Alapon

টাকায় বাড়ে দূরত্ব

অনেকদিন বাসে উঠি না। কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই বাইসাইকেল কিনে ফেললাম। তরুন বয়সের শখ! এই শখের কথা এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আব্বার কাছে উপস্থাপন করলাম। বললাম, ‘আব্বাজান! আপনি অনুমতি দিলে একটা বাইসাইকেল কিনে নিজের এই বাচ্চাময় শখখানি পূরণ করতে চাই।’ আমার কোন কিছুতেই আব্বা আজ অবধি ‘না’ করেন নি। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।


তারপর থেকেই বাসে ওঠা হয় না বললেই চলে। সপ্তাহখানেক আগে সাইকেল রেখে ইচ্ছে করেই বাসে করে গন্তব্যস্থলে রওনা হলাম। অনেকদিন পর জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছি। ফেরার সময়েও একইভাবে জ্যামে পড়তে হল। কিন্তু খেয়াল করলাম, বিগত সময়গুলোর মত মেজাজ খারাপ হচ্ছে না! কেন হচ্ছে না জানি না।


আমি জানালার পাশে বসে আছি। পাশের সিটখানা ফাঁকাই পড়ে আছে। পরের ষ্টপজে একজন মাঝবয়সী নারী যাত্রী উঠে মিষ্টি করে বললেন, ‘আমি জানালার পাশে বসি’! আমি নীরবে সিট ছেড়ে দিলাম। বেচারী সিটে বসার কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়লেন। আর জানালার বাতাস তার ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে আমার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। তার ওড়নাটাকে কুকুর তাড়ানোর মত বারবার তাড়িয়ে দিচ্ছি অথচ তার কোন বিকার নেই। তাই ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।


সে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঘুমের ঘোরে একদিকে বাঁকা হয়ে বসায় তার গলায় ঝুলে থাকা আইডি কার্ডটি আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হল। তিনি ডাচ বাংলা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। হয়তো সারাদিন অফিস করে ভীষণ ক্লান্তি থেকেই এমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। এই ক্লান্তশ্রান্ত মানুষটি আবার কারো না কারো মা! তার শিশুটি হয়তো অধীর আগ্রহে তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। মাকে বলার জন্য এরই মধ্যে জমা হয়ে গেছে অনেক গল্প! কিন্তু মা কি সেই গল্প শুনার সময় পাবেন?


এই মাকে বাড়ি ফিরেই চোখে মুখে পানি দিয়েই রান্না ঘরে ছুটতে হবে। আবার সবাইকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাইয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। পরের দিন আবার অফিস আছে তো! এভাবেই চাপা পড়ে যায় কত সন্তানের না বলা কথা! এভাবেই হারিয়ে যায় মনের কোনে জমে থাকা অনেক কথা অনেক গল্প! এভাবেই গল্পগুলো জমতে জমতে তাদের মাঝে একটি নিয়মমাফিক সম্পর্কে রূপ লাভ করে।


এই নিয়মমাফিক সম্পর্কটি যখন মায়ের কাছে ধরা পড়বে তখনই ঘটবে বিষ্ফোরন। মা সন্তানের কাছে কান্না ভেজা চোখে বলবে, ‘আমি তো চাকরী করি তোদের জন্য। তোরা একটু ভালো থাকবি সে কারণেই আমি চাকরী করি।’ কিন্তু মা তার সন্তানের প্রাণের আকুঁতি শুনতে পান না! চাকরীর টাকা হয়তো তার শরীরে আরো একটু ভালো পোশাক জড়াতে পারছে। কিন্তু এই টাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদ মায়ের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখছে।

পঠিত : ৬৮৭ বার

মন্তব্য: ০