Alapon

সৌদি আরব ইসরায়েলকে কবে স্বীকৃতি দেবে?



আরব আমিরাত ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সবার মনে যে প্রশ্নটা আসছে, সেটা হচ্ছে সৌদি আরব কবে সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে?

প্রশ্নটা মোটেও অবান্তর নয়। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেছে, তার আশা আমিরাতের পরেই সৌদি আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে, এবং ইসরায়েল যেখানে বলেছে সৌদি আরবের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়াই হচ্ছে তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমিরাতের পক্ষে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাটা যতটা সহজ, সৌদি আরবের পক্ষে কাজটা ততটা সহজ না। সন্দেহ নাই সৌদি আরব আপ্রাণ চেষ্টা করছে আমিরাতের পথে হাঁটার জন্য, কিন্তু বাস্তবতা এখনও তাদের পক্ষে নাই।

আমিরাতের স্বীকৃতির পর বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া দেখলে ব্যাপারটা কিছু বোঝা যায়। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে মিসর এবং জর্ডান, যাদের সাথে আগে থেকেই ইসরায়েলের সম্পর্ক আছে। স্বাগত জানিয়েছে ওমান, বাহরাইন এবং মরক্কো, যাদের সাথে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। বিপরীতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফিলিস্তিনিরা নিজেরা; সেই সাথে ইরান, যাদের সাথে ইসরায়েলের বৈরিতা প্রকাশ্য; এবং তুরস্ক, যাদের সাথে ইসরায়েলের বেশ ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও যারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সোচ্চার।

কিন্তু সৌদি আরবের অবস্থান কী? প্রথম চার-পাঁচদিন তারা অস্বাভাবিক রকমের নীরবতা পালন করেছে। অফিশিয়ালি কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি। কিন্তু তাদের মিডিয়া এবং তাদের পক্ষের কিছু সেলিব্রেটি টুইটার আইডি এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে কথা বলেছে। বিপরীতে তাদের দেশের সাধারণ জনগণ টুইটারে হ্যাশট্যাগ দিয়ে রীতিমতো এর বিরুদ্ধে ঝড় তুলেছে।

এবং চার-পাঁচদিন পরে তারা যখন বুঝতে পেরেছে, জনমত এখনও প্রবলভাবে এর বিরুদ্ধে, তখন তারা মুখ খুলেছে। বলেছে ইসরায়েলকে তারা কেবল তখনই স্বীকৃতি দিবে, যখন ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদেরকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দিবে। কিন্তু এখানেও লক্ষ্যণীয়, তুরস্ক, ইরান বা পাকিস্তানের মতো সৌদি আরব আরব আমিরাতের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায়নি, বরং আমিরাতের অ্যানেক্সেশন ঠেকিয়ে দেওয়ার খোঁড়া অজুহাতের পক্ষে সাফাই গেয়েছে।

সৌদি আরবের অবস্থানটা গত দুই-তির বছর ধরে, বিশেষ করে মোহাম্মদ বিন সালমান তথা এমবিএস যুবরাজ হওয়ার পর থেকেই পরিষ্কার। তার আমলে সৌদি আরব ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক অনেকটাই সহজ করে এনেছে। সৌদি কর্মকর্তারা, কূটনীতিকরা ইসরায়েলিদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বৈঠক করেছে। গোপনে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক এবং নিরাপত্তাজনিত এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

আজ হোক, কাল হোক, ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরব প্রকাশ্যেই সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। এটা সময়ের বাস্তবতা, এর কোনো বিকল্প নাই। এর কারণটা এরকম না যে, সৌদি শাসকরা ইসলামবিদ্বেষী, বা ইসরায়েল প্রেমিক। বরং এর কারণটা রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত বুঝতে পারছে, আমেরিকা ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। আমেরিকার অবর্তমানে আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে চেষ্টা করা ইরান এবং তুরস্ক থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া সৌদি-আমিরাতের দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নাই।

আদর্শ সমাধান হতো এরকম, যদি আমেরিকা চলে গেলে সৌদি-ইরান-তুর্কি একজোট হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত। কিন্তু বাস্তবে এটা কখনোই হবে না, কারণ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে এদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা ঐতিহাসিক। আর যেহেতু আমেরিকা দূরে থাকলেও ইসরায়েলের প্রতি তার সমর্থন এবং সহযোগিতা সব সময়ই থাকবে, এবং যেহেতু সামরিক দিক থেকে ইসরায়েল অনেক বেশি শক্তিশালী, তাই এদের তিন দেশের মধ্যেই একটা ভয় কাজ করবে, আমি যদি ইসরায়েলের পক্ষে না যাই, তাহলে অন্য কেউ ইসরায়েলকে নিজের দলে টেনে নিয়ে আমাকে শেষ করে ফেলবে।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের প্রধান ভয় ছিল ইরান। সাম্প্রতিক সময়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে কাতার, তুরস্ক এবং তাদের সমর্থিত ইসলামপন্থী দলগুলো। ঘরে-বাইরে এদেরকে দমন করার জন্য সৌদি-আমিরাতের সবচেয়ে উপকারী বন্ধু হতে পারবে ইসরায়েল। বাইরে ইরান এবং তুরস্ককে সিরিয়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখার কাজে, আর ঘরে ইসরায়েলের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন স্পাইওয়্যার এবং সিকিউরিটি টেকনোলজি ব্যবহার করে বিরোধী দলমতের উপর নজরদারি করার কাজে।

সেই সাথে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে অর্থনীতি। সৌদি আরব সম্প্রতি তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভিশন টুয়েন্টি-থার্টি (২০৩০) ঘোষণা করেছেন, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মেগাসিটি নিওম (NEOM)। এই বিশাল প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য সৌদি আরবের ইসরায়েলের সাহায্য প্রয়োজন। শুধু বায়োটেকনোলজি আর সাইবার সিকিউরিটিতে ইনভেস্টমেন্টের জন্যই না, এই সিটির অবস্থান হবে ইসরায়েলের খুবই নিকটে, ফলে ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘমেয়াদী শান্তির নিশ্চয়তা না থাকলে ট্যুরিজম সংক্রান্ত যে পরিকল্পনা, সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কঠিন হবে।

এসব কারণে ইসরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে এমবিএস কারো চেয়ে কম আগ্রহী না। গোপনে এই প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে আসার পথে তার সামনে দুইটা বড় বাধা - এক, তার বাবা বাদশাহ সালমান এখনও জীবিত। এবং দুই, সৌদি আরব এখনও মুসলিম বিশ্বের নেতা।

বাদশাহ সালমান এবং তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানের নীতির মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে। দুজনেই নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে একমত, কিন্তু ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক সহজ করার ব্যাপারে সালমানের এখনও আপত্তি আছে। দীর্ঘদিন রিয়াদের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সালমান আজীবন ইসরায়েলের সাথে শীতল সম্পর্কটাকেই স্বাভাবিক হিসেবে দেখে এসেছেন। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, বা অন্তত যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ততদিন পর্যন্ত সৌদি আরব ইসরায়েলের সাথে প্রকাশ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

দ্বিতীয় বাধাটা হচ্ছে, সৌদি আরবকে এখনও মুসলিম বিশ্বের নেতা মনে করা হয় শুধু এই কারণে যে, সেখানে মক্কা-মদিনার অবস্থান, কাবাঘরের অবস্থান। কাজেই একই সিদ্ধান্ত আরব আমিরাত নিলে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা সৌদি আরব নিলে প্রতিক্রিয়া হবে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এবং সৌদি আরবের জনগণও অন্য অনেক আধুনিকায়ন, সিনেমা হল চালু, কনসার্ট চালুকে যেভাবে স্বাগত জানিয়েছে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়াকে সেভাবে স্বাগত জানাবে না। টুইটারে তাদের প্রতিক্রিয়া থেকেও সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে।

সুতরাং কী ঘটবে? সৌদি আরব আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে না। অন্তত বাদশাহ সালমান বেঁচে থাকতে দেবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা ঠিকই ইসরায়েলের সাথে ব্যবসায়িক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে। সেই সাথে সৌদি বলয়ে অবস্থিত অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্র, যেমন বাহরাইনকে দিয়ে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করিয়ে পরিস্থিতিকে আরো অনুকূলে আনার চেষ্টা করবে।

আপাতত আরব আমিরাতের পর ইসরায়েরের সাথে যারা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তারা হচ্ছে বাহরাইন, ওমান এবং মরক্কো। তাদের দেখাদেখি এবং আমেরিকার চাপে যখন আরো দুর্বল কিছু মুসলিম রাষ্ট্রও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দিবে, যখন সৌদি আরবের নিন্দা করার মতো আর কেউ থাকবে না, তখনই কেবল তারা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে। এর আগ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক থাকবে গোপন, কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী।

- মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা

পঠিত : ৫৭১ বার

মন্তব্য: ০