Alapon

এই দেশে মূর্তির দাম থাকলেও জীবন্ত মানুষের দাম নেই।

আমার একটা রোগ আছে। ভয়ানক মন খারাপের রোগ। এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেই আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। সারা সন্ধ্যা এই লাইব্রেরীর দোকান ঐ লাইব্রেরীর দোকান ঘুরেও মন ভালো হয় না। আমি প্রায় নিঃসঙ্গ মানুষ। মনখারাপ এবং নিঃসঙ্গতার এই মুহুর্তে রাস্তা এবং রাস্তার ল্যাম্পপোষ্ট ‍গুলোই আমার সঙ্গি। রাস্তার মাঝে মনের যতোসব অভিমান অভিযোগ বিলিয়ে হালকা হবার চেষ্টা করি।


রাস্তার সঙ্গে মনের ভাব আদান প্রদান করতে করতে যখন যে মধ্যরাত হয়ে যায় সেদিকে খেয়ালই থাকে না। ছোটপু যখন ফোন দিয়ে বলে, ‘তোর কি এখনো রাত হয় নি! বাসায় ফেরার টাইম আর কোন সময় হবে।’ ঠিক তখনই উপলবদ্ধী হয় রাত মনে হয় হয়েছে। এই রাত মনে হবার পর আমি হাইকোর্ট প্রাঙ্গন এবং কমলাপুর রেলষ্টেশন প্রাঙ্গন হয়ে ঘুরে আসি।


এই দুই প্রাঙ্গনের ফুটপাতে শুয়ে থাকে কতশত মানুষ। একরাতে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই টিপটিপ বৃষ্টিতে দেখলাম হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে এক মা শতাধিক ছেড়া পলিধিন দিয়ে নিজের কোলের শিশুটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এরই মাঝে তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পেটের ক্ষুধা বোঝে না কোনটা মধ্যরাত আর কোনটা বৃষ্টিময় ঝামেলার রাত। সেই মা নিজে ভিজতে ভিজতে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। আর আমি আকাশের পানে লজ্জামাখা মুখটাকে ভিজাতে লাগলাম। চশমার গ্লাস দু’টো বৃষ্টির পানিতে ঝাপসা হয়ে গেল। এখন আর আকাশটাকেও দেখতে পাচ্ছি না। মনে হল, হায় আমার বিবেকটাও যদি এমন ঝাপসা হয়ে যেত। তাহলে এই লোকগুলোর কষ্ট হয়তো আমাকে স্পর্শ করতো না। আমিও হয়তো ভাবতে পারতাম, কে মরে মরুক গা! আমি ভালো আছি এটাই বড় কথা।


দুই একমাস পরপর বন্ধুর ভার্সিটির হলে যাই। এক রাত থেকে আবারো আপন পৃথিবীতে ফিরে আসি। কিন্তু ঐ রাতটি ছিল কোন এক শীতের রাত। মোড়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখলাম আর এক ভয়াবহ দৃশ্য! ফুটপাতের উপরে একটি ছেড়া কম্বল নিয়ে দুই ভাইবোন ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ঘুমের ঘোরেই দু’জনে সেই ছেড়া কম্বলটাই টানাটানি করছে। একজনের শরীরে আবৃত হলে আর একজন উন্মুক্ত হাওয়ার করাল গ্রাসে পতিত হয়। তখনই তার স্নায়ু বলে ওঠে, টেনে নাও! তোমার ভাই এর শরীর থেকে কম্বলখানি টেনে নাও। এরূপ টানাটানি করতে করতে তাদের হাজারো রাত কেটে যায়।


এই মানুষগুলো কোন থেমিস ভাস্কর্য চেনে না। এই মানুষগুলো রাজু ভাস্কর্য চেনে না। এই জীবন্তু মানুষগুলো রবীন্দ্রনাথ জগদীস চন্দ্র বসুর ভাস্কর্য চেনে না। তারা চেনে এক মুঠো ভাত। তার চেনে রাত পোহালে একটি নিরাপদ আশ্রয়। তারা চেনে বৃষ্টিময় রাতে কোনরকম একটি বারান্দায় শুয়ে রাত কাটানোর সময়। একটি জীবনহীন মূর্তির জন্য গোটা জাতি চিন্তিত হলেও এইসকল জীবন্তু মানুষগুলোর কথা ভাবার কারোরই সময় নেই।


মানব ধর্মে বিশ্বাসী শাহবাগীরা না তাদের কথা বলে। আর ইসলামিষ্ট নামধারী হুজুররা না তাদের কথা বলে। তাদের কথা কেউই বলে না। তারা জীবন্তু মানুষ হয়েও মর্যাদাহীন। অথচ এই জাতির কাছে একটি জীবনহীন মূর্তির দাম এই মানুষগুলোর চেয়ে কয়েকহাজার গুন বেশি দামি। তাই তো, এই জীবনহীন মূর্তি গুলোর দিকে ডজনে ডজনে ক্যামেরা তাক করে থাকে। কিন্তু জীবন্ত মানুষগুলোর জীবনের ছবি তোলবার জন্য একটি ক্যামেরাও নেই।

পঠিত : ৫৫৫ বার

মন্তব্য: ০