Alapon

কবি ফররুখ আহমদের কবিতা আজও দিক ভোলা মুসলিমদের ডাক দিয়ে যাচ্ছে...


এক সময় উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণের কবি বলা হতো কবি আল্লামা ইকবালকে। সেই আল্লামা ইকবাল এখন উপমহাদেশের গণ্ডি মাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচিত। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশেই আল্লামা ইকবাল এখন একটি পরিচিত নাম। কবি আল্লামা ইকবালের কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে একই পথে পা মাড়িয়েছিলেন বাংলার মুসলিম জাগরণের কবি, মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ। ফররুখ আহমদ ছিলেন কবি আল্লামা ইকবালের ভাবশিষ্য।

ছাত্র জীবনে কবি ফররুখ আহমেদ কমরেড কে এম এন রায়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাম আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তা মাত্র কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল। তারপর ইসলামের ধুলো মাথা পতাকাকে আবারো পতপত করে উড্ডিন করার প্রত্যাশা নিয়ে ইসলামের পথে হাটতে শুরু করেন। আমৃত্যু সে পথেই স্থায়ী ছিলেন এবং ইসলামের জন্য লিখেছেন অগণিত কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ও গান।

কবির জন্ম ও জীবন
মাগুরা জেলার শ্রীরামপুর থানার মাঝাইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন অর্থাৎ আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমেদ। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ হাতেম আলী এবং মায়ের নাম বেগম রওশন আক্তার। কবি বাল্যকালেই মা হারা হন।

কবির পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতেই। তারপর কলকাতায় এসে তালতলা মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানেও কবির পড়াশোনা স্থায়ী হয়নি। পরে কবি খুলনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৯ সালে কোলকাতার রিপন কলেজ হতে আই.এ পাস করেন। কোলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে, প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজীতে অনার্সে ভর্তি হলেও শেষ করতে পারেননি। এরপর কবি চাকরি জীবন শুরু করেন।

১৯৪৩ সালে আই.জি প্রিজন অফিসে চাকুরীর মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ে এবং ১৯৪৬সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকুরী করেন। ১৯৪৫সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮সালে কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পাকিস্তান ঢাকা বেতারে যোগ দেন।

সাহিত্য চর্চা

কবির সাহিত্য চর্চার মূল বিষয়টাই ছিল ইসলাম এবং মুসলিম জাগরণ। তিনি বাংলাভাষাষিদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে এবং তাদের জাগরিত করতে লিখেছেন ঐতিহাসিক এক কবিতা, পাঞ্জেরী। পাঞ্জেরী কবিতা সেই নব্বইয়ের দশকে রচিত হলেও মনে হয় যেন, কবি এই আমাকেই বলছেন। বর্তমান সময়ে মুসলিম জনতাকে বলছেন। কবি বলেছেন,

রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে:
অসীম কুয়াশা জাগে শুন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?


কবির এই চেতনা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক ড. আহমদ শরীফ বলেন, ‘আমাদের বাংলা ভাষায় স্বকীয় আদর্শে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, আদর্শ হবে কোরআনের শিক্ষা, আধার হবে মুসলিম ঐতিহ্যানুগ, বিষয়বস্তু হবে ব্যক্তি বা সমাজ অথবা বৃহদর্থে জগৎ ও জীবন। এভাবে আমাদের জাতীয় সাহিত্য ও জাতীয় জীবন গড়ে উঠবে। তরুণ কবি ফররুখ আহমদ একান্তভাবে মুসলিম ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাব্য সাধনা করে পথের দিশারির গৌরব অর্জন করেছেন।’

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তিনি মারা গেছেন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায়। না, ভুল বললাম, নিঃস্ব কথাটা তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। তাঁর মানসিক ঐশ্বর্যের কোনো কমতি ছিল না। তিনি রেখে গেছেন এমন কয়েকটি গ্রন্থ, যেগুলো পঠিত হবে দীর্ঘকাল।’

আর সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘ফররুখের কাব্যপ্রক্রিয়ায় যেহেতু একটা বিশ্বাসের উন্মুখরতা ছিল, তাই তার পাঠকের সংখ্যা আমাদের মাঝে সর্বাধিক। বিশ্বাসের সে একটা কল্লোলিত সমর্থন পেয়েছে। আবার ব্যবহৃত শব্দের পরিধির সার্থক বিবেচনায় এবং ধ্বনি সাম্যের কারণে অবিশ্বাসীরাও তাকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি।’

বর্তমান সময়ে অনেক প্রগতিশীল ইসলামকে আধুনিক বলতে নারাজ। যার কারণে কবি ফররুখ আহমদের চিন্তা-চেতনা জুড়ে যেহেতু ইসলাম আর মুসলমান তাই তিনি আধুনিক বা রোমান্টিক কবি হতে পারেননি। তাদের উদ্দেশ্যে কবি আবু রুশদের ভাষায়, ‘ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি।...তাঁর কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান অকুণ্ঠ। সুদূরের প্রতি আকর্ষণও তাঁর কাব্যের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবু তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক কবি। তাঁর একটি বলিষ্ঠ সজাগ তীক্ষ্ম অনুভূতিশীল মন আছে, যা সৌন্দর্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করার সাহস রাখে; কিন্তু রোমান্টিসিজমের বিপদ সম্পর্কে যা সর্বদা সচেতন।’

আর তাঁর ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনা এবং তাঁর সাহিত্যে তার প্রভাব সম্পর্কে আবুল ফজল লেখেন, ‘একটা সুনির্দিষ্ট মতাদর্শে প্রবল বিশ্বাসী থেকেও ফররুখ আহমদ বিশুদ্ধ কবি ছিলেন। এ কারণে আপন লক্ষ্যে সনিষ্ঠ থেকেও কবিতার নানা স্রোতে বিচরণ তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছে। আদর্শনিষ্ঠ কবিতা সাধারণত একচোখা হয়ে থাকে। সুখের বিষয়, ফররুখ আহমদের বেলায় তা হয়নি।’

প্রগতিশীলদের দ্বারা নিপিড়নের স্বীকার

দেশ স্বাধীন হবার পর পর একদল প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের রোষানলে পড়েন কবি ফররুখ আহমেদ। বলা হয়, ‘কবি ফররুখ নাকি স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষে কলম ধরেছেন।’ যার কারণে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে কবি ফররুখকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

অথচ কবি ফররুখ ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় কবি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবি ফররুখের নেতৃত্বে পাকিস্তান রেডিওতে কর্মরত বাঙালিরা রাজপথে নেমে আসে এবং কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এছাড়াও ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের স্বৈরাচার সরকার থেকে পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু কবি ফররুখ আহমদ ইসলামি চিন্তাধারার হওয়ায় বাম আদর্শের প্রগতিশীলরা বুদ্ধি করে তাকে দেশবাসী ও সরকারের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। যার কারণে ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরি হারিয়ে তাকে বেকারত্ত্ব বরণ করতে হয়।

তখন কবি ফররুখ আহমদের পাশে এগিয়ে আসলেন কিংবদন্তি আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তখন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় ‘ফররুখ আহমদের কী অপরাধ’ শিরোনামে একটি অত্যন্ত তীর্যক ও ব্যাগ্মাত্মক কলাম লিখলেন। সেই কলামের বদৌলতে পরবর্তিতে কবি ফররুখ আহমদকে সরকারি চাকরিতে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়।

তারপর ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর কবি ফররুখ আহমদ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ইহজীবনে কবির মৃত্যু হলেও তাঁর স্বরচিত কবিতার মাধ্যমে তিনি আজও বেঁচে আছেন। আর তাঁর রেখে যাওয়া কবিতা প্রতিনিয়ত মুসলিম উম্মাহকে জাগরিত করবার মন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। আজ কবির ১০২ তম জন্মদিন। আমরা দুআ করি, আল্লাহ যেন তাঁর ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। সেইসাথে তিনি ইসলাম ও মুসলিমদের খেদমতে যে অসমান্য অবদান রেখে গেছেন সেগুলো কবুল করেন। আমিন।

পঠিত : ৬০৭ বার

মন্তব্য: ০