Alapon

মধ্য শা’বানের রাতঃ আমলের ক্ষেত্রে জঈফ হাদিস কতটুকু গ্রহণযোগ্য?


লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান কিংবা প্রচলিত শব্দে ‘শবে বরাত’ নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। কেউ বলেন সুন্নাহ্‌ তো কেউ বলেন বিদাআহ্‌! বিতর্কের কেন্দ্রে থাকে হাদীসের সুত্র নির্ণয়- এ রাত প্রমাণিত কিনা? কেউ বলেন দঈফ, কেউ বলেন হাসান! আরেকজন বলে উঠবেন, দাঁড়ান! হাসান লিযাতিহি তো নয়, লিগয়রিহি! আর আমল করবেন? দুর্বল, একেবারে দুর্বল (দঈফ জিদ্দান)।

সুন্নাত বনাম বিদাআতের এমন গ্যাঁড়াকলে পড়ে ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা থেকে অনুসন্ধানের যে চেষ্টা আমি করেছি- তার অংশবিশেষ এটি। অংশবিশেষ বললাম, কারণ-প্রচলিত স্কুল অফ থটে এটি একমাত্র চিন্তাভাবনা তো নয়-ই, এর একেবারে ভিন্ন ভাষ্যও কম নয়। সেগুলোও বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি মূলত এখানে তিনজন প্রখ্যাত ইসলামি স্কলারের মতামতের অনূদিত রূপ তুলে ধরছি, যাদের নির্দেশনা আমাকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে।

শাইখ সাইদ রামাদান আল বুতি : তিনি একজন প্রখ্যাত সুন্নি আলেম এবং সিরিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি ছিলেন। আরবিতে দেয়া তার একটি ছোট্ট বক্তব্যের ইংরেজি সাবটাইটেল থেকে বাংলায় অনুবাদের চেষ্টা করেছি।

মধ্য শাবা’নের রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে রাত্রি জাগরণের (কিয়ামূল লাইল) ভিত্তি আছে কি? হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসুল (সা) শা’বান মাসের পনের তারিখ রাতে ইবাদত বন্দেগি করতেন। ওহ, হাদিসটি তো দূর্বল। আচ্ছা, বেশ- মনে করি হাদিসটি বর্ণনাই করা হয় নি। তাহাজ্জুদের সালাত সম্পর্কে তো বর্ণনা আছে- নাকি? হাদিসে এও বর্ণিত হয়েছে, রসুল (সা) পনেরই শাবানের দিন রোজা রাখতেন। ওহ, এটিও তো জঈফ হাদিস, খুবই দূর্বল। তবুও তো এতে রোজার নির্দেশনা আছে। রোজা কি ইবাদতের একটি স্বীকৃত মাধ্যম নয়? তাছাড়া প্রত্যেক মাসে তো ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে তিনদিন (আইয়ামে বীজ) রোজার কথা আছে।

আমি মূল হাদিস প্রসঙ্গে বলার আগে পুরো বিষয়টি আরেকবার বলছি। যিনি উদাসীনতা-মুক্ত হয়ে স্বর্গীয় ক্ষমার উদ্যানে প্রবেশ করতে চান, তিনি সবসময় উপায়ান্তর খুঁজতে থাকেন। একজন ডুবন্ত মানুষ যেমন ডুবতে ডুবতে খড়কুটা পেলে আঁকড়ে ধরেন, যাতে কোনোভাবে একটু বেঁচে যেতে পারেন। ধরুন, আপনি মধ্য শাবানের রাতের ফযিলত সম্পর্কে একটা দূর্বল হাদিস পেলেন। আপনার বিবেক কি বলে? নিশ্চয় বলবে, আমি এটি পালন করবো। যদি বর্ণিত হাদিসটি সত্য হয়ে থাকে, তবে তো আল্লাহ তাঁর রাসুলের (সা) কাছে যে সুখবর দিয়েছেন সে অনুসারে আমাকে সম্মানিত করবেন। আর যদি বর্ণিত হাদিসটি সত্য নাও হয়, তাহলেও আল্লাহ আমার নিয়ত ভালোভাবেই অবগত আছেন। আমি বলবো, এটি রাসুলের (সা) কাছ থেকে আমার কাছে পৌঁছেছে যে, তিনি এমনটি করতে বলেছেন, আর সত্যিই রসুল (সা) বলেছেন ভেবে আমি তা-ই করেছি। তাই আমার কাছে যে সুখবর এসেছে সে অনুসারে তুমি আমাকে পুরস্কৃত কর। ব্যাপারটা এমনই তো, নাকি?

ইমাম বায়হাকি মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি আলা ইবনে আল-হারিসের থেকে যিনি আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, আয়েশা (রা) বলেন, এক রাতে নবীজি (সা) জেগে থাকলেন, তিনি নামাজ পড়ছেন, আর তাঁর সিজদা এত প্রলম্বিত করলেন যে আমি ভাবলাম তিনি হয়তো ইন্তেকাল করেছেন। এ আশঙ্কায় আমি তাঁর পায়ের আঙুল নাড়ালাম। তিনি যখন নড়লেন, আমি ফিরে আসলাম। আমি তাকে সিজদায় বলতে শুনলাম, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার আযাব থেকে তোমার দয়ার আশ্রয় কামনা করছি, তোমার রাগ থেকে তোমার সন্তোষের আশ্রয় কামনা করছি। তোমার প্রশংসা করতে আমি অসমর্থ। তুমি তেমনই প্রশংসিত যেমন প্রশংসা নিজেই করেছ’। তাঁর সিজদা ও নামাজ শেষে তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি ভেবেছ নবী তোমাকে প্রতারিত করেছে (অর্থাৎ- তোমাকে ছেড়ে অন্য স্ত্রী’র কাছে গিয়েছে)? আয়েশা (রা) বললেন, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে বলছি- তা নয়। বরং আপনি দীর্ঘ সময় ধরে সিজদায় থাকায় আমি আপনার মৃত্যু নিয়ে শঙ্কিত হয়েছি। নবী (স) বলেন, তুমি কি জানো আজ কোন রাত? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুল(সা) ভালো জানেন। হজরত(সা) বলেন, ‘আজ শাবান মাসের পনের তারিখ। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে থাকেন। তিনি আহবান করেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি যাকে আমি ক্ষমা করতে পারি? কোন অনুগ্রহ প্রার্থনাকারী আছে কি যাকে আমি অনুগ্রহ করতে পারি? তিনি কঠিন হৃদয়ের লোকগুলোকে (হিংসুক) সেভাবেই রেখে দেন’। এই হাদিসটি বাইহাকি বর্ননা করেছেন।

এখন যদি আমাদের কিছু প্রয়োজন থাকে কি করবো আমরা? আমরা কি বলবো, এটা দয়িফ হাদিস। আর এটা বলে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বো এবং ফজর পর্যন্ত গভীর ঘুমে নিমগ্ন থাকবো? আল্লাহ্‌র নামে বলছি, আল্লাহকে ভয় করে এমন বিশ্বাসী তা করতে পারে না। স্রষ্টা এবং পালনকর্তার প্রতি এতটুকু ভালোবাসা যাকে প্রভু দিয়েছেন সে তা করতে পারে না। বরং আনুগত্যের যে কোন সুযোগ লুফে নিবে সে।

শাইখ হামযা ইউসুফ : তিনি একজন প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার এবং মালেকি মাযহাবের একজন ফকীহ। শবে বরাত ও দূর্বল হাদিস সম্পর্কিত বিতর্ক নিয়ে তার মতামত থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা পেতে পারি।

আমাদের সময়ে জঈফ হাদীসগুলো আক্রমণের স্বীকার হচ্ছে। আমি আপনাদের বোঝার সুবিধার্তে একটা উদাহণ দেই, একটা দূর্বল হাদিস C- থেকে B- , হাসান হাদিস B- থেকে A- , সহিহ হাদিস A থেকে A+ , মুতাওয়াতির A+ বা ১০০%। জঈফ হাদীস মানে এটা ছুড়ে ফেলার মতো, তা কিন্তু নয়। যেমন একজন প্রফেসর বি মাইনাস প্রাপ্ত কোন পেপার ফেলে দিতে পারে না। কারণ এটা পাস, ফেইল নয়। অন্যভাবে যদি বলি, এটা এমন কিছু যেক্ষেত্রে রসুল (সা) বলেন নি তেমন প্রমাণ নেই। তাই আলেমগণের অভিমত হলো, ভালো কাজের ক্ষেত্রে তথা আমলের ক্ষেত্রে আপনি দয়িফ হাদিস আমল করতে পারবেন। তবে আকিদার ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই মোতাওয়াতির পর্যায়ের হাদিস নিতে হবে। তাই দূর্বল হাদিস আমলের বিপক্ষে যুক্তিটা একটা দূর্বল যুক্তি। ইমাম আওজায়ি ফিকহের একজন ইমাম, যিনি নিজে সত্তর হাজারের উপরে জাল হাদিস চিহ্নিত করেছেন, তিনিও পনেরোই শাবানের রাতে আমলের পক্ষে বলেছেন। ইমাম মালেকও একই কথা বলেছেন।

ড. তাহির উল কাদেরি : তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম এবং বিরল প্রতিভাসম্পন্ন লেখক ও গবেষক যিনি কোরআন, হাদিস, ফেকাহশাস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে প্রায় এক হাজারের মতো গ্রন্থ লিখেছেন।

অনেকে জইফ হাদিস কি তা বুঝতে পারেন না। জইফ মানেই মউযু (জাল) নয়। আর হাদিসের দূর্বলতা কখনো হাদিসের মাতান বা বক্তব্যে নয়, বরং ইসনাদের দিক থেকে হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন সনদের আধিক্য যইফ হাদিসের দূর্বলতা কমিয়ে দেয়। হাদিসের অনেকগুলো কিতাবে এই রাতের ফযিলত সম্পর্কে যে হাদিস রয়েছে তা-ই শুধু নয়, বরং আলাদা বা’ব (অধ্যায়) রচিত হয়েছে। ইবনে মাজাহ, তিরমিযি, নাসাঈ তে তে অধ্যায় রয়েছে। যখন হাদিসের ইমামগণ এ সম্পর্কে লক্ষ হাদিসের ভিড়ে দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন হাদিসই কেবল নয়, বরং পুরো বা’ব রচনা করেন, সেটা দ্বারা বোঝা যায়-উনারা কেবল হাদিসই নয়, তাদের আকিদা বা মানহাযও বর্ণনা করেছেন।

ইমাম শাফেয়ী (তাঁর ‘উম’ কিতাবে) এই রাতকে মহিমান্বিত পাঁচ রাতের এক রাত বলে বর্ণনা করেছেন। শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি তাঁর কিতাব ‘মা সাবেতা মিনাস সুন্নাহ’তে (সুন্নাহ দ্বারা যা সাব্যস্ত) এটি নিয়ে অধ্যায় রচনা করেছেন। একইভাবে, আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) তাঁর ‘গুনিয়াতুত তালেবিন’ এ আলাদা অধ্যায় লিখেছেন। জালালুদ্দিন সুয়ূতি তাঁর ‘ দুররুল মনসুর’ এ পঁচিশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইবনে তাইমিয়া তাঁর ‘ফাতওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া’য় লিখেন- ‘ মধ্য শাবানের রাতের ফযিলত সম্পর্কে অনেক হাদিসের বর্ণনা, সাহাবার আছার এবং সালেফিনদের আমল পাওয়া যায়। সালফে সালেফিনগণের এই রাতে নামাজ পড়া এবং ইবাদত সাব্যস্ত আছে’।

@karim

পঠিত : ৪৫৯ বার

মন্তব্য: ০