Alapon

ডিপ্রেশন নিয়ে কিছু কথা...


ডিপ্রেশন মানে শুধু কিছু দিনের জন্য মন খারাপ, হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ নয়। বরং ডিপ্রেশন হচ্ছে এমন এক জটিল অসহায়বোধ, হতাশা, অবসাদ, যা মানুষের দেহ, মন, কাজে, চিন্তাভাবনায় ব্যাপক খারাপ প্রভাব ফেলে এবং সেটা বহুদিন ধরে চলতে থাকে।

আজকালকার আধুনিক সংস্কৃতিতে মগজ ধোলাই হওয়া কিশোর, তরুণদের মধ্যে ডিপ্রেশন এক মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। এই সংস্কৃতি মানুষকে আল্লাহর تعالى উপরে নির্ভর করা, তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং তার ভিতরে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং নিজের চাওয়া-পাওয়াকে যেভাবেই হোক পেতেই হবে — এমন একরোখা মানসিকতা তৈরি করে। যার ফলাফল: মানুষ ঘন ঘন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রিয়জনকে হারানোর বেদনায় অনেকে শোকে পঙ্গু হয়ে যান। মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর তাদেরকে একই কথা বলতে শোনা যায়, “আহারে, আমার বোনটা কী ভালো ছিল। আজকে যদি ও বেঁচে থাকত, কী খুশিটাই না হতো। আজকে ও থাকলে, এই মাছটা কী মজা করেই না খেত। আজকে ও থাকলে, আমাদের জীবনটা কত সুন্দর হতো। আজকে ও থাকলে, আমার সাথে এটা হতেই দিত না।…” — কী সব ভয়াবহ কথা ভাবি আমরা!

প্রথমত, কে কবে মারা যাবে, সেটা সম্পূর্ণ আল্লাহর تعالى ইচ্ছা এবং পূর্ব নির্ধারিত। আমরা কারও মৃত্যুর দিন একদিনও আগাতে পারি না, একদিনও পিছাতে পারি না।

দ্বিতীয়ত, আমরা কেউ কারো অভিভাবক নই। আমি আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখি না, তাদের সংস্থান যোগাড় করি না, তাদের দেখাশোনা করি না। আল্লাহ تعالى করেন। আল্লাহ تعالى তাঁর প্রতিটা সৃষ্টির রিজিকের (সংস্থানের) মালিক।

তিনিই তো আল্লাহ تعالى, যিনি ওদেরকে এবং তোমাকে খাওয়ান। তিনি সব শোনেন, সব ব্যাপারে সব কিছু জানেন। [আল-আনকাবুত ২৯:৬০]

কু’রআনে শুধু এই একটি আয়াত নয়, এরকম আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা আমাদেরকে স্ট্রেস, ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে—

চারিদিকে এত কষ্ট, এত কান্না — ভাবছেন আপনার কী দোষ??

তিনিই সেই সত্তা, যিনি মানুষকে হাসান এবং কাঁদান। তিনিই তো মৃত্যু দেন, জীবন দেন। [আন-নাজম ৫৩:৪৩]

তারা কি লক্ষ্য করে দেখে না যে, প্রতিবছর তাদের উপর দুই-একবার বিপদ আসছে? এরপরও ওরা তওবাহ করে না, উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না। [আত-তাওবাহ ৯:১২৬]

জীবনটা অতিরিক্ত কষ্টের মনে হচ্ছে? আর পারছেন না সহ্য করতে?

আল্লাহ تعالى কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা কখনো দেন না। প্রত্যেকেই যা ভালো করেছে তার পুরস্কার পায়, যা খারাপ করেছে তার পরিণাম ভোগ করে। [আল-বাক্বারাহ ২:২৮৬]

জীবনটা শুধুই কষ্ট, আর কষ্ট? কোনো ভালো কিছু নেই?

প্রতিটি কষ্টের সাথে অবশ্যই অন্য কোনো না কোনো দিক থেকে স্বস্তি রয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, অবশ্যই প্রতিটি কষ্টের সাথে অন্য দিকে স্বস্তি আছেই। [আল-ইনশিরাহ ৯৪:৫-৬]

আপনার বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হঠাৎ বিছানায় পড়ে গেলেন? দেখবেন আপনার ভাই নিজেই মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে ভালো ফল করছে। একইসাথে আপনার মা হিন্দি সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়ে স্বামীর সেবা করছে।
আপনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে চাকরি হারিয়ে ফেললেন? দেখবেন আপনার তরুণ ছেলেটা আরও বেশি সময় ঘরে থেকে বখাটে ছেলেদের সাথে মেশা কমিয়ে দিয়েছে, নিজেই চাকরির খোঁজ করছে। একইসাথে আপনার স্ত্রী হঠাৎ করে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেছে।
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى গ্যারান্টি দিয়েছেন যে, প্রীতিটি কষ্টের সাথে জীবনের অন্য কোনো না কোনো দিকে কমপক্ষে দুটো স্বস্তি আসবেই।

দেশে অরাজকতা, অশান্তি, অপরাধ দেখে সবসময় অকালে মৃত্যুর ভয়ে আছেন? ভাবছেন বিদেশে চলে যাবেন?

তুমি যেখানেই যাও না কেন, মৃত্যু তোমাকে ধরবেই। তুমি যদি অনেক উঁচু দালান বানিয়েও থাকো। [আন-নিসা ৪:৭৮]

বলো, “তোমরা যদি নিজেদের ঘরের ভিতরেও থাকতে, যারা খুন হবে বলে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তারা নিজেরাই বের হয়ে নিজেদের মৃত্যুর সাথে দেখা করতে যেত।” [আলে-ইমরান ৩:১৫৪]

আপনার কোনো নিকটজন অকালে প্রাণ হারালেন আর আপনি ভাবছেন— হায়, যদি সে অমুক করত, অমুক না করত, তাহলে সে বেঁচে যেত?

তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ বলে দাবি করো, ওই সব কাফিরদের মতো হয়ো না, যারা তাদের ভাইদের সম্পর্কে বলে (যখন তারা `ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েছিল, ভ্রমণে গিয়েছিল) “হায়রে, যদি তারা আমাদের সাথে থাকতো, তাহলে তারা মারা যেত না, খুনও হতো না।” আল্লাহ تعالى এই ধরনের চিন্তাভাবনাকে তাদের অন্তরে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার উৎস করে দেন। শুধুমাত্র আল্লাহই تعالى প্রাণ দেন, মৃত্যু ঘটান। তোমরা কী করো, তার সব তিনি দেখছেন। [আলে-ইমরান ৩:১৫৬]

অমুকের এত বাড়ি-গাড়ি-টাকা দেখে ভাবছেন, কেন তার মতো এমন নামে-মুসলিম কাজে-কাফিরের জীবন এত আরামের?

ওদের এত ধনসম্পত্তি, সন্তানসন্ততি তোমাকে অবাক করতে দিয়ো না। এগুলো দিয়ে আল্লাহ تعالى শুধুমাত্র ওদেরকে এই দুনিয়াতে পরীক্ষা নিতে চান, যেন তাদের আত্মা কাফির অবস্থায় এখান থেকে চিরবিদায় নেয়। [আত-তাওবাহ ৯:৮৫]

চাকরি হারিয়ে আপনার মাথায় হাত: কেন আপনার সাথে এমনটা হলো? কেন আপনার সন্তান এত গুরুতর অসুস্থ হলো? কেন আপনার বাবা এই দুঃসময়ে মারা গেলেন?

আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, সম্পত্তি, জীবন এবং ফসল হারানো দিয়ে পরীক্ষা করবই। জীবনে কোনো বিপদ আসলে যারা ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করে এবং বিপদে পড়লে সাথে সাথে বলে, “আমরা তো আল্লাহরই সম্পত্তি। আল্লাহরই কাছে আমরা শেষ পর্যন্ত ফিরে যাবো” — তাদেরকে সুসংবাদ দাও! ওদের উপর তাদের প্রভুর কাছ থেকে আছে বিশেষ অনুগ্রহ এবং শান্তি। এধরনের মানুষরাই সঠিক পথে আছে। [আল-বাক্বারাহ ২:১৫৫-১৫৭]

মনে রেখ, তোমার যা ধনসম্পদ আছে এবং তোমার সন্তানরা, এগুলো শুধুই তোমার জন্য পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। আর মনে রেখ, আল্লাহর تعالى কাছে রয়েছে অপরিসীম পুরস্কার। [আল-আনফাল ৮:২৮]

তারা কি লক্ষ্য করে দেখে না যে, প্রতিবছর তাদের উপর দুই-একবার বিপদ আসছে? এরপরও ওরা তওবাহ করে না, উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না। [আত-তাওবাহ ৯:১২৬]

বার বার কেন আপনার জীবনেই এত কষ্ট আসছে? কেন আল্লাহ تعالى এমন করছেন আপনার সাথে?

মানুষ কি ভেবেছে যে, তাদেরকে কোনো পরীক্ষা না করেই ছেড়ে দেওয়া হবে, কারণ তারা মুখে বলছে, “আমরা তো মুমিন!” [আল-আনকাবুত ২৯:২]

তোমরা কি ভেবেছিলে যে, তোমাদের মধ্যে থেকে কারা আল্লাহর تعالى পথে আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং কারা ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করে — সেটা আল্লাহ تعالى প্রকাশ না করে দেওয়ার আগেই তোমরা জান্নাত পেয়ে যাবে? [আলে-ইমরান ৩:১৪২]

যে-ই আমার পথনির্দেশ থেকে দূরে চলে যাবে, তার জীবন হয়ে যাবে ভীষণ কষ্টের। [ত্বাহা ২০:১২৪]

অশান্তিতে ছটফট করছেন? রাতে ঘুমাতে পারছেন না? ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন? ওষুধ খেয়েও মনে শান্তি আসছে না?

যাদের ঈমান আছে, তারা যখন আল্লাহর تعالى কথা ভাবে, যিকির করে, তখন তাদের মন শান্তি খুঁজে পায়। মনে রেখ, আল্লাহর تعالى কথা ভাবলে, যিকির করলে, অবশ্যই মন শান্তি খুঁজে পাবেই। [আর-রাদ ১৩:২৮-২৯]

তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ, ধৈর্যের সাথে চেষ্টা কর, এবং নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাও, কারণ আল্লাহ تعالى তাদের সাথে আছেন, যারা ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করে। [আল-বাক্বারাহ ২:১৫৩]

আসুন আমরা কু’রআনের আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কু’রআন দিয়েছেন এক আত্মিক নিরাময় হিসেবে। আমাদের অনেক মানসিক সমস্যার সমাধান রয়েছে কু’রআনে। নিয়মিত বুঝে কু’রআন পড়লে আমরা খুব সহজেই ওষুধের উপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারব, স্ট্রেস-ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হয়ে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারব — ইন শাআ আল্লাহ।

পঠিত : ৬৭০ বার

মন্তব্য: ০