Alapon

উৎপীড়ন : সমাজ ও রাষ্ট্রের মরণ ব্যাধি...


উৎপীড়ন যে করে, সেই উৎপীড়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়। বাংলা ভাষায় উৎপীড়ন শব্দটির বহু আঙ্গিকে ব্যবহার আছে। ইংরেজিতে এই শব্দটিকে Torment বলা হয় তাছাড়া ইংরেজির Harassment তথা হয়রানী শব্দটির বেশীর ভাগ উপাদানও উৎপীড়নের কাতারে পড়ে। সাধারণত উৎপীড়ন বলতে, কোন বিনিময় ব্যতীত কারো সম্পদ ছিনিয়ে নেবার প্রবণতাকে বুঝিয়ে থাকে। কিংবা অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ, অন্যায়ভাবে কিছু দাবী করা কিংবা গায়ে পড়ে অন্যের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানোকে উৎপীড়ন বলা হয়। উৎপীড়ন : সমাজ ও রাষ্ট্রের মরণ ব্যাধি

উৎপীড়নের সোজা সাপটা উদাহরণ হলো, মানুষ কখনও তামাসাচ্ছলে প্রাণীকে খুঁচিয়ে-খুঁটিয়ে উত্ত্যক্ত ও অতিষ্ঠ করে তোলে। প্রাণীটি নিজেকে রক্ষা করার জন্য একবার খাঁচার এই কোণে আশ্রয় নেয় তো আরেকবার সেদিকে। তারপরও সে নিস্তার পায়না! এটি উৎপীড়নের সহজ উদাহরণ। অতি উৎপীড়নে একটি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ প্রাণীও কখনো উৎপীড়কের জন্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। একইভাবে একজন পীড়িত দিনে দিনে ক্ষোভ সঞ্চয় করে এমন কাণ্ড ঘটাবে, যা সমাজে সকলের জন্য বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। উৎপীড়কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ যদি নিজের হাত-পা হারায়, সারাজীবন কষ্ট করলেও সে তার হারানো হাত-পায়ের জন্য আফসোস করেনা। উৎপীড়িতের বেদনার প্রতি নজর না দিলে একদিন সেটা রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে প্রভাব পড়ে। একজন উৎপীড়ক শাসকের হাতে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হতেও বেশী সময় লাগেনা।

প্রাণীকে দিয়ে উপরে যে উৎপীড়নের উদাহরণ দেয়া হল, এটা শুধুমাত্র বুঝার জন্য। উৎপীড়নের মূল পরিচয় এটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সেটা আরো ব্যাপক। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইবনে খলদুনের ভাষায় “অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ উৎপীড়ন, অন্যায় ভাবে কিছু দাবী উৎপীড়ন, ন্যায় ভিত্তির বাহিরে খাজনা দাবী রাষ্ট্রীয় উৎপীড়ন, যারা অপরের ন্যায্য দাবি (ক্ষমতায় গিয়ে) পূরণ করেনা সেটাও উৎপীড়ন, জনগণের অধিকার ফিরিয়ে না দেওয়াও উৎপীড়ন, আবার অধিকার কেড়ে নেওয়াও উৎপীড়ন।” আল-মোকাদ্দিমা-৪৯০

আজকে যদি আমরা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তাকাই তাহলে সর্বত্রই উৎপীড়নের সমারোহ দেখতে পাব। উৎপীড়নের মাধ্যমে শাসক ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের ফাটল ধরে। চিরতরে আস্তা নষ্ট হয়ে যাবার কারণে সেটা আর মেরামত করা যায়না। ইবনে খলদুনের ভাষায়, “উৎপীড়নের প্রতিক্রিয়া ধীর ধীরে প্রকাশ পেয়ে একটা বিশেষ সময়ে চরম প্রতিক্রিয়া বাস্তবরূপ পায়। এর ফলে উৎপীড়কের শাসন বিধ্বস্ত হয়ে অন্য সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে।” আল-মোকাদ্দিমা-৪৯০। অর্থাৎ দেশ তখন আর নিজেদের হাতে থাকেনা। পুরো জাতি গোষ্ঠী নিজের অজান্তে, অনিচ্ছায় অন্যের গোলামে পরিণত হয়ে যায়।

খাদ্যে ভেজাল এবং নজরদারী না করা। ওজনে কম দেওয়া এবং বিহিত ব্যবস্থা না হওয়া। বখাটের রাস্তা দখল ও প্রশাসনের যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া। অদক্ষ মানুষের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স ধরিয়ে দেওয়া। সমিতি বানিয়ে যান-বাহন নিয়ন্ত্রণ করা ও জনগণকে ভিকটিম বানানো। দুই নম্বরি মাল বানিয়ে প্রকৃত ব্যবসায়ীকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে একজন মধ্য-স্বত্বভোগী সৃষ্টি হয়ে মুনাফা বানানোর সুযোগ দেওয়া। এগুলো সবই উৎপীড়ন, যারা এসব করে তারাই প্রকৃত উৎপীড়ক।

উৎপীড়ক দেশ ও জাতীর শত্রু। একজন উৎপীড়ক একটি সমাজকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। একজন উৎপীড়ক কারো প্রতিবেশী হলে সেই বুঝতে পারে দুনিয়াটা কত বড় জাহান্নাম। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর উৎপীড়ক প্রতিবেশী ছিলেন, আবু লাহাব। রাসুল (সা) গায়ে অনেকে হাত তুলেছে, আল্লাহ তাদের শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু চাচা আবু লাহাব প্রতিবেশীর প্রতি রীতিমত মানসিক উৎপীড়ন করতেন। আল্লাহ এটা বরদাশত করেন নি। সেজন্য তাকে লানত দেবার জন্য, পবিত্র কোরআনে একটি সুরা নাজিল করেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত যতবার এই সূরা পড়া হবে, এর ফলে ততবেশী শাস্তি তার বাড়তে থাকবে! এটা হল উৎপীড়নের চরম ক্ষতিকর দিক। এই শাস্তি শুধুমাত্র নবীকে কষ্ট দেবার জন্য নয়। সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনে যারাই উৎপীড়কের ভূমিকা পালন করে, আল্লাহ তাকেও দুনিয়া ও আখেরাতে ছাড় দেন না। তাদের মৃত্যু হয় চরম নিন্দনীয় ও ঘৃণিত ভাবে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি একজন ভাল প্রতিবেশী নয়, সে যতই পুণ্যের কাজ করুক না কেন, সে কোনদিন জান্নাতে যেতে পারবেন না। এই কথার অন্তঃনিহীত অর্থ এই যে, “ভাল মানুষ হওয়া সবার জন্য বাঞ্ছনীয়, যদি তা হতেই না পারি তাহলে অন্যের উৎপীড়নের কারণ যেন না হই।”

- tipu

পঠিত : ৪০১ বার

মন্তব্য: ০