Alapon

মসজিদে আয়া সোফিয়ার আর্তনাদ !!



ইতিহাস ঐতিহ্যের মিলনমেলা ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুল প্রণালীকে ঘিরে থাকা নয়নাভিরাম এই শহরের পবিত্র স্থান হচ্ছে মসজিদে আয়া সোফিয়া। খ্রিস্টানদের পবিত্র এই ভূমিকে মুসলিমদের অধিকারে নিয়ে আসেন ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি সুলতান ফাতিহ মাহমুদ। কোন এক কবি বলেছিলেন- “পুরো দুনিয়া যদি একটি দেশ হতো তাহলে সেই দেশের রাজধানী হতো ইস্তাম্বুল”। সেই ইস্তাম্বুলের প্রতীক হচ্ছে আয়া সোফিয়া। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আয়া সোফিয়া এবং ইস্তাম্বুলের মর্যাদা প্রধান তিন শহরের(মক্কা,মদীনা, কুদুস) পরেই। ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী ভাবধারার দিক দিয়ে এতোটাই মর্যাদাসম্পন্ন একটি মসজিদ এটি। কেননা পুরো ইউরোপে ইসলামের বাণী ছড়িয়েছিল এই মসজিদ। ইউরোপের মজলুম মানুষের আস্থা বিশ্বাস ও ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজব্যবস্থার প্রতীক ছিল এই আয়া সোফিয়া।। অথচ প্রায় শত বছর থেকে এই মসজিদটি সেজদার স্থান থেকে জাদুঘরে পরিণত হয়ে আছে।

ইতিহাসঃ
বিভিন্ন তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি, ৫৩২ থেকে ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত সম্পূর্ণরূপে নির্মিত হয়েছিল ইস্তাম্বুলের এই কেন্দ্রস্থল। সেই থেকে পরবর্তী প্রায় ১ হাজার বছর পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের পবিত্র ভূমি হিসেবে চিহ্নিত ছিল এই ভূমি। বিশ্বনবীর বিখ্যাত এক হাদীসের অনুপ্রেরণা নিয়ে মুসলিমরা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছিলেন এই ভূমিকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য। বিখ্যাত সাহাবী আবু আইয়ুব আল আনসারী (রা) এই ইস্তাম্বুল জয়ের জন্য ৯০ বছর বয়সে বেরিয়ে পড়েছিলেন জিহাদের উদ্দেশ্যে।

খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের এই কেন্দ্রস্থল ছিল মূলত জুলুমবাজ একটি সিস্টেমের রাজধানী। সেলজুক সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা আনাতোলিয়াতে একের পর এক হামলা করে মুসলিম এলাকার শান্তি নষ্টের পায়তারায় সর্বদা লিপ্ত ছিল রোম। হযরত ওমরের কাছে হারানো রোমান সাম্রাজ্যের হারানো অংশ পুনরুদ্ধারের জন্য এই আক্রমণ বছরের পর বছর জারী ছিল। খ্রিস্টান সাম্রাজ্য তাদের পূর্বের সেই রোমকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য বার বার আক্রমণ করছিল। মূল লক্ষ্য ছিল কুদুস তথা আল আকসা। তাই ক্রুসেডের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি ছিল বাইজেনটাইনদের এই রাজধানী।

অবশেষে খ্রিস্টানদের এই হেডকোয়ার্টারকে দখলে নেয়ার পরিকল্পনা করেন তরুন শাসক সুলতান ফাতিহ মাহমুদ। ১৪৫৩ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে খ্রিস্টানদের আক্রমণের প্রতিউত্তরে হামলা করেন সুসজ্জিত একটি বাহিনী নিয়ে। দুর্ভেগ্য কেল্লা হিসেবে খ্যাত ইস্তাম্বুলের প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ে প্রচন্ড আক্রমণের মুখে।

ইস্তাম্বুল বিজয়ের পরেই আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করেন সুলতান ফাতিহ মাহমুদ এবং প্রথম জুম’আ আদায় করেন সেখানে। এরপর থেকে এটি হয়ে উঠে মুসলিম সভ্যতার অন্যতম একটি প্রতীক। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা পর্যন্ত সম্প্রসারনকারী ইসলামী সভ্যতার উসমানীদের কেন্দ্রস্থল ছিল এই মসজিদে আয়া সোফিয়া। এশিয়ার কেন্দ্র ছিল মক্কা, মদীনা এবং কুদুস। অপরপাশে উপমহাদেশে মোঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল দিল্লী এবং বাবরী মসজিদ। এসব হচ্ছে ইতিহাসের অংশ।
প্রত্যেকটি স্থান হচ্ছে আমাদের জযবা এবং আমাদের জিহাদী চেতনার অবিচ্ছেদ্য একটি অঙ্গ। ঐতিহ্যময় সেই স্থানসমূহ থেকে সেজদার চিহ্ন তুলে দিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে ক্রুসেডাররা এবং ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীরা। আমাদের গাফলতির দরুন তারা অনেকাংশে সফলও হয়েছে।

প্রথম আঘাত এসেছে কুদুসের উপর। সালাহউদ্দীন এবং সেলজুক সুলতানদের কারণে উদ্ধার হয়েছিল পবিত্র এই ভূমি। অবশেষে বিংশ শতাব্দীতে আঘাত আসে মসজিদে আয়া সোফিয়ার উপর। তবে এবার সরাসরি আক্রমণ নয়, পরোক্ষ আক্রমণ। ক্রীড়নক জাতীয়তাবাদী চেতনার মুসলিম নামধারী এক শাসক। ইসলামী ভাবধারাকে মুছে ফেলতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক।

মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তরঃ
মসজিদে আয়া সোফিয়া থেকে দীর্ঘ ৫ শত বছর ধ্বনিত হওয়া প্রতিটি আযানের ধ্বনি যেন রোমানদের কলিজাকে খঞ্জরের ধারালো আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিত। মুসলিমরা যখন মসজিদে আয়া সোফিয়াতে সেজদা দিত তখন রোমের ভেতরে অবস্থানরত পোপদের অন্তর ফেটে চৌচির হয়ে যেত। ইউরোপ শতাব্দীর পর শতাব্দী চেষ্টা করেছে কীভাবে মসজিদে আয়া সোফিয়াকে পুনরায় চার্চে পরিণত করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বপরিস্থিতি পালটে যায়। উসমানী খেলাফত ভেঙ্গে যায়। জাতীয়বাদী একটি গোষ্ঠী ক্ষমতায় বসে। দেশের প্রধান মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। শর্তসমূহ পরিবর্তিত হতে থাকে। মসজিদে আয়া সোফিয়াকে চার্চে পরিণত করা অসম্ভব হয়ে উঠে ইউরোপের পক্ষে। তাই এবার পলিসি চেঞ্জ করা হলো। চার্চ না হলেও যেন অন্তত সেখানে মানুষ নামায আদায় করতে পারে সে ব্যবস্থার জন্য উঠে পড়ে লাগলো।

১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও মসজিদে আয়া সোফিয়াতে কোন ধরণের হস্তক্ষেপ করা হয় নি। নামায এবং আযানের ধ্বনিতে তখনও মুখরিত তুরস্কের আকাশ। ১৯৩০ পর্যন্ত তেমন কিছু হয় নি। অতঃপর হুট করেই সূক্ষ্ম কৌশলে একের পর এক ইসলাম বিরোধী আইন চালু করা শুরু করে তার্কিশ সরকার।

সূক্ষ্ম নীল কৌশলঃ
অতি সূক্ষভাবে মসজিদে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়। প্রথম হামলা আসে মনস্তাত্বিকভাবে। সেজন্য তৎকালীন সময়ের সরকারী পত্রিকা সমূহ আয়ো সোফিয়াতে কার অধিকার বেশি? সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে। একের পর এক সেমিনার করে আলোচনা করে পত্রিকায় শিরোনাম করে মসজিদে আয়া সোফিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।


মসজিদে আয়া সোফিয়ার শিল্পকর্ম উদ্ধারে Thomas Whittemore

অতঃপর ১৯৩০ সালে আতাতুর্ক আমেরিকা থেকে আর্কিওলজিস্ট থমাস হোয়াইটমোরকে(Thomas Whittemore) আমন্ত্রণ করেন তুরস্কে। উল্লেখ্য, সুলতান ফাতিহ মাহমুদ, মসজিদের অভ্যন্তরে যেসকল চিত্র অঙ্কিত ছিল সেগুলোকে ঢালাই করে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
আতাতুর্কের আমন্ত্রণে তুরস্কে আসা থমাস সেসকল চিত্রকর্মসমূহের উপর ঢালাই দেয়া আস্তর তুলতে শুরু করেন ধীরে ধীরে। এভাবে পূর্বের অঙ্কিত চিত্রাংকনসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক।

আস্তর সরানোর কাজে নিয়োজিত কর্মীরা

টানা ৩ বছর এর পেছনে খেটে যান তিনি। সেই সাথে দক্ষ একটি দল রাত দিন পরিশ্রম করে খ্রিস্টানদের অংকিত চিত্রসমূহকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য।

টানা তিন বছর মসজিদে আয়া সোফিয়ার ভেতরকার চিত্র এরকম ছিল যে- থমাসের কর্মীদল এক পাশে খোদাই কাজে ব্যস্ত সারাক্ষণ, অপরপাশে আযানের পর মুসল্লিরা ব্যস্ত নামায আদায়ে।
কিন্তু ১৯৩৩ সালের পর মসজিদে আয়া সোফিয়াতে নামায আদায় এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে মুসলিমদের জন্য।

কারণ পূর্বে ঢালাইকৃত হযরত ঈসা এর ছবি, মারঈয়াম (আ) এর ছবি সহ অন্যান্য ছবি সমূহ সম্পূর্ণরূপে আবারও প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এছাড়াও সকল ধরণের ছবি ও চিত্রকর্ম প্রকাশের ফলে মসজিদে নামায আদায়ের এক দুরহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
মসজিদে কোন ধরণের ছবি থাকাটাই তো মসজিদের শানে বেয়াদবি এবং এসকল ছবি যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ কোন মুসলিম অতি স্বাভাবিকভাবেই মসজিদে আয়া সোফিয়াতে নামায আদায়ের জন্য যাবে না।
এই সূক্ষ্ম কৌশলের মাধ্যমে মুসল্লিদেরকে আয়া সোফিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। একই সাথে এই মসজিদে কার অধিকার বেশি?? মুসলিমদের নাকি খ্রিস্টানদের?? এরকম একটি বিতর্কের জন্ম দেয়া হয় সেক্যুলার সরকারের পক্ষ থেকে। যুক্তি দেখানো হয় যে- “আয়া সোফিয়া প্রায় ১০০০ বছর খ্রিস্টানদের গীর্জা হিসেবেই ছিল। পরবর্তী ৫০০ বছর তা মুসলিমদের মসজিদ হিসেবে ছিল। সেক্যুলার একটি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদেরকে দুই ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে”।
এ ধরণের যুক্তিতে এবং প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে তুর্কি জাতি। একই সাথে মসজিদে বিভিন্ন ধরণের শিল্পকর্ম ও চিত্রের আবির্ভাবের ফলে নামায আদায় করা মুসল্লিদের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে আসে।

অবশেষে ১৯৩৪ সালের ২৪ শে নভেম্বর মসজিদে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার আদেশ জারী করেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে থাকা তুরস্ক সরকার। মূল কারিগর থমাস হোয়াইটমোর। আয়া সোফিয়াকে কি ইউরোপের পক্ষ থেকে প্রেশারের কারণে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে করে নাকি তুরস্ক সরকার নিজ উদ্যোগেই করেছে এ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে তুরস্কের ঐতিহাসিকদের মধ্যে।

তবে যেহেতু আমেরিকান বিশেষজ্ঞরাই ছিল খোদাইকর্মের মূল হোতা সুতরাং বলা যায় এর পেছনে ইউরোপের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ছিল। আর জাদুঘরে পরিণত করার এই আদেশটি ছিল ইউরোপের পক্ষ থেকে মুসলিম মানসে সরাসরি আঘাত। তুরস্কের মুসলিমদের জন্য তা ছিল ভয়ংকর এক দিন। কেননা ইউরোপ যেখানে দীর্ঘ ৫০০ বছর সাহস করেনি কখনো আয়া সোফিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকানোর, সেখানে একটি মুসলিম দেশের শাসকই এই মসজিদকে জাদুঘরে পরিণত করার আদেশ প্রদান করে।

আয়া সোফিয়া এবং প্রফেসর এরবাকানঃ
তুরস্কের রাজনীতিতে আয়া সোফিয়া সদা সর্বদা একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য আয়া সোফিয়া চেতনার একটি জায়গা। দীর্ঘদিন আয়া সোফিয়া নিয়ে তুরস্কের জনগণ তেমন একটা কথা বলে নি। কেননা আয়া সোফিয়ার অভ্যন্তরীণ অবস্থার আলোকে তা নামাযের জন্য অনুপযুক্ত।
ভেতরে বিভিন্ন ছবি ও চিত্রকর্ম জলজল করছে। তাই সেখানে নামায আদায় করা দুঃসাধ্য।

একটাই সমাধান!!! সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে মসজিদে পরিণত করার এলান করা। একই সাথে সকল চিত্রকর্মকে পূর্বের ন্যায় ঢালাই করে ঢেকে দেয়া। কেবলমাত্র এরপরই নামায আদায় সম্ভব।

১৯৭৪ সালে তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশের প্রধান প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান উপপ্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তিনি তুরস্কের জনগণের সামনে এ বিষয়টি তুলে ধরেন। জনগণকে জাগ্রত করে তোলেন। উসমানী রণসংগীতের প্রচলন করেন আবারও। বিভিন্ন সমাবেশে আমরা সুলতান ফাতিহের উত্তরসূরী এধরণের স্লোগান তৈরী করেন। ‘সুলতান ফাতিহের দেয়া মীরাস আমাদের আমানত’ এরকম পরিভাষা তৈরী করেন। আয়া সোফিয়ার সামনে ছাত্রসংগঠনকে দিয়ে ফাতিহ নামাযের আয়োজন করেন। এভাবে পুরো তুরস্কের জনগণের মধ্যে আবারও মসজিদে আয়া সোফিয়ার প্রতি জযবা বাড়তে থাকে। প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকানের ভোট ছিল মাত্র ৯%। তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই জনগণকে উজ্জীবিত করার ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় ছিল না। মানুষকে তার ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া ভিন্ন অন্য কোন পথ ছিল না।

প্রফেসর এরবাকান জাতিকে জাগ্রত করার জন্য ঐতিহাসিক এক উক্তি করেছিলেন- ইসলাম যদি তাসবীহ তাহলিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে আবু আইয়ুব আল আনসারী(রাঃ) ৯০ বছর বয়সে ইস্তাম্বুল বিজয়ের অভিযানে শামিল হতেন না”
তিনি তার প্রত্যেকটি কথায় ইসলামী ভাবধারা ও ঐতিহ্যকে তুলে এনে জনগণের মনে একথা গেথে দিয়েছিলেন যে- “মসজিদে আয়া সোফিয়া আমাদের পূর্ব-পুরুষদের রেখে যাওয়া মীরাস। এটি রাসূলের হাদীসের মীরাস, এটি আইয়ুব আল আনসারীর মীরাস। এটি আমাদের জযবা ও জিহাদী সুরের ঐক্যতান”

সেই থেকে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার জোর দাবী উঠে। ৭০ এর দশকের যুবকেরাই ৯০ এর দশকে এসে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্টিত। আয়া সোফিয়ার প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়তে থাকে। অবশেষে ৯৬ তে আবারও ক্ষমতায় আসেন নাজমুদ্দিন এরবাকান। এবার জনগণ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার স্বপ্ন দেখা শুরু করে।
সমস্যা আবারও সেই ভোট। প্রফেসর এরবাকান প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও উনার ভোট ছিল ২১.৪%। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করা কেবল মাত্র ৫০% এর উর্ধ্বে সংসদে ভোট পেলেই সম্ভব। সংসদের না ভোটে সেবারও থেমে যায় মসজিদে পরিণত করার পদক্ষেপ।

আয়া সোফিয়া ও বর্তমান রাজনীতিঃ
২০০২ সালে যখন এককভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে একে পার্টি সরকারে বসে তখন থেকে জনগণ সরকারের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। সংসদের ভেতরে ৫০% এর অধিক সাংসদ একে পার্টির। সাংবিধানিকভাবে এই আইন রহিত করার জন্য ৫০%-ই যথেষ্ঠ। সরকার চাইলেই এই দাবী পূরণ করে নিতে পারবে। কেননা ভিন্ন পার্টি থেকে অন্যরাও আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার পক্ষে।

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রতি জনগণের আশা বেড়ে যায় অনেক। ২০১৭ সালের পর থেকে দেশের সকল ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হয়ে যান এরদোয়ান। তাই মানুষের আশার পারদ আরও বাড়তে থাকে।


প্রতিবছর তুরস্কের ছাত্রসংগঠনের আয়োজিত আয়া সোফিয়ার ফাতিহ নামাযে হাজারো জনতার অংশগ্রহণ

একই সাথে প্রফেসর এরবাকানের সেই ফাতিহ নামায জারী থাকে প্রত্যেক বছর। জনগণ সেই ধারা বজায় রেখে আয়া সোফিয়ার সামনে নামায আদায় করতে থাকে এবং সরকারকে আয়া সোফিয়া খুলে দেয়ার দাবী জানায়। জনগণের দাবী নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন সরকারের কাছে দাবী জানায় যেন খুব শীঘ্রই তা মসজিদে পরিণত করা হয়।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান তুরস্ক সরকার কোন এক অজ্ঞাত কারণে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার পক্ষে কোন ধরণের পদক্ষেপ নেয় নি বিগত ১৮ বছর।

২০১৮ সালের মার্চ মাসে জনগণের পক্ষ থেকে জোর দাবী উঠে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সমাবেশে।

আয়া সোফিয়ার পাশেই অবস্থিত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নির্মিত চামলিজা মসজিদ

সেখানে তিনি জবাবে বলে- “প্রথমে সুলতান আহমেদ মসজিদ পূর্ণ করো। পরবর্তীতে দেখব আয়া সোফিয়ার ব্যাপারে। এসকল খেলায় আপনারা অংশগ্রহণ করবেন না। এ এলাকায়(আয়া সোফিয়াতে) আপনাদের আসার প্রয়োজন নেই। পাশে চামলিজা মসজিদ আছে সেখানে ৬০ হাজার মানুষ নামায আদায় করতে পারে। সেখানে যান”
(https://www.milligazete.com.tr/haber/1920390/erdogandan-ayasofya-camii-aciklamasi-sultanahmeti-doldurun-bakariz)

তবে এবার আশা দেখতে শুরু করেছে জনগণ। পুরো বিশ্বও তাকিয়ে আছে কেননা সম্প্রতি তুরস্কে আবারও আয়া সোফিয়া নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আগুনঝরা বক্তব্যে সকলেই আবারও আশান্বিত। কিন্তু গতকাল সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে সরকারী দল ও তার জোট।
গণমানুষের চাহিদার প্রেক্ষিতে গতকাল ৯/০৬/২০২০ সংসদীয় তারিখে জাতীয়বাদী দল ইয়ি পার্টি কর্তৃক সংসদে আয়া সোফিয়াকে “মসজিদে পরিণত করার” জন্য প্রস্তাবনা প্রদান করা হয়। সংসদে প্রস্তাবনাটির পক্ষে মতামত প্রদান করে IYI(ইয়ি) পার্টি এবং CHP.
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকারী দল একে পার্টি, MHP এবং এইচডিপি এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে ভোট প্রদান করে। অর্থাৎ না ভোট প্রদান করে সরকারী জোট।
সরকারী দল একেপির মুখপাত্র মেহমত মুশ বলেন- “আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার যে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে সংসদে তার বিপক্ষে আমরা না ভোট প্রদান করছি। বর্তমানে একটি মামলা চলমান রয়েছে। জুলাইয়ের মধ্যে এর রায় ঘোষণা হবে। মামলার রায়ের পর পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করব”।
(https://www.hurriyet.com.tr/gundem/son-dakika-haberler-ak-partiden-flas-ayasofya-aciklamasi-41537540)

যদিও অপরদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কয়েকদিন আগে গ্রীসকে লক্ষ্য করে বলেছেন- “তুরস্কের আয়া সোফিয়ার ব্যাপারে আপনাদের নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। তুরস্ককে আপনারা পরিচালনা করেন না। আমরা পরিচালনা করি”।

একটি বিষয় পরিস্কার যে- “আয়া সোফিয়ার ক্রেডিট এখন সকলেই নিতে চাচ্ছে। সরকার চাইলে হ্যা ভোট প্রদান করতে পারতো। কিন্তু এখানে ক্রেডিট হতো ইয়ি পার্টির। মামলার বিষয়টি গৌণ। কেননা পুরো সিস্টেম সরকারের পক্ষে। যেখানে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে আয়া সোফিয়াকে নিয়ে চলমান মামলা তো ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। প্রস্তাবনাটি সাংবিধানিক ভাবে করা হয়েছে। আয়া সোফিয়াকে সরকারী আদেশে এবং সংসদের প্রত্যক্ষ ভোটেই জাদুঘর থেকে মসজিদে পরিণত করা যাবে, ঠিক যেভাবে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল”

আয়া সোফিয়া কে কী মসজিদে রূপান্তর অদৌ সম্ভব??
হ্যা সম্ভব। যদি সরকার সদিচ্ছা পোষণ করে। কেননা বর্তমানে সকল দল আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার পক্ষে। গতকালের ভোটেই তো CHP এবং ইয়ি পার্টি আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার প্রস্তাবনা দিল। সরকারী দল চাইলে ব্যাপারটা আরও দ্রুত সম্ভব হত। কিন্তু রাজনীতিতে ক্রেডিট অনেক বড় বিষয়। তাই তাদের দেয়া না ভোটে ব্যাপারটি পিছিয়ে গেল আপাতত।
তবে সকলেই আশাবাদী যেহেতু বিরোধীদলের কাছ থেকে এবার সরাসরি প্রস্তাব এসেছে। তাই অতি দ্রুত আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করা সম্ভব যদি সরকার প্রধান চান। কেননা দিনশেষে বর্তমানে একমাত্র তারই এই ক্ষমতা আছে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের অধীনে।

সংসদে বিরোধীদল কর্তৃক মসজিদে পরিণত করার প্রস্তাবনা জুলাইয়ের পর পাশ হলে হয়তো নতুন এক যুগের সৃষ্টি হবে তুরস্কের মাটিতে। এখনই সুযোগ সকলের মতামতকে কাজে লাগিয়ে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার।

জনগণের আকাঙখা একটিই- “রাজনীতি করে যে দলই ক্রেডিট নিয়ে যাক কোন সমস্যা নেই। সরকার অথবা বিরোধীদল যেই ক্রেডিট নিক না কেন, আয়া সোফিয়ে মসজিদে পরিণত হলেই জনগণ খুশী”।

মসজিদে আয়া সোফিয়া আজও হাহাকার করছে সেজদার জন্য। লক্ষ মানুষের আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে আয়া সোফিয়া প্রায় ৮৬ বছর থেকে!!

বর্তমানের এই সুযোগ যদি তুরস্কের সরকার কাজে না লাগায় তাহলে এরপর আবার কবে রাজনৈতিকভাবে সকলের ঐক্যমত পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দিহান অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরা।

প্রশ্ন এখন একটাই-
এবার কী আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে পরিণত করার মাধ্যমে নতুন এক যুগের সৃষ্টি হবে?? নাকি মসজিদে আয়া সোফিয়ার আর্তনাদ আরও প্রলম্বিত হবে??

এখন শুধু অপেক্ষার পালা!!!

পঠিত : ২৫৭৮ বার

মন্তব্য: ০