Alapon

আলেমদের কাছে নিবেদন, ঐক্যের পাল তুলুন...


একটি যুগেরও আগে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি বাংলাদেশে সুনামী বয়ে গেছে। জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ দেশি বিদেশি শক্তির সহায়তায় কৌশলে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে। সে ঘটনার রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিশ্লেষণে যাবো না।

সে বছর কিন্তু প্রতিবছরের ন্যায় চট্টগ্রাম প্যারেড ময়দানে বিখ্যাত সেই তিনদিনব্যাপী তাফসির মাহফিল হয়নি। তখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্পেশাল ট্রাইবুনাল গঠিত হয়নি। শাহবাগ আন্দোলনেরও কোন গন্ধ ছিল না তখন। তারপরও সে বছর থেকেই চট্টগ্রামের সেই তাফসির মাহফিল বন্ধ হয়েছিল অনেকটা অঘোষিতভাবে, যদিও মাওলানা দেলোয়ার হোসেইন সাঈদি তখনও ‘দেইল্যা রাজাকার’ হননি।

বাংলাদেশের বুকে সেই থেকে বেগবান হয়েছে ডি-ইসলামাইজেশন কিংবা ইসলামের তথাকথিত মোডার্নাইজেশনের ধারা। অবাক কান্ড, নাইন ইলেভেনের পরবর্তি সময়ে আমেরিকার বিখ্যাত থিংকট্যাংক র্যান্ড কমিশনের লক্ষ্য ও সুপারিশও কিন্তু এমনটাই ছিল! সব রসুনের গোড়া এক জায়গায়। ইসলামের পূণর্জাগরণের যে কোন সম্ভাবনা রুখতে পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নে বৈশ্বিক সব পান্ডবরা একসুত্রেই বাঁধা!

এরপরে পদ্মা-মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে তা সবাই জানেন। অনেক আলেম ওলামা স্বাভাবিক নিয়মেই ইন্তেকাল করেছেন। অনেক আলেম ঘটনা-দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, নিখোঁজও রয়েছেন কেউ কেউ। এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, অনেক আলেম দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। গুমও হয়েছেন কেউ কেউ।

তবে সব আলেম এ দূর্গতির শিকার হননি। ডি-ইসলামাইজেশনের সহযোগী হয়েছেন জেনে বা না জেনে যে আলেম, ইসলামি আন্দোলনের কাজে মাঠে নামেন নি, হেকমতের নামে সরকারের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, কিংবা ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চলমান নানা ষড়যন্ত্র ও কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে টু’শব্দটি না করে নীরব থেকেছেন, গায়ে কাঁটার আঁচড়টাও পড়েনি!

মাথায় টুপি, সুন্নতি লেবাস আর কপালে সিজদাহর দাগ নিয়েও দূর্ণীতির বরপুত্র হিসেবে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন কিছু জবরদস্ত আলেম। একজন দরবারি আলেম’তো ক’দিন আগে ওপারে পাড়ি জমানোর পূর্বে ঘটা করে খেয়ানত করা জনগণের কয়েক কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়ে সততার উপমা রেখে গেলেন! শোনা যায় এরকম আরও কেউ কেউ আছেন। সদ্যমৃত সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর ভাষায় কিছু ‘হাড্ডি ছিটানো’র সুবাদে অনেকে বেশ আরামেই আছেন।অনেকের কপাল ফিরেছে, আলাদিনের চেরাগও জুটেছে! তা জুটুক, রিজকের মালিক যদি বেশুমার রিজিকের ব্যবস্থা করে থাকেন, তাতে কার কি?

তবে এ সময়ে আমাদের মতো আমজনতার সামনে এক ভিন্ন পরিস্থিতি এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সন্তানরা স্কুলে যে পাঠ্যক্রম পড়ছে, তাতে ইসলামের ছিটেফোঁটা যেটুকু ছিল, তাও দূর করার পাঁয়তারা চলছে। সিলেবাস সংশোধনের নামে চলছে তুঘলকি কারবার।

বাচ্চাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি কিংবা হাইজিন শিক্ষা দেবার নামে সেক্স এডুকেশন শেখানো হচ্ছে কোথাও কোথাও কৌশলে। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, পরিবারের সন্তানদের আজ গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড না থাকাটাই বড় অবাক করার বিষয়!

কাদিয়ানিরা তো মহোল্লাসে তৎপর, বিনাবাধায় তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে দেশব্যাপী! খৃষ্টান মিশনারীরাও সকল শক্তিতে মাঠে সক্রিয়। হিজবুত তাহরির আমাদের সন্তানদের একুশ শতকের বিপ্লবী ইসলাম (?) শেখাচ্ছে। জেএমবি, লস্কর ই তৈয়বা কিংবা আল্লাহর দল শেখাচ্ছে জিহাদ (!)

স্কুল থেকে ইসলামি শিক্ষা উধাও। যৌনতা ও নাস্তিক্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে জনপদ সয়লাব। তাওহিদী চিন্তা চেতনাই যেন হারিয়ে গেছে এ প্রজন্মের অধিকাংশের মন-মনন থেকে। সেক্যুলারিজম ইসলামের স্থান দখল করেছে মুসলমান যুবকদের, এমনকি, তথাকথিত চিন্তাবীদ ও সুশীল সম্প্রদায়ের মনেও। আরিফ আজাদ গংদের ইসলামি সাহিত্য বাংলা একাডেমিতে পরিত্যাজ্য, মুক্তচিন্তা, মুক্তমনা আর বাকস্বাধীনতার ফেরিওয়ালারা সেখানে অন্ধ! অন্ধ আক্বিদার ফেরিওয়ালারা আল্লামারাও, অন্ধ তবে বোবা নন, তাই কোন কোন ইসলামি সাহিত্য ও তাফসিরকে জ্বালিয়ে দেবার ফতওয়াও দিয়েছেন অনুসারীদের।

পিতৃতুল্য শিক্ষকরাই আজ ছেলে মেয়েদের প্রকাশ্যে আহ্বান জানাচ্ছেন মুক্তমনা, আধুনিক হয়ে অবাধ যৌনতায় জড়াতে। বন্ধুত্বের নামে জীবনকে চুটিয়ে উপভোগের এটাই নাকি উত্তম সময়! ফলাফলটা চোখে পড়ে রাস্তা ঘাটে বেরুলেই। আজ ইসলামি সংস্কৃতির সাথে পৌত্তলিক সংস্কৃতির কোন পার্থক্যই করা যায় না। আনাচে কানাচে অপরিপক্ক ভ্রুণ নিয়ে কুকুরদের টানাটানি! কুরআন হাদিসচর্চার পাদপীঠ মাদ্রাসার চার দেয়ালের ভেতর থেকেও মাঝে মধ্যে সমকামীতার কুৎসিত ক্রন্দনধ্বনী শোনা যায়!

ফেমিনিজম বা নারী স্বাধীনতার মোহনীয় হাতছানীতে প্রতিদিনই ভেঙ্গে যাচ্ছে সংসার! সভ্যতার সূতিকাগার নারী এখন বিনোদনের পণ্য! অধিকাংশই নাকি পরকিয়ায় গা ভাঁসিয়েছে। পুরুষও বা কম কিসে? ফলে সন্তানগুলো পথহারা মুসাফির বড় অচেনা, বৈরি এ বিশ্বে। অবাধ ও সহজলভ্য ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে হাতে হাতে অশ্লীল ভিডিও। এখন নাকি শুরু হয়েছে ওয়েবসিরিজ নামক অশ্লীলতার আর এক সয়লাব, আর এক বিভৎস, বিকৃত বিড়ম্বনা!!
ইসলামি অর্থনীতির মৌলিক বুনিয়াদী কিছু রসম টিকে ছিল সমাজের দু:স্থ জনগোষ্ঠীর কাছে শেষ ভরসাস্থল হিসেবে। যাকাত, সদাকা, ফিতরা, কুরবানির চামড়া কিছুদিনের জন্য হলেও তাদের মনে আশা জাগাতো। আজ সে সবের বিরুদ্ধেও চলছে কুশলী প্রচারণা। সহজলভ্য কেবল সূদটাই!

তাবলিগক ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা না বলুক সাধারণ জনগণের মনে অন্তত ইসলামের আবেগটাতো জাগিয়ে রাখতো কিছুটা, সেটাও অখন্ড থাকেনি। বিভাজন বিভক্তি সেখানেও। হেফাজতের পিঠের চামড়া লাল করে শিখিয়েছে বাঁকিদের, পরিণতিটা কি হতে পারে, সেটা! তারপরেও স্বস্তি জোটেনি, এখন সেটাও ভাঙ্গার সব আয়োজন শেষ ।

এগুলো খন্ডচিত্র, পূর্ণচিত্র নয়। এসবের বিরুদ্ধে মাঠে তৎপর থাকার কথা ছিল যে সব আল্লামাদের, তারা মাঠে নামেননি। সুলতানের হেরেমে ব্যস্ত ছিলেন আক্বিদার গবেষণায়। সাধারণ মুসলমানের সামনে আক্বিদার মডেল; সত্যের স্বাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবার সময় হয়নি তাদের। রোজা কবে শুরু হবে? ঈদ কবে হবে? সে বিতর্কে ছোট্ট দেশটা বিভক্ত, হানাহানিতে মত্ত, আল্লামারা নিশ্চুপ।

তবে এরই মধ্যে হঠাৎ করেই মিজানুর রহমান আজহারি কিংবা আমির হামজার মতো কয়েকজন বেয়াড়া (!) যুবক দাঁড়ালেন। মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রীর কাছে বোধগম্য ভাষা আর অভিধায় ইসলাম উপস্থাপন করলেন। সারা দেশে এক গণজাগরণ দেখা দিল। যাদের জ্বলার কথা তারা জ্বলতে লাগলো। সেই সাথে জ্বলতে লাগলো তথাকথিত আক্বিদার ফেরিওয়ালারাও! আজহারিকে দেশছাড়া করা হলো, এখন টার্গেট আমির হামজা!

এরকম ডজন ডজন উদাহারণ দিয়ে ফিরিস্তি বাড়াবো না। তবে একথাটা তো বরতেই হেব যে, এই দেশ, এই উম্মাহর মধ্যে এইসব বিভেদচাষীকে কখনোই ক্ষমা করবে না। আপাতদৃষ্টিতে যতো বড়ো আমলদার আলেম হোন না কেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা: এর কাছে তারা অভিশপ্ত, ঘৃণিত। ঘৃণিত উম্মাহর কাছেও।

এখনও দেশজুড়ে এমন শত শত আলেম আছেন যারা রাতের আঁধারে আল্লাহর কাছে পানাহ চাচ্ছেন, উম্মাহর জন্য কাঁদছেন। সেই সব আলেমদের প্রতি নিবেদন, দয়া করে দিনের আলোতে বেরিয়ে আসুন। উম্মাহর কোটি কোটি সদস্য আপনাাদের অপেক্ষায় অপেক্ষমান। আর ঐ সব আলেমদের কাছে এ অধমের নিবেদন, এখনও সময় আছে, তাওবা করে ফিরে আসুন। ঐক্যের পাল তুলুন।

-জিয়াউল হক

পঠিত : ৪৯৪ বার

মন্তব্য: ০