “ইহুদি-খ্রিস্টানরা তো তাদের আলেম ও দরবেশদের উপাসনা করেনি।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদীর (রাঃ) কৌতুহল দেখে বললেন, “তাহলে শোনো, তারা তাদের আলেম ও দরবেশদের হারামকৃত বিষয়কে হারাম বলে মেনে নেয় এবং হালালকৃত বিষয়কে হালাল বলে স্বীকার করে।” [জামে আত-তিরমিজিঃ ৩০৯৫]

তারমানে, আল্লাহ যা হারাম করেননি, ইহুদি-খ্রিস্টানের আলেমগণ সেটা হারাম করেছিলো। আবার আল্লাহ যা হালাল করেননি, তারা সেটা হালাল করেছিলো। অনুসারীরা আল্লাহর কথা না মেনে আউট অব রিস্পেক্ট, আউট অব লাভ আলেমদের ফতোয়া মেনে নিয়েছিলো বলে আল্লাহ কুর’আনে এটাকে বলছেন- তারা তাদের আলেমগণকে ‘রব’ হিশেবে গ্রহণ করেছে!

এখন চিন্তা করুন, আপনি যখন আপনার প্রেমিক/প্রেমিকার, স্বামী/স্ত্রীর মনঃতুষ্টির জন্য আল্লাহর বিধানকে লঙ্গন করে চলছেন, তারমানে কি আপনি তাকে ‘রব’ বলে মেনে নিচ্ছেন না? সে কি আপনার হালাল-হারাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে না?

দুই.

কিছু কিছু ভালোবাসা যে শিরকের পর্যায়ে চলে যায়, সেই ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে সতর্ক করে দেন। আল্লাহ বলেনঃ

“কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে। তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় দৃঢ়তর।” [সূরা বাকারাঃ ২:১৬৫]

অর্থাৎ, আল্লাহকে যতোটা ভালোবাসা দরকার ততোটা না ভালোবেসে আল্লাহর জায়গায় যদি অন্য কাউকে ভালোবাসেন সেটা শিরকের পর্যায়ে চলে যায়। হতে পারে সেটা আমার-আপনার পছন্দের ফুটবলার, পছন্দের ক্রিকেটের বা পছন্দের সুপারস্টার। তাদের অভিনয়ে আমরা পাগলপ্রায়। তাদের জন্য আমরা জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে রাজী আছি। তাদের মতো চুলের স্টাইল করি, জামা পরি, জিনিসপত্র কিনি।

এখন নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, তাদের প্রতি ভালোবাসা কি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে না? আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা কি স্রেফ ‘অপশনাল’ হিশেবে আছে?

কোন কোন জিনিসের প্রতি মানুষের ন্যাচারাল লাভ আছে আল্লাহ সেটা জানেন। আল্লাহ সেটার একটা লিস্ট করে আমাদেরকে আবার সতর্ক করে বলেছেন, এসব ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি ভালোবাসা যদি আল্লাহর প্রাপ্য ভালোবাসার চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহর শাস্তির অপেক্ষা করো। আল্লাহ বলেনঃ

“তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছো, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হবার আশঙ্কা তোমরা করছো এবং সেই বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করছো, সেগুলো যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে যুদ্ধ করার চেয়ে, তবে তোমরা আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দান করেন না।” [সূরা আত-তাওবাঃ ৯:২৪]

এই আয়াতে আল্লাহ খুব স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন- আল্লাহর চেয়ে পিতা-মাতা, সন্তান এমনকি স্ত্রীও অধিক প্রিয় হতে পারবে না। এগুলো তো ‘হালাল’; তারপরও তাদের প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বেশি হতে পারবে না।

তিন.

‘আল্লাহকে ভালোবাসো’ এটা শুধু থিওরিটিক্যালি বলে আল্লাহ তাঁর কথা শেষ করেননি। কিভাবে আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে তার প্রেকটিক্যাল নির্দেশনাও তিনি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেনঃ

“বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার (রাসূলের) অনুসরণ করো, এতে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন।” [সূরা আলে-ইমরানঃ ৩:৩১]

অর্থাৎ, রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভালোবাসা মানে আল্লাহকে ভালোবাসা, তাঁর আনুগত্য করা মানে আল্লাহর আনুগত্য করা। আল্লাহ বলেনঃ

“যে রাসূলের আনুগত্য করলো, সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করলো।” [সূরা আন-নিসাঃ ৪:৮০]

চার.

একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হাত ধরলেন। রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন ব্যবহার ছিলো খুবই রেয়ার। উমর (রাঃ) আপ্লুত হয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার নিজের পরে আপনিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।”

উমরের (রাঃ) কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “না, যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! তোমার কাছে আমি যেন তোমার চেয়েও প্রিয় হই!।”

উমর (রাঃ) বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন, “আল্লাহর কসম! এখন থেকে আপনি আমার কাছে আমার নিজের চেয়েও প্রিয়।”

উমরের (রাঃ) কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর ঈমানের সার্টিফিকেট দিলেন- “উমর! এখন তুমি সত্যিকারের ঈমানদার হলে।” [সহীহ বুখারীঃ ৬৬৩২]

আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “তোমাদের কেউ ততোক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না, যতোক্ষণ না তার নিকট আমি তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের অপেক্ষা প্রিয় হই।” [সহীহ বুখারীঃ ১৫]

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিতা, সন্তান এমনকি সব মানুষ অপেক্ষা প্রিয় হওয়া মানে কী? এর মানে হলো, পিতা যদি একটি কথা বলেন, আর সেটা যদি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথার বিপরীত হয়, তাহলে আমরা যেন রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাটিই মেনে চলি। সন্তান যদি বাবার কাছে একটা আবদার করে, যেটা রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষার বিপরীত, তাহলে বাবা যেন সন্তানের আবদার না মানেন।

তারমানে, ভালোবাসার মানুষের আবদার পূরণ করতে গিয়ে যদি আমরা তাদেরকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশের উপর প্রাধান্য দেই, তাহলে আমরা যেন তাদেরকে ‘রব’ বলে মেনে নিলাম। শরত কেন, কোনো ঋতুতেই আল্লাহ ছাড়া আর কারো ‘কৃতদাস’ হওয়া যাবে না।

@Ariful

পঠিত : ৪৯৬ বার

মন্তব্য: ০