Alapon

মার্টিন লুথার, চিন্তারাজ্যর বিবর্তন ও নতুন চিন্তাধারার উত্থান...


১৬শ শতকে ইউরোপ মহাদেশে জার্মান ধর্মযাজক মার্টিন লুথার কোনো এক অন্যায় করার কারণে প্রচণ্ড পাপবোধে ভুগছিলেন। কী অন্যায় করেছিলেন তিনি, তা মুখ্য নয়। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে তিনি ভাবতেন যে, তিনি এতটাই পাপিষ্ঠ যে নরকে যাওয়া ছাড়া তার আর বাঁচার কোনো উপায় নেই।

খ্রিষ্টান ধর্মানুসারে পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করলে তার সব পাপ ধুয়ে যাওয়ার কথা। তিনি তাও করলেন। কিন্তু তারপরও তিনি পাপবোধ থেকে মুক্তি পেলেন না। তিনি সকল চেষ্টাই করলেন। উপবাস করলেন, নিজেকে বেত্রাঘাত করে কষ্ট দিলেন, প্রতিদিন প্রার্থনায় অংশ নিলেন, অসংখ্যবার প্রায়শ্চিত্ত করলেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। যখন গির্জার যাজকেরা তাকে পবিত্র হিসেবে ঘোষণা করলেন লুথার সেই যাজকের কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি তার অন্তরের দিক থেকে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি অনুভব করছিলেন, তিনি এখনও বিশুদ্ধ হতে পারেননি। তিনি এটা অনুভব করছিলেন, কারণ পাপবোধ তখনো তাকে আগের মতোই গ্রাস করেছিল।

তখনই একটি নতুন ভাবনা লুথারকে পেয়ে বসল। তিনি বুঝতে পারলেন তার মুক্তি কখনোই হবে না যতক্ষণ না তিনি নিজে বিশ্বাস করতে পারছেন, তিনি পাপমুক্ত হয়েছেন। যদি তার এই বিশ্বাসটি না আসে বা বিশ্বাসে কোনো কমতি থাকে, তাহলে যাজকেরা কী বলল বা তাকে কতবার পবিত্র বলে ঘোষণা দিলো, তাতে তার কিছুই যায় আসে না। আর তিনি যদি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তিনি এখন পবিত্র! তাহলে যাজকেরা তাকে হাজারবার অপবিত্র বললেও তার কিছু আসে যায় না। তাহলে বিরাট একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই জাগে, আর তা হলো যাজকদের প্রয়োজনটাই বা আসলে কী?

এই ভাবনা ক্রমশ আরও বিকশিত হলো। লুথার বুঝতে পারছিলেন, আত্মমুক্তি মাস শেষে বেতন পাওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। এটা হলো একটি উপহার। যা কেবল গ্রহণ করা যায়, অনুভব করা যায় আর তা করা সম্ভব নিরেট বিশ্বাস থেকে। এটা পুরোটাই অভ্যন্তরীণ হিসেব-নিকেস; মানসিকভাবে উপলব্ধি করতে হয়। বাইরের থেকে কিছু লোক দেখানো কাজ কর্ম করে সেই প্রাপ্তি অর্জন করা সম্ভব নয়।

এই অনুভূতিটি অর্জনের পর লুথার দেখলেন, তিনি মানসিক প্রশান্তি পাওয়ার যে প্রক্রিয়াটি উম্মোচন করলেন খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা তার পুরো উলটোটাই করছে। তারা তাদের ধর্মীয় আমলাতান্ত্রিকতাকে জারি রাখার জন্য কিছু কাজ আবিষ্কার করেছে এবং বলছে এর মাধ্যমেই মানুষেরা পাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে। আর এসব কাজের অনেকটাই অর্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ফলে সেই সুযোগে চার্চ এবং যাজকেরা অর্থশালী হয়ে উঠছে। তিনি দেখলেন যাজকদের চেইন অব কমান্ড যা ওপরে যেতে যেতে একেবারে রোমের চার্চ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, এদের সবাই একই ধরনের সমস্যার মধ্যেই ডুবে আছে।

চার্চরা সেই সময়ে পাপ মোচনের মধ্যে যেসব প্রক্রিয়ার কথা বলত, তার মধ্যে যেটি লুথারকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছিল অর্থের মাধ্যমে পাপ থেকে মুক্তি পদ্ধতি বিষয়টি।
এই প্রক্রিয়াটি এমন যে, চার্চরা দাবি করত যে তারা মানুষের পাপ মওকুফ করতে সক্ষম। কিন্তু এই জন্য তাদেরকে টাকা পয়সা বা মূল্যবান কোনো কিছু চার্চকে প্রদান করতে হবে। এই চর্চাটি আসলে শুরু হয়েছিল ক্রুসেডের সময় থেকে।
সেই সময়ে পোপ প্রচার করেছিলেন, যারা তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে তারা সকলে স্বর্গে যাবে।

অর্থাৎ নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে ধর্মকে ব্যবহার করার যে কৌশল তা শুরু হয় তখনই। ক্রুসেড যখন শেষ হয়ে গেল, তখন গির্জাগুলো সরাসরি অর্থের বিনিময়ে পাপ মুক্তির ব্যবসা শুরু করল। আর সেখান থেকেই গোটা চার্চ প্রশাসন এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত আমলাতন্ত্রে দুর্নীতি প্রবেশ করল। আর লুথারের সময়ে এসে বিষয়টি এমন হয়ে যায় যে, পাপী ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে প্রায়শ্চিত্ত করে টাকা-পয়সার বিনিময়ে তাদের স্বর্গে যাওয়ার নিশ্চয়তা কিনে নিতে পারত।

টাকার বিনিময়ে স্বর্গে যাওয়ার কৌশলটি নিঃসন্দেহে কূটকৌশল। আর লুথার মনে করতেন, পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার গোটা বিষয়টা যেহেতু মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে বিদ্যমান, তাই এখানে যাজকেরা একেবারে অন্যায়ভাবে টাকা পয়সা নিচ্ছেন। তারা মূলত ঈশ্বরকে ঘুষ দেওয়ার নামে নিজেদের পকেট ভারি করছেন। তারা মধ্যস্বত্বভোগী সেজে ঈশ্বর আর মানুষের মাঝখানে একটি দরজার পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন! অথচ সেই দরজাটি খোলার বা বন্ধ করা- কোনোটিরই ক্ষমতা তাদের নেই। লুথারের কাছে তাই এই টাকা নেওয়ার বিষয়টি শুধু দুর্নীতি ছিল না বরং তিনি এটিকে চুরি ও প্রতারণা মনে করতেন।
১৫১৭ সালের হ্যালোয়েন রজনীতে লুথার একটি ঐতিহাসিক কাজ করেন। তিনি উইটেনবার্গের একটি গির্জার দরজায় চার্চ প্রশাসনের দুর্নীতিকে ফাঁস করে তাদের বিরুদ্ধে ৯৫টি অভিযোগ সম্বলিত কিছু পোস্টার লাগান। লুথারের এই কাজটিতে রাতারাতি মারাত্মক প্রক্রিয়া হয়। আর এখান থেকেই প্রোটেস্ট্যান্ট নামক খ্রিষ্টান ধর্ম সংস্কার আন্দোলনটি শুরু হয়।

প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না। লুথার ধর্মীয় সংস্কারের এই পথটি উম্মোচন করার পর খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই চেতনাটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই নানা নামে একই আন্দোলন শুরু করল এবং নানা ধরনের ধর্মীয় ধারার সৃষ্টি হলো। প্রতিটি ধারারই তাদের মতো করে কিছু আদর্শিক বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে মোটামুটি চারটি বৈশিষ্ট্য খুব কমন ছিল।

যথা :
১. আত্মমুক্তির বিষয়টি দৃশ্যমান হতে হবে। যিনি পাপ থেকে মুক্তি পাবেন তার অভিজ্ঞতাটি এমন হতে হবে যেন, তিনি এইমাত্র এবং এই স্থানেই আত্মমুক্তি ও প্রশান্তি লাভ করলেন।
২. আত্মমুক্তির এই বিষয়টা হতে হবে কেবল বিশ্বাসের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় কোনো লেনদেন থাকবে না। স্রষ্টার সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তার মধ্যে অন্য কোনো লোকের কোনো প্রয়োজন নেই।
৩. স্রষ্টার সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তার মধ্যে অন্য কোনো লোকের কোনো প্রয়োজন নেই।
৪. মানুষের ধর্ম সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন তার সবই সে বাইবেল থেকেই পাবে। বাইবেল বোঝার জন্য তাদের ল্যাটিন ভাষা জানার কোনো দরকার নেই কিংবা চার্চ কাউন্সিলের মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই বা কোনো পাদ্রি বা খ্রিষ্ট্রীয় পণ্ডিতের কাছেও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

পশ্চিমে যারা ক্যাথলিক চার্চগুলোর বিরুদ্ধে সংস্কার আন্দোলন করেছিলেন তারা নতুন করে অন্য কোনো চার্চ বা গির্জা বা ধর্মীয় বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য সেই আন্দোলন করেননি। তারা মূলত ব্যক্তির ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তাদের সেই চাওয়া আসলে খ্রিষ্টবাদের মূল দর্শন থেকে খুব একটা ভিন্ন কিছু ছিল না। কারণ, খ্রিষ্টবাদও ব্যক্তিকে নিয়েই কথা বলে।

সম্ভবত মূল ধর্ম বিশ্বাসের যে নির্দিষ্ট কাঠামো তার বাইরে গিয়ে ভাবার কথা কোনো প্রোটেস্ট্যান্টইৃ সেটা নিয়েও প্রোটেস্ট্যান্টদের কোনো নির্দিষ্ট বক্তব্য ছিল না। প্রোটেস্ট্যান্টরা চাচ্ছিল, কারও মাধ্যমে না গিয়ে ব্যক্তি নিজেই স্রষ্টার সঙ্গে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে।

তথ্যসূত্রঃ ডেসটিনি ডেজরাপ্টেড, তামিম আনসারি।

পঠিত : ৩৯৭ বার

মন্তব্য: ০