Alapon

শিশুদের প্রতি রাসূল সা.-এর ভালোবাসা...


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, আমাদের বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতির জন্য এক অনুপম আদর্শ ও সাফল্যমণ্ডিত অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিঁনি একজন আদর্শিক শিক্ষক বা গুরু।

মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন: " রাসূলের জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।" তাঁর তাকওয়া, মেধা, কৌশল, অনুপম ব্যক্তিত্ব ও উত্তম-চরিত্র মাধুর্য আমাদের সকলের জন্য সর্বক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য। আদর্শ ও অনুসরণ ক্ষেত্রে তিঁনি অনন্য। তিঁনি যুবক, বৃদ্ধ ও সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। তাঁর আদর্শে যুবক-বৃদ্ধ সবাই আলোকিত ও আদর্শিক পুরুষ হয়েছিল। এমনকি শিশু-কিশোররাও মহানবী (সা.) এর প্রোজ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল। তখনকার যুগের শিশু-কিশোরেরা রাসুল সাঃ এর ভালোবাসা ও স্নেহে শিক্ত ছিল।

শিশুদের সঙ্গে প্রিয় নাবী সাঃ এর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ, কোমল এবং বন্ধুসূলভ। তিনি তাদের হাসি আনন্দে যোগ দিতেন। ছোটদের দুষ্টুমিতে তিনি কখনও অসন্তষ্ট কিংবা বিরক্ত হতেন না। তাদের সঙ্গে সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। শিশুরা তাঁর কাছে এলে নিজেদের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতো। খেলাধুলা বা হাসিখুশিতে মেতে উঠতো। এতে রাসূল সাঃ কখনো বিরাগ দেখাতেন না। বরং তাদেরকে আরো কাছে টানতেন। রাসূল (সা.) কখনো শিশুদের ওপর রাগ করতেন না। চোখ রাঙিয়ে কথা বলতেন না। কর্কশ বা কঠোর ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলতেন না। তিনি ছোটদের আদর করে কাছে বসাতেন। তাদের সাথে মজার মজার কথা বলতেন। ছোটদেরকে দেখলে আনন্দে নবীজীর বুক ভরে যেত। তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। একদিন একটি সুন্দর শিশুকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, —এই শিশুরাইতো আল্লাহর বাগানের ফুল।'

শিশুদের প্রতি রাসূল সাঃ এর অনুপম সৌহার্দ্যের অনেক হাদীস পাওয়া যায়।শিশুদের প্রতি রাসূলের উত্তম আচরণ,হাসিখুশি ও নামাজে বাচ্চাদের সাথে আচরণ ইত্যাদি নিয়ে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ্য কয়েকটি তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশা আল্লাহ।

১. জাবের ইবন সামুরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলের সাথে ফযরের নামায পড়লাম অতঃপর তিনি বাড়ির দিকে বের হলেন আমিও তার সাথে বের হলাম। পথিমধ্যে তার সাথে কিছু বাচ্চাদের সাক্ষাৎ হল। তিনি তাদের এক এক করে প্রত্যেকের উভয় গালে হাত বুলাতে লাগলেন।’মাহমুদ রা. বলেন, তিনি আমার উভয় গালে হাত বুলালেন আমি তার হাতের হিম শীতল সুগন্ধি উপলব্ধি করলাম। যেন তার হাতের সাথে সুগন্ধি ব্যবসায়ীর সামগ্রীর ছোঁয়া লেগেছে।
[ সহীহ মুসলিম ২৩২৯ ]

২. উসামা ইবন যায়েদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ধরে তার এক রানে বসাতেন আর হাসানকে বসাতেন অন্য রানে। অতঃপর তাদের একত্র করতেন এবং বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, কেননা আমি তাদের প্রতি দয়া করি।’ (সহীহ আল-বুখারি ৬০০৩)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘হে আল্লাহ! আমি তাদের ভালোবাসি সুতরাং আপনিও তাদের ভালোবাসুন।’
[বুখারী, হাদীস নং ৩৭৩৫]

৩. মাহমুদ রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক বারের পানি ছিটানোর কথা; ‘তিনি আমার চেহারায় বালতি থেকে পানি ছিটিয়েছেন তখন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর যা আমার এখনো মনে আছে।’
[সহীহ আলু বুখারি ৭৭ , সহীহ মুসলিম ৪৫৬/১]

তিনি এটা করেছেন কৌতুকরত বা বরকত স্বরূপ, যেমনটি তিনি সাহাবীদের সন্তানদের সাথে করতেন। শাইখ ইবন বায রহ. বলেন, ‘এটা কৌতুক ও উত্তম চরিত্রের অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।’

৪. আবু হুরাইরাহ রা. বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ইবন আলীকে চুম্বন করেন তখন তার নিকট আকরাহ ইবন হাবেস তামীমী বসা ছিলো। আকরাহ বলল, ‘আমার দশটি সন্তান রয়েছে তাদের কাউকে আমি চুম্বন করি না।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘যে দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না।’
[সহীহ আল-বুখারি ৫৯৯৭ ]

৫. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কিছু গ্রাম্য লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসল এবং বলল, তোমরা তোমাদের বাচ্চাদের চুমো খাও আমরা তাদের চুমো খাই না।’নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার অন্তরে দয়া উদ্রেক করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যদি আল্লাহ তা ছিনিয়ে নিয়ে থাকেন।’
[সহীহ আল-বুখারি ৫৯৯৮, সহীহ মুসলিম ২৩১৭]

৬. হাসান ও হুসাইন রা. রাসূলের সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিলেন। এ ব্যাপারে ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের সম্পর্কে বলতে শুনেছি, ‘তারা আমার পৃথিবীর সুগন্ধিময় দুটি ফুল।’
[সহীহ আল-বুখারি ৫৯৯৪]

অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তাদের দান করেছেন এবং তাদের দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সন্তানদেরকে চুম্বন করা হয় এবং সুঘ্রাণ নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে সুগন্ধময় ফুলের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

৭. আবু বাকরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিম্বারে আরোহণ অবস্থায় তার খুতবা শুনেছি, আর হাসান তার পাশে ছিল। তিনি একবার মানুষের দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার তার দিকে তাকাচ্ছেন এবং বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমার এ সন্তান হল নেতা। সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা তাকে দিয়ে মুসলিমদের বিশাল দু’দলের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন।’
[সহীহ আল-বুখারি ৩৭৪৬]

পরবর্তীতে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দিয়ে মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও তার সাথীদের এবং আলী ইবন আবি তালেব রা. এর অনুসারীদের ও তার সাথীদের মাঝে মীমাংসা করেন। অতএব তিনি খেলাফত মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর জন্য ছেড়ে দেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বারা মুসলিমদের রক্ত হেফাযত করেন।

৮. বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি হাসান ইবন আলীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাঁধে দেখেছি এবং বলতে দেখেছি, ‘হে আল্লাহ আমি তাকে ভালোবাসি। অতএব আপনিও তাকে ভালোবাসবেন।’
[সহীহ আল-বুখারি ৩৭৪৯; মুসলিম, ২৪২২ ]

এ ছিল শিশুদের প্রতি রাসূল সাঃ এর উত্তম আচরণ, যা ভালোবাসা ও স্নেহে ভরপুর ছিল। এছাড়াও, রাসূল সাঃ মসজিদে বাচ্চাদের নিয়ে যেতেন। মসজিদে বাচ্চাদের পেলে অনেক আনন্দ করতেন। তাদেরকে আদর করতেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস তুলে ধরছি -

১. আবু কাতাদাহ থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়া অবস্থায় উমামা বিনতে যয়নবকে বহন করছিলেন, ‘যখন তিনি সেজদা করতেন তখন তাকে রেখে দিতেন। আর যখন দাঁড়াতেন তখন তাকে কোলে তুলে নিতেন।’
[ সহীহ আল-বুখারি ৫১৬ ]

২. তিনি কোনো শিশু বাচ্চার কাঁদার আওয়াজ শুনলে সালাত সংক্ষিপ্ত করতেন। এ ব্যাপারে আবু কাতাদাহ তার পিতা হতে ও তার পিতা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন আমি সালাতে দাঁড়াই তখন ইচ্ছা থাকে নামায দীর্ঘ করব। কিন্তু যখন কোনো শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনি, তখন তার মায়ের কষ্ট হবে ভেবে আমি নামায সংক্ষেপ করি।’
[ সহীহ আল-বুখারি: ৭০৭ ]

৩. উম্মে খালেদ বিনতে খালেদ ইবন সাঈদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবার সাথে রাসূলের নিকট আসলাম, তখন আমার গায়ে হলুদ বর্ণের জামা ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘ছানাহ! ছানাহ!’’ এটি হাবশী ভাষার শব্দ যার অর্থ, চমৎকার! চমৎকার! তিনি বলেন- ‘অতঃপর আমি নবুওয়তের মোহর নিয়ে খেলা করতে গেলাম। আমাকে আমার পিতা ধমক দিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাকে ধমক দিও না।’ অতঃপর বলেন, ক্ষয় কর এবং জীর্ণ কর, অতঃপর ক্ষয় কর এবং জীর্ণ কর, অতঃপর আবার ক্ষয় কর এবং জীর্ণ কর।’ আব্দুল্লাহ বলেন, অতঃপর সে মহিলা অনেকদিন জীবিত ছিল এমনকি তার কথা বর্ণনা করা হতো (যে ওমুক দীর্ঘজীবি হয়েছে)।
[সহীহ আল-বুখারি ৩০৭১ ]

অর্থাৎ বর্ণনাকারী তার দীর্ঘ জীবনের কথা বুঝিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, উম্মে খালেদের মত আর কেহ এত দীর্ঘ জীবন লাভ করেনি।

৪. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে প্রিয় ছিল আমার এক ভাই, তার নাম আবু উমায়ের। আমার মনে আছে, সে যখন এমন শিশু যে মায়ের বুকের দুধ ছেড়েছে মাত্র। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আসতেন এবং বলতেন, ‘হে আবু উমায়ের! কি করেছে তোমার নুগায়ের?’ নুগায়ের হল এমন একটি ছোট পাখি যার সাথে আবু উমায়ের খেলা করত। নুগায়ের মারা গিয়েছিল।
[সহীহ আল-বুখারি: ৬২০৩ ]

৫. আনাস ইবন মালেক রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি শিশু বাচ্চাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদের সালাম দিতেন এবং বলতেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন।’
[সহীহ আল-বুখারি ৬২৪৭, সহীহ মুসলিম ১৭০৮/৪ ]

৬. উম্মে কায়স বিনতে মিহসান থেকে বর্ণিত, তিনি তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে রাসূলের দরবারে আসলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার কোলে রাখলেন, সে তার কোলে প্রস্রাব করে দিল। তারপর তিনি পানি নিয়ে আসতে বললেন এবং পানি ছিঁটিয়ে দিলেন এবং তা ধৌত করেননি। (সহীহ আল-বুখারি ২২৩)

এ ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যা দ্বারা শিশুদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম আচরণ, সুন্দর ব্যবহারের বিষয়গুলোর বর্ণনা রয়েছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী ও শিশুদের ওপর শারীরিক যে নির্যাতন করা হয় তা থেকে সরে এসে রাসূলের শেখান পদ্ধতিই অনুসরণ করা উচিত।

বিশেষত, আমাদের দেশে বাচ্চাদের মসজিদে আসতে বারণ করা হয়। না, বরং এটা অনুচিত। শিশুদেরকে বাবা,ভাই বা অন্য কেহ নিয়ে আসবেন। ছোট থেকে তাদেরকে মসজিদমূখী করাবেন। নামাজের প্রতি অনুশীলন করাবেন। সম্মানীত ইমাম সাহেবরা বাচ্চাদেরকে মসজিদে পেলে ধমক না দিয়ে আদর করবেন,স্নেহ করবেন। কাছে টেনে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করবেন। তাদেরকে হাসিখুশি রাখার মতো কথাবার্তা বলবেন। যেমনটা আমাদের রাসূল সাঃ শিশুদের সাথে করতেন। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝার তাওফীক দান করুক!

@Abdul karim

পঠিত : ১০৯২ বার

মন্তব্য: ০