Alapon

উম্মুল মোমেনীন উম্মে হাবিবা রা.- এর জীবনইতিহাস...


খন্দকের যুদ্ধে রাসুল (সা) এর বিরুদ্ধে শত্রু সেনাপতির দায়িত্ব পালনকারী, ২০ বছরের জানের দুষমন, মক্কার কুরাইশদের অন্যতম নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা ছিলেন, উম্মে হাবিবা (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা)। তার পূর্বের নাম ছিল 'রমলাহ' এবং মাতার নাম ছিল 'সুফিয়া'।

ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ানের পারিবারিক খ্যাতি মক্কা নগরী থেকে সুদূর সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আবার তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ আরব নেতা। এমন পিতার কন্যা হিসাবে উম্মে হাবিবা (রাঃ) এর চরিত্রে আভিজাত্যের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। ছোটকাল থেকেই তার চরিত্রে আকর্ষণীয় গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল। প্রথমে তার বিয়ে হয়েছিল ওবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের সাথে। তিনি ছিলেন দারুণ সাহিত্য প্রেমিক ব্যক্তি।

স্বামী-স্ত্রী দু'জনই মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন। স্বামী মদপানে বেজায় আসক্ত ছিলেন ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথেই সে অভ্যাস ত্যাগ করেন। ইসলাম গ্রহণের ফলে, মক্কার আপন নিকটাত্মীয়দের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আবিসিনিয়া তথা বর্তমান ইথিওপিয়ায় গমন করেন। সে দেশ তখন খৃষ্টানদের দ্বারা শাসিত হত। সেখানে তাদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয় 'হাবিবা'। সে হিসেবে তিনি উম্মে হাবিবা কিংবা হাবিবার মা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান। তার স্বামী ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশ দেখতে পান খৃস্টান সমাজে মদ পানে বাধা নেই। তাই তিনি মদ পানের সুবিধার্থে ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। একদিন প্রচুর পরিমাণে মদ পান করে তিনি বেহুশ হয়ে পড়েন, সেই হুশ আর কোনদিন ফিরে পান নি।

দূর-অচিন মুল্লুকে অবস্থান করে, স্বামীর এ ধরনের কর্মকাণ্ডে উম্মে হাবিবা (রা) চরম অসহায় অবস্থার ভেতরে নিপতিত হলেন। তিনি শিশু কন্যাকে নিয়ে দু'চোখে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পেলেন। মক্কায় তার পিতা প্রচুর অর্থশালী, বিরাট ক্ষমতাবান এবং মক্কার বাহিরের দেশে পরিচিত ব্যক্তি কিন্তু তিনি ছিলেন ইসলামের চরম দুষমন। তাই উম্মে হাবিবা (রা) বিদেশের বিপদসংকুল পরিবেশের এই ঘোর দুর্দিনেও পিতার পরিচয় দিয়ে কারো কাছে সাহায্যের হাত পাতেন নি কিংবা ভুল স্বীকার করে পিতার কাছে ফিরে যাবারও চিন্তা করেন নি। যত বিপদ আসুক, তিনি শেষ সময় পর্যন্ত আল্লাহর উপর ভরসা ও ইমানের উপর অটল থেকে বিপদ মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

মদিনায় বসেই রাসুল (সা) ইথিওপিয়ায় অবস্থিত উম্মে হাবিবা (রা) এর চরম দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি ও তার চরম অসহায়ত্বের খবর পান। রাসুল (সাঃ) তখন ওমর ইবনে উমাইয়া (রাঃ) কে একটি চিঠি দিয়ে আবিসিনীয়ার বাদশাহের দরবারে প্রেরণ করেন। সে চিঠিতে তিনি বাদশাহের মাধ্যমে উম্মে হাবিবা (রা) কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এই সংবাদ পেয়ে উম্মে হাবিবা (রা) আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং আবিসিনীয়ার বাদশাহ নিজেও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। বাদশাহ একটি বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং সেখানকার সকল মুসলমানদের দাওয়াত দেন। সেই অনুষ্ঠানেই আবিসিনিয়ার বাদশাহ উম্মে হাবিবা (রাঃ) বিয়ে পড়িয়েছিলেন। রাসুল (সা) এর এই বিয়েটি দেশীয় সীমানার বাইরে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে পাত্রের অবস্থান ছিল এশিয়ার আর কন্যা ছিলেন আফ্রিকাতে। এই বিয়ের সময় উম্মে হাবিবা (রাঃ) বয়স ছিল ৩৮ বছর আর রাসুল (সা) এর বয়স ৬০ বছর। অর্থাৎ এটি রাসুল (সাঃ) এর মৃত্যুর প্রায় ৩ বছর আগের ঘটনা।

আবিসিনিয়ার বাদশাহ প্রচুর উপঢৌকনসহ তাকে মদিনায় অবস্থিত রাসুল (সাঃ) এর কাছে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ঈমানের দিক দিয়ে ছিলেন অত্যন্ত আপোষহীন। হোদায়বিয়ার পুরানো সন্ধি ভেঙ্গে, নতুন করে করার আবেদন জানিয়ে মক্কার কোরাইশেরা আবু সুফিয়ান কে দূত করে মদিনায় রাসুল (সাঃ) এর কাছে প্রেরণ করেন। উম্মে হাবিবা (রা) কে বিয়ের মাধ্যমে আবু সুফিয়ান ইতিমধ্যে রাসুল (সা) এর শ্বশুর বনে যান। তাই সন্ধির কাজটি আরো মজবুত হবার জন্য পিতা আবু সুফিয়ান, সুপারিশের জন্য নিজের কন্যা উম্মে হাবিবা (রা) দারস্থ হয়েছিলেন। আবু সুফিয়ান কন্যার ঘরে ঢুকে রাসুল (সা) এর বিছানায় বসতে গেলে কন্যা তাতে বসতে বারণ করেন এই বলে যে, "এই বিছানায় আল্লাহর রাসুল বসেন, আপনি মুশরিক-অপবিত্র, তাই রাসুলের (সা) বিছানায় বসবেন না"! স্বামীর প্রতি এ ধরনের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশে, পিতা আবু সুফিয়ান তাজ্জব হয়ে, নীচে বসে পড়েছিলেন।

আরব দেশে শত্রুভাবাপন্ন কোন গোত্রের সাথে কোনভাবে একবার আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেলে অতীতে যত শত্রুতাই থাকুক না কেন, নতুন করে সংঘাতে লিপ্ত হতো না। উম্মে হাবিবা (রা) বিয়ের মাধ্যমে, মূলত রাসুল (সাঃ) যুগান্ত-সৃষ্টিকারী সেই সফলতা অর্জন করেছিলেন। আবু সুফিয়ান শত্রুতা বন্ধ ও তরবারি কোষবদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটা ছিল এমন এক রাজনৈতিক বিয়ে, যার সম্পর্কের ফলে, রাসুলের বিরুদ্ধে লিপ্ত যুদ্ধের সেনাপতি আবু সুফিয়ান, রাসুল (সা) ঘরের মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হয়েছিল! যে আবু সুফিয়ানের মর্যাদা সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত, আজ তিনি কন্যার স্বামীর বিছানার বসার জন্যও পরিত্যক্ত হয়ে পরে! যুদ্ধ বিজয়ের চেয়েও অন্তর বিজয় করা যে সবচেয়ে বেশী দামী, রাসুল (সা) এটাই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।

হোদায়বিয়ার সন্ধির ব্যাপারে উম্মে হাবিবা (রা) পিতার পক্ষে কোন সুপারিশ তো করেন নাই; উপরন্তু বিশ্বনেতার স্ত্রীর মত দায়িত্ব নিয়ে, তিনি কোরাইশদের নেতা পিতাকে বলে দিয়েছিলেন, "হোদায়বিয়ার সন্ধি মুসলমানেরা ভাঙ্গে নি, আপনারাই সন্ধি ভঙ্গের জন্য দায়ী, এ ব্যাপারের আমার কিছুই করার নেই"।

মেয়ের এই ধরনের দৃঢ়তর উত্তরে পিতা সুফিয়ান অবাক হয়ে গিয়েছিল। রাসুল (সা) এর প্রতি স্বামী হিসেবে, অনুসারী হিসেবে, সহযাত্রী কিংবা বন্ধু হিসেবে এদের হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা-ভালোবাসার-সম্মানের যে নজীর দেখতে পেয়েছেন, সেটা দেখে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন যে, এ ধরনের মানুষের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ এবং তরবারি দিয়ে কোনদিনই জিতা সম্ভব নয়।

রাসুল (সাঃ) কাছে উম্মে হাবিবা (রাঃ) প্রায় চার বছরের মত সংসার জীবন কাটিয়েছিলেন। তিনি সে সংসারে কেমন ছিলেন সেটা বুঝার জন্য একটি হাদিসের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট। একদা উম্মে হাবিবা (রা) রাসুল (সা) কে অনুরোধ করেন যে, নিজের ছোট বোনকেও যেন আল্লাহর রাসুল (সা) বিয়ে করেন! প্রিয় ছোট বোনকে একজন উত্তম স্বামী জুটিয়ে দেবার জন্য, তিনি এই ভূমিকা রেখেছিলেন! রাসুল (সাঃ) সে বিয়ে করার প্রতি অপারগতা দেখান! কেননা ইসলামী শরীয়তে দুই বোনকে এক সাথে, এক স্বামী বিয়ে করতে পারে না।

উম্মে হাবিবা (রা) অন্তিম শয়নে, রাসুল (সাঃ) এর অন্যান্য স্ত্রীদের কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, “আমাদের পরস্পরের ভেতরে যে মনোমালিন্য ঘটেনি এমন নয়, এ সব দুর্বলতা থেকে আমরা মুক্ত ছিলাম না। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও" আয়েশা (রাঃ) তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং উপস্থিত সবাই সে দোয়ায় অংশগ্রহণ করেন। জীবনের ৭৩ বছর বয়সে উম্মে হাবিবা (রা) ইন্তেকাল করেন। তিনি প্রায় ৩২ বছর বৈধব্য জীবন পালন করেন।

মিশরীয় গ্রন্থকার, মাহবুব মুজাচ্ছাম আল হোদয়াবী কর্তৃক রচিত বিশ্বনবী থেকে সংকলিত...

- নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৪৮৮১ বার

মন্তব্য: ০