Alapon

করোনা ভাইরাস ও বাংগালী মুসলমানের ‘আজাব তত্ব’...


১.
জানুয়ারী মাস।

পত্রিকার পাতায় তখন একটু একটু করে করোনা ভাইরাসের খবর আসছে। চীনের উহানে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে চীনের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে গোটা দেশটাই বিপর্যস্ত।

পাশে থাকা এক মুরুব্বীকে সে খবর শোনালাম। তিনি নাক মুখ কুচকে উত্তর দিলেন “খুব ভাল হয়েছে। ওদের উপর আল্লাহ্র গজব নেমেছে”

কয়েকদিন পরে দেখি, অনলাইন অফলাইনে এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। অনেকেই দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। ওয়াজ মাহফিলে বক্তারা ফাটিয়ে ফেলছেন “আল্লাহ্র গজব নামছে! মুসলমানদের উপর অত্যাচার করেছে। এখন তার ফল ভোগ করছে”

খেয়াল করে দেখলাম, বাংগালী মুসলমান ‘ষড়যন্ত্র’ আর ‘আজাব’ তত্বে দারুনভাবে বিশ্বাসী। যে কোন কিছুর মধ্যেই তারা ইহুদী নাসারার ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়। অন্যের উপর যে কোন বিপদ দেখলেই, তারা তাকে আজাব মনে করে। অন্যের আজাব দেখে মনের মধ্যে এক ধরনের সুখ সুখ অনুভব করে।

এটা কেন হয়?
হয়, কারণ অক্ষম মানুষের ‘আজাব গজব’ই ভরসা।

ধরুন, কারও উপর আপনার প্রচণ্ড রাগ হল। আপনি এখন কি করবেন? সুযোগ থাকলে আপনি তাকে দু কথা শুনিয়ে দিবে। আপনি ক্ষমতাবান হলে তাকে দেখিয়ে দিবেন।

আর আপনি যদি দুর্বল হন, তাহলে? মনে মনে ভাববেন “তোর উপর আল্লাহ্র গজব পড়ুক!’। আর যদি সত্যি তার উপর কোন বিপদ দেখতে পান? হাসিতে আপনার একান ওকান হয়ে যাবে “খুব ভাল হইছে! আল্লাহ্র গজব পড়ছে!”

করোনা ভাইরাস আল্লাহ্র গজব না রহমত সে তর্কে আমি কখনও যাই নি। অন্যের বিপদ দেখে তৃপ্তির হাসি হাসারও কোন স্বার্থকতা খুঁজে পাই নি।

চায়নার উপর যদি আল্লাহ্র গজবও এসে থাকে, তাহলে আমার কি লাভ? এতে কি মুসলিম বিশ্বের কোন উপকার হবে? সারা বিশ্বে মুসলমানদের উপর চলা অত্যাচার নিপীড়ন কমে যাবে? কাফেরেরা সব সুড়সুড় করে ভাল হয়ে যাবে?

এমন কখনও হয়? হয় না।

তাই এ নিয়ে আত্মতৃপ্তির কোন সুযোগ নেই। জ্ঞানে, গুনে, বিজ্ঞানে,বুদ্ধিমত্তায়, চরিত্রে নিজেদের উন্নত করতে না পারলে মুসলমানদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। কিন্তু অক্ষম, অযোগ্য, অপদার্থ মুসলমানদের সে কথা বোঝাবে কে?

আল্লাহ ক্বুরানে বিভিন্ন জাতির উপর আসা আজাবের কথা বলেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবীরা এ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। এ নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেন নি।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকাশে ঘন মেঘ দখলে অস্থির হয়ে যেতেন। একবার ঘরে যেতেন, একবার বাইরে যেতেন। বলতেন ”আল্লাহ যেন পুর্ববর্তী জাতিদের মত আমাদের উপর আজাব নাজিল না করেন”

ভেবে দেখুন, যিনি আল্লাহ্র রাসুল, চরিত্রে মাধুর্য্যে যার সমকক্ষ কেউ নেই, তার মনোভাব ছিল এমন। আর আমরা?

ওজনে কম দেয়া, লোক ঠকানো, অসৎ চরিত্রের কারণে অতীতের জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে। তাদের উপর আজাব এসেছে। আমাদের চরিত্র কি তাদের চেয়ে খুব ভাল?

অথচ আমরা আজাবের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেই নি। নিজেদের চরিত্র বদলাই নি। উলটো অন্যের উপর বিপদ দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসেছি। ভাবিনি, আমাদের যা স্বভাব চরিত্র, একই আজাব আমাদের উপরেও আসতে পারে।

আমরা অন্যের আজাব দেখে ফুর্তি করেছি, নিজেরা সতর্ক হবার তাড়না অনুভব করি নি।

আজ তাই চীনের আজাব আমাদের উপরও এসে পড়েছে। চীন অনেকটাই সামলে নিয়েছে।

কিন্তু ‘আজাব তত্বে’ বিশ্বাসী বাংগালী মুসলমান কি সামলাতে পারবে?
.

২.
শুধু আজাব তত্বই নয়, বাংগালী মুসলমানের দৃঢ় বিশ্বাস “করোনা এসেছে ইহুদী খৃষ্টানদের জন্য। মুসলমানদের জন্য আসে নি’
অনেক বক্তা ওয়াজ মাহফিলে এটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছেন, রীতিমত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।

আমি অবাক হই, এত কনফিডেন্স উনারা পান কই? উনারা কি ভবিষ্যৎ বক্তা, গনক ঠাকুর?

আল্লাহ কি তাদের উপর ওয়াহী নাজিল করেছেন? নাকি তাদের উপর ‘কাশফ’ আসে?

ক্বুরান ও হাদিসে কি বলা হয়েছে, অমুক অমুক রোগ মুসলমানদের স্পর্শ করবে না? কিংবা যে কোন মহামারিতে মুসলমানদের মৃত্যু হয় না?

হযরত উমর রা এর সময়ে একবার মহামারি প্লেগ হয়েছিল। অনেক সাহাবী মারা গিয়েছিলেন। মদীনায় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আমাদের ঈমান কি তাদের চেয়েও শক্ত?

আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে ঘন মেঘ দেখলে আল্লাহ্‌র সাহায্য চাইতেন, সেখানে আমাদের এইসব কথা বলার দুঃসাহস হয় কি করে?

খুব বেশি আগের কথা নয়, যখন এইদেশেও বসন্ত, কলেরা ইত্যাদি রোগে অসংখ্য মানুষ মারা যেত। গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। তখন হতে পারলে এখন কেন নয়?

আল্লাহ বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে মানুষের উপর বিপদ আপদ দিয়েছেন। কখনও আজাব হিসেবে, কখনও সতর্কতা হিসেবে। কখনও মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখার জন্য, আবার কখনও মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য।

বিপদ কেন আসে, কি কারণে আসে আল্লাহই ভাল জানেন। মুমীন মুসলমানের উচিৎ সর্বাবস্থায় নিজেরা সতর্ক হওয়া, তাওবা ইস্তেগফার করা। নিজেদের আমলকে উন্নিত করার চেষ্টা করা।

কিন্তু বাংগালী মুসলমানের মধ্যে সে প্রবনতা কম। তাদের মুখ চলে মেশিনগানের মত, কাজের বেলায় ঠনঠন।

করোনা ভাইরাস আমাদের ‘আহাম্মকী’ আরেকবার চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

তবুও কি আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে?

মনে হয় না। বাংগালী মুসলমানদের নিয়ে সে ‘দুরাশা’ না করাই উত্তম।

@Omar

পঠিত : ৪৫৩ বার

মন্তব্য: ০