Alapon

রাসুল (সাঃ) পত্নী উম্মুল মোমেনীন জোয়াইরিয়া (রাঃ)...


উম্মুল মোমেনীন জোয়াইরিয়া (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা) বনী মুস্তালিকের দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ গোত্র নেতা হারিসের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা যার নাম ছিল 'বাররাহ'। এই নাম এক সময় পরিবর্তন হয়ে উম্মুল মোমেনীন জোয়ায়রিয়া (রাঃ) হয়ে যায়। তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ বনী মোস্তালিক গোত্রের মেয়ে, যারা যুদ্ধের মাধ্যমেই সকল কিছুর সমাধান খুঁজত! মক্কার কোরাইশদের সমর্থন ও উস্কানি পেয়ে তারা মদিনার মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। সে যুদ্ধে মুসলমানেরা বিজয় লাভ করে এবং তাঁর স্বামী নিহত হয়। মুসলমানেরা ছয়শ যুদ্ধবন্দি সহ প্রচুর গণিমতের সম্পদ লাভ করেছিল। যুদ্ধ করতে আসা সে সব যুদ্ধ বন্দীদের মধ্যে জোয়ায়রিয়া (রাঃ) ও ছিলেন।

গণিমতের সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা অনুসারে সমস্ত সম্পদ এবং বন্দীদের ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। ছাবেত ইবনে কায়েস (রাঃ) এর ভাগে পড়েছিলেন জোয়ায়রিয়া (রাঃ)। [বন্ধীদের জেলে পুরে রাখার নিয়ম তখনও দুনিয়ায় চালু ছিলনা] জুয়াইরিয়া (রা) আরবের অভিজাত পরিবারে কন্যাই শুধু ছিলেন না। তাঁরা ছিল আরবের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা সম্পন্ন, যুদ্ধবাজ এক গোত্রের মেয়ে। অধিকন্তু তার বাবা ছিলেন একটি বড় গোত্রের নেতা। ফলে তাঁকে যখন দাসী হিসেবে অন্যদের মত ভাগ করে ভাগ করে দেওয়া হল, সেটা তার কাছে মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েও বেশী কষ্টদায়ক লাগছিল। তিনি নিজেকে মুক্ত করার জন্য পাগলপারা হয়ে উঠলেন। তিনি ছাবেত ইবনে কায়েস (রাঃ) সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হলেন এই মর্মে যে, উনিশ আওকিয়া স্বর্ণের বিনিময়ে তিনি মুক্তি লাভ করতে পারেন।

জোয়ায়রিয়া (রাঃ) রাসুল (সা) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে করুণ কণ্ঠে আবেদন করে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ), আমি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছি। আমি বনী মুস্তালিক গোত্রের নেতা হারিসের মেয়ে। আজ আমি বড় অসহায়! দাসীর জীবন আমার কাছে বড় অসহনীয়। উনিশ আওকিয়া স্বর্ণ ব্যতীত আমি মুক্তি লাভ করতে পারবো না। আমি আপনার কাছে বড়ই আশা নিয়ে এসেছি। আপনি আমাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিন। এই অসহায় অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করুন।

রাসুল (সাঃ) আজীবন মানুষের আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে সাহাবীদের সতর্ক করেছেন। অভিজাত ঘরের কন্যা অথচ বিপন্না এই নারীর আত্মমর্যাদার প্রতি রাসুল (সাঃ) দৃষ্টি দিলেন! মানবতার মুর্ত-প্রতীক আল্লাহর নবীর কোমল হৃদয় আর্তনাদ করে উঠল। অসহায় নারীর করুণ আবেদন তার পবিত্র অন্তর ছুঁয়ে গেল। তিনি সে নারীর মুক্তিপণ দান করে বললেন, এখন থেকে তুমি মুক্ত এবং স্বাধীন। তুমি ইচ্ছা করলে আমার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারো।

এই প্রস্তাব শুনে জেয়ায়রিয়া (রাঃ) এর চোখ দুটো মুহূর্তে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। সে সময় নবী (সাঃ) এর বয়স ছিল ৫৯ বছর আর তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। তদানীন্তন আরবের ইতিহাসে এটি এমন একটি ঐতিহাসিক বিয়ে হিসেবে হাজির হল, যার ফল ঘটল তড়িৎ গতিতে এবং প্রভাব হল বিস্তর। বিয়ের সংবাদে সকল সাহাবীগণ ঘোষণা করলেন যে, আল্লাহর রাসুল (সা) যে গোত্রের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, সে গোত্রের কোন মানুষকে আমরা দাস হিসাবে ধরে রাখতে পারি না!

এ কথা ঘোষণা করেই তারা ছয়শত যুদ্ধ বন্দীকে মুক্ত করে দেওয়া হল। দুর্ধর্ষ গোত্রপতি জোয়ায়রিয়া (রাঃ) এর মুক্ত পিতা হারিস রাসুল (সাঃ) এর কাছে হাজির হন এবং তখনই ইসলাম গ্রহণ করলে। এটা দেখে বনী মুস্তালিক গোত্রের ভেতরে বিপুল প্রেরণা সৃষ্টি হয়ে গেল! ফলে কার আগে কে ইসলাম গ্রহণ করবে তার প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল!
আরবের বিশাল একটা শক্তি, রাসুল (সাঃ) এর পুরানো শত্রুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলামের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়ে গেল। ফলে এই বিয়ে ইসলামের প্রচার ও নিরাপত্তার জন্য এক বিরাট কল্যাণ বয়ে নিয়ে এলো।

ঐতিহাসিক আল্লামা শিবলী বলেছেন, ‘এ বিয়েকে একটি অস্ত্রবিহীন মহাসমর ও যুদ্ধবিহীন মহাবিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন’। একটি মাত্র পরিণয়কে কেন্দ্র করে দুর্ধর্ষ শত্রুকে তিনি যেভাবে বন্ধুতে পরিণত করেছিলেন, দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়নের নিষ্কোষিত তরবারীও, কোন সম্প্রদায়, কোন গোত্র বা কোন জাতির অন্তঃকরণে সে ধরণের কোন প্রভাবের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়নি।

আল্লাহর নবীর সংস্পর্শে এসে হযরত জোয়ায়রিয়া (রাঃ) এক মহামানবীতে রুপান্তরিত হয়েছিলেন! ইসলামের আদর্শ তার চরিত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। মানুষ তাঁর সাথে কথা বললে মুগ্ধ হয়ে যেত! তার বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় রাসুল (সাঃ) ইন্তেকাল করেন এবং রাসুলের (সাঃ) ইন্তেকালের অব্যাবহিত পরেই তার স্ত্রীদের সংসার জীবনে চরম অনটন হানা দেয়। তবুও ধনী ঘরের এই মহীয়সি রমনী এই অভাবেও ভেঙ্গে পড়েন নি। তিনি তার গোটা জীবনটাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায় অতিবাহিত করেছিলেন। চল্লিশ বছরের বিধবা জীবন তিনি শুধু আল্লাহর এবাদতেই কাটিয়েছেন এবং ৬৫ বছর বয়সে এই মহিয়ষী মদীনায় ইন্তেকাল করেন। মসজিদে নবুবীর অদূরে, জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মাহবুব মুজাচ্ছাম আল হোদয়াবী (মিশর) কর্তৃক রচিত বিশ্বনবী থেকে সংকলিত...

- নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৬৭০ বার

মন্তব্য: ০