Alapon

মানবতার চেয়ে ক্ষমতা যখন বড় হয়ে যায়...


সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাস ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। দেশে দেশে মৃত্যুবরণ করছে হাজার হাজার মানুষ। পৃথিবী যেন আজ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ৬৯ হাজার ৫০৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে ১২ লাখ ৭৬ হাজার ১১৭ জন।

সময় এসেছে সকলে একত্রিত হয়ে এই বিপদ মোকাবিলা করার। মানবতার পাশে যার যার সামর্থ অনুসারে দাঁড়ানোর।

কিন্তু দিকে দিকে আজো শুনি মানবতাকে বাদ দিয়ে ক্ষমতার জয়গান করার কথা। পাকিস্তান অনেক দিক থেকেই যে পিছিয়ে আছে সেটা জানা কথা। কিন্তু এই দুর্যোগের সময়ে রাষ্ট্র যে অমুসলিমদেরকে (হিন্দুদেরকে) সব ধরণের সাহায্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে তা ছিল কল্পনাতীত।
(সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৪ এপ্রিল ২০২০)

অথচ অমুসলিমরাও ওই দেশেরই নাগরিক। তাদেরও থাকার কথা নাগরিক অধিকার। পাকিস্তানের চরিত্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও যে বদলায়নি এটি তার একটি প্রমাণ। পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার থাকবে না একথা কোথায় বলা আছে? বরং ইসলাম ধর্ম অনুসারে ইসলামী রাষ্ট্রেও অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মানবতার নবী মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনা নামক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মক্কা বিজয় অর্জন করে সকলকে মাফ করে দিয়েছেন। এর চেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে!

রাসূল (সাঃ) প্রতিবেশীর অধিকারের বিষয়েও খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। সম্মানিত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না সে মুমিন নয়।
(সহিহ বুখারী ৬০১৬)

যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) কে আদর্শ হিসেবে মানে সে ব্যক্তি কোন মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারেনা। কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিতে পারেনা। এটাই ইসলামের শিক্ষা। ইসলাম মানবতার ধর্ম, সাম্যের ধর্ম। কিন্তু ইসলামের মূলনীতি আজ মুসলিমরা ভুলে গেছে। ভুলে গেছে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য। আর তাই পদে পদে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে।

২। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে শ্রীলঙ্কায় ৪ জন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের মধ্যে ২ জন মুসলিম। মুসলিম ব্যক্তিদেরকে ইসলামী রীতি অনুযায়ী দাফন করতে না দিয়ে, সরকারি কর্তৃপক্ষ লাশ দাহ করেছে। ২ এপ্রিল, ২০২০ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৭৩ বছর বয়সী নাগরিক বিশরুল হাফি মোহাম্মদ জোনাস। তাকে ইসলামী রীতি অনুযায়ী তার পরিবারকে দাফন করতে না দিয়ে দাহ করা হয়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা কিংবা দাহ করা উভয়ই সঠিক। কিন্তু শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ দাহ করার নির্দেশনা দিয়েছে।
( সুত্র: আল জাজিরা, ৩ এপ্রিল ২০২০)

শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত নতুন কিছু নয়। মুসলিম সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত সেখানে নির্যাতনের শিকার। ২০০৯ সাল পরবর্তী শ্রীলঙ্কায় মুসলিম নাগরিকদের অবস্থা ভয়াবহ। যদিও ২১ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটিতে মুসলিমরা রয়েছে ১০ শতাংশ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রাষ্ট্রগুলোকে নাগরিকদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে বাধা প্রদান করতে নিষেধ করেছে। সকল বাধা উপেক্ষা করে শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ যা করেছে তা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

৩। ভারতে ১৩ মার্চ দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে চার হাজার মুসলিম নিয়ে তাবলীগী জমায়েত শুরু হয়। ১৫ মার্চ জমায়েত শেষ হয়। ভারতের মিডিয়াগুলো ভারতে করোনাভাইরাস বিস্তারে মুসলিমদের দায়ী করছে। কেহ কেহ এমনটাও বলছে যে, ভারতে মুসলিমরা চক্রান্ত করে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। যদিও তাবলীগী জামাত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ শুরু করেছিল। তবুও এখন মুসলিমদেরই দুষছেন অনেকে।

আসুন কয়েকটি তারিখ ও ঘটনার দিকে দৃষ্টি দেই তাহলেই স্পষ্ট হবে করোনা বিস্তারে কারা দায়ী। যদিও এসময়ে কারা দায়ী সেটি কোনভাবেই খোঁজা উচিত নয়। বরং সকলের উচিত একত্রে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করা।

১৩ মার্চ ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে করোনাভাইরাস ভারতবর্ষের জন্য তেমন কিছু নয়। ১৭ মার্চ তিরুপতি মন্দিরে মন্দির কমিটির হিসেব মতে চল্লিশ হাজার তীর্থযাত্রী জমায়েত হয়। তারাও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিল। তবু দোষ দেয়া হচ্ছে মুসলিমদের। যার পেছনে রয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।

এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মুসলিমদের দেখতে পারেনা। আর কিছু মুসলিম আছে যারা খাঁটি মুসলিম- যাদেরকে মোল্লা বলে হেয় করা হয় তাদেরকে দেখতে পারেনা। বাংলাদেশের কিছু মুসলিম মনে করছে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে শুধু মসজিদ থেকে। আর সেই জন্য যারা এই সময়ে মসজিদে যায় তাদেরকে ধর্মান্ধ, কট্টর বলে গালি দিচ্ছে। এই কথা বলার অর্থ এই নয় যে, আমি লোকদেরকে দলে দলে এই সময়ে মসজিদে যেতে বলছি। আমরা বলছি সকল ধরনের জনসমাগমস্থল পরিহার করতে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, হোক সেটা মসজিদ, মন্দির, বাজার, সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু কিছু লোক মোল্লাদেরকে গালি দিয়ে শান্তি পায়। কারণ মোল্লারা এদেশে সংখ্যালঘু। কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। দেশে দেশে ক্ষমতার দৌরাত্ম কমুক আর মানবতা জেগে উঠুক সকলের মধ্যে।

জাতীয় কবি নজরুলের কবিতা দিয়ে শেষ করছি-
"হিন্দু না ওরা মুসলিম? ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারি! বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।"

@Shamim

পঠিত : ৯৮৩ বার

মন্তব্য: ০