Alapon

মক্কা-মদিনায় তুর্কি ক্ষমতায়ন ও গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের অবদান...


বর্তমান সৌদি আরব ধনী হবার আগ পর্যন্ত মক্কা-মদিনার অর্থনৈতিক অবস্থা স্বচ্চল ছিলনা। হাজিদের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা, হারামের উন্নয়ন কাজের জন্য যে অর্থের দরকার হত; তা তদানীন্তন দুনিয়ার মুসলিম দেশগুলো সামর্থ্য অনুসারে অংশ নিত। বাংলার সুলতানি আমলে মসজিদুল হারামের উন্নয়ন কাজে সর্বাধিক সহযোগিতা বাংলাদেশ থেকে যেত। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪১০) মক্কার উম্মে হানি ফটকের অদূরে ও মদিনার হুস্ন-আল-আতিক নামক স্থানে, দুটো মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসা দুটোর জন্য জমি ক্রয়, ভবন নির্মাণ সহ যাবতীয় খরচ তিনি বহন করতেন যার কারণে মাদ্রাসা দুটো 'গিয়াসীয়া' এবং বাঙ্গালিয়া মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত ছিল। আরাফা সংস্কারের জন্য বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ মূদ্রা বাংলা মুল্লুক থেকে গিয়েছে। তথ্যগুলো এ কারণে তুলে ধরা হল, প্রথমত আমাদের গৌরব ও সন্তোষ প্রকাশ করা; দ্বিতীয়ত মসজিদুল হারামের সমস্যা গুলোর একটি ঐতিহাসিক দলিল পেশ করা। আজ মক্কা-মদিনায় সৌদি আরবের যে একক পৃষ্ঠপোষকতা দেখতে পাই, তা দুইশত বছর আগেও এমন ছিল না। সেখানকার কর্মকাণ্ডে বাহিরের ধনী মুল্লুকের অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত ছিল।

তুর্কি সুলতান ফাতেহ আল মাহমুদের (১৪৩২-১৪৮১) ঐতিহাসিক কনস্টান্টিনোপল তথা ইস্তাম্বুল নগরী বিজয়ের পর থেকে তুর্কিরা সমর, শিক্ষা, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রতিটি সেক্টরে সমৃদ্ধি অর্জন করে। সুলতান ফাতেহ মাহমুদ, রাসুল (সা) এর একটি ভবিষ্যৎ বানী বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি ছিলেন আলেম, গাজী, যোদ্ধা, সাহিত্যিক এবং বিশ্ববিখ্যাত সমর কৌশলীদের একজন। সারা দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য তিনি একটি দৃষ্টান্ত ও বীর হিসেবে পরিগণিত হন। ইউরোপের মুসলিম বিরোধী শক্তিগুলোর দম্ভকে তিনি বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন। ইউরোপের বিরাট অঞ্চলে তিনি ইসলামের বাণী পৌঁছিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদে ইউরোপে আনন্দের বন্যা বইতে থাকে! ভেনিস নগরীতে ঘোষণা করা হয় "লা গ্রান্দে একুইলা এ মরতা!" (মহান ঈগল মৃত)। তিনি তুরস্কের মাটিতে ইসলামের বুনিয়াদকে শক্ত ভিত্তর উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

নবম উসমানীয় সুলতান তথা ইতিহাসের প্রথম সেলিমকে (১৪৬৫-১৫২০) বলা হয় উসমানীয় প্রথম খলিফা। তার আমলেই তুর্কি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে। শাহ ইসমাইল এক শিয়া ফেতনা জন্ম দেয়। তিনি ইরান থেকে মধ্য এশিয়া অবধি সুন্নি বিরোধী এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এটা ইসলামের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দেয়, ১৫১৪ সালে তিনি সাফাভি ইসমাইল শাহকে রুখে দেন। তৎকালীন পর্তুগাল মক্কা-মদিনা ধ্বংসের হুমকি দিলে পর, সুলতান সেলিম মিশরের মামলুক সালতানাতের সহযোগিতা চান। তারা সহযোগিতা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন অধিকন্তু তিনি জানতে পারেন তলে তলে তারা পর্তুগালের পক্ষের শক্তি। ফলে তিনি মিশর জয় করে নেন এবং লোহিত সাগরে ভেসে আসা পর্তুগীজদের জেদ্দার উপকুলে মোকাবেলা করে তাদেরও পরাজিত করে। এর পর পরই সিরিয়া, ফিলিস্তিন, হেজাজ সহ বিরাট মুসলিম অঞ্চলকে এক করে তিনি ১৫১৭ সালে 'খাদেমুল হারামাইন' তথা দুই হারামের সেবক উপাধি নিয়ে মক্কা-মদিনার রক্ষক হিসেবে অভিভূত হন। সেই থেকে মক্কা-মদিনা তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং শুরুর দিকের শাসকেরা ছিল উত্তম খাসিয়তের। তারা সবাই ছিল সুন্নি মতাদর্শের শাসক।

মানব রচিত প্রতিটি দর্শনের একটি শেষ আছে। উত্তম রাজ্য শাসনের প্রবল ধাক্কাও এক সময়ে থেমে যায়। উমাইয়াদের শাসন ব্যবস্থা শুরুর দিকের চেয়ে শেষের দিকে দুর্বল ছিল, সেভাবে আব্বাসী শাসনেও শুরু আর শেষের মধ্যে পরিষ্কার তফাত পরিলক্ষিত হয়। এটাই নিয়ম, বহু গ্রহণযোগ্য শাসকের উত্তম শাসন ব্যবস্থাও একসময় হোঁচট খায়। তুর্কিরাও তার বাহিরের কেউ ছিল না। শত শত বছরের শাসন ব্যবস্থার দরুন, যে দেশ ফাতেহ মাহমুদ আর সেলিমের মত শাসক উপহার দিয়েছিল। মক্কা-মদিনা থেকে বিতাড়িত হবার সময়, তাদের শেষ শাসকদের চরিত্র থেকে ইসলামের ন্যুনতম নির্যাস বের করাটাই দূরহ কর্মে পরিণত হল!

আজকের দিনে তুর্কি জাতি বলে বদনাম দিয়ে ঘৃণা করতে গিয়ে, সারা জাতিকে গালি দেওয়া হয়। আবার বেকুব-অকর্মা দালাল বলে আরবি শাসকদের সমালোচনা করা হয়! দুটোই ভুল ও ভ্রান্ত নীতি। আমরা ব্যক্তির ভুল গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারি কিন্তু বিশেষ কয়েকজনের পরিণামের জন্য পুরো জাতিকে কলঙ্কিত করতে পারি না। এটাও বর্ণবাদের একটি শাখার মত, যা ইসলাম মোটেও সমর্থন করেনা। কেননা আমরা আবু জেহেল আবু লাহাবের কর্মের জন্য আরবী জাতিকে অপবাদ দেই না। কর্ম অনুসারে মানুষ কিংবা সেই শাসনকালকে বিশ্লেষণ করলে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে, বর্ণ হিসেবে বিশ্লেষণ করলে হিংসা-ঘৃণা বাড়ে। যা আমরা আজকের মুসলিম দুনিয়ায় দেখতে পাই। ভূতলে আছড়ে পড়া বাঙ্গালীদের জন্য গৌরব করতে যেভাবে গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ ছিল তেমন তুর্কিদেরও নূর উদ্দিন, ফাতেহ মাহমুদ ও সেলিমের মত খ্যাতিমান ব্যক্তিও ছিল। তাই চলুন বর্ণবাদি ঘৃণার অভ্যাস না বাড়িয়ে, মানুষের চরিত্র ও সমকালীন শাসন ব্যবস্থা দিয়ে সমাজের সমস্যা গুলো চিহ্নিত করি।

-Tipu

পঠিত : ৫৬২ বার

মন্তব্য: ০