Alapon

ইয়াজিদ থেকে দ্বিতীয় উমার



হজরত আবু সুফিয়ান রা. ও হজরত হিন্দা রা.-এর ছেলে হজরত মুয়াবিয়া রা. এর পর মুসলিম বিশ্বে ক্ষমতায় আসেন তথা মুসলিম জাহানের খলিফা দাবি করেন ইয়াজিদ। কুফাবাসী, মদিনাবাসী ও মক্কাবাসীরা তার সেই ক্ষমতায় আসীন হওয়াকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং অবৈধ বলে বিবেচিত করেন।

ইয়াজিদ তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ১ম বছর কুফার বিদ্রোহ দমন করেন। ২য় বছর মদিনার বিদ্রোহ দমন করেন। ৩য় বছর মক্কার বিদ্রোহ দমন করতে সেনা পাঠান। প্রথম দুই বিদ্রোহ যত সহজে দমন করা গেছে মক্কা সেভাবে সহজ হয় নি।

সেখানে মক্কাবাসী তাদের নেতা হিসেবে সিলেক্ট করেছে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা.-কে। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. হলেন সেই মানুষ যার জন্মে মুহাম্মদ সা.-সহ পুরো মদিনাবাসী উৎসব করেছে। এর কারণ হলো ইসলাম রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনিই সর্বপ্রথম মুসলিমদের সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়েছেন।

আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের নিজে সাহাবী আর সাহাবীর পুত্র। তাঁর পিতা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মা আসমা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক রা.। তার দাদী সুফিয়া রাসূলুল্লাহ সা.-এর ফুফু।

জন্মের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁকে পেশ করা হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি খেজুর চিবিয়ে তাঁকে চাটিয়ে দেন আর আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের নানা আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর নামে নাম ও উপনাম রাখলেন।
ইয়াজিদের বাহিনী যখন মক্কায় আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রা.-এর সাথে যুদ্ধরত তখন ইয়াজিদের মৃত্যুর খবর মক্কায় পৌঁছে। এতে তার সেনারা হিম্মত হারিয়ে ফেলে। আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের বিজয়ী হয়। মক্কাবাসীরা তাঁকেই খলিফা হিসেবে মান্য ও সম্মান করতে থাকেন। ইয়াজিদের মৃত্যুতে হিজাযবাসী, ইয়ামানবাসী, ইরাকবাসী, খুরাসানবাসী তাঁর কাছে বাইয়াত নেন।

ইয়াজিদ বাহিনীর আক্রমণে কাবার একাংশ ধ্বসে যায়। আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের কাবা শরীফ পুনর্নিমাণ করেন। ইবরাহীম (আঃ) এর যুগে কাবা শরীফ যেমন ছিল, তেমনিভাবে তিনি কাবা শরীফের দুটি দরজা নির্মাণ করেন। তার খালা আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা. এর বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইচ্ছা ছিলো আরো ছয় গজ জায়গা কাবা শরীফের অন্তর্ভুক্ত করা। এজন্য তিনি সেটাই করেন।

মিসর আর সিরিয়াবাসী ইয়াজিদের পর ইয়াজিদের ছেলে দ্বিতিয় মুয়াবিয়ার কাছে বাইআত নেন। কিন্তু ২য় মুয়াবিয়াকে পদচ্যুত করেন মারওয়ান। মিসর আর সিরিয়াবাসী এবার উমাইয়া শাসক মারওয়ানকে শাসক হিসেবে মেনে নেননি। তারা মক্কার খলিফা আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. এর কাছে বাইআত নেন। এতে রাগান্বিত হয়ে মারওয়ান বিন হাকাম মিসর ও সিরিয়া আক্রমণ করেন ও দখল করেন। তিনি তার শাসনকালে তার ছেলে আব্দুল মালিককে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর মক্কার দিকে দৃষ্টিপাত করেন। মক্কা দখলের উদ্দেশ্যে এবং আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রা.-কে হত্যার জন্য চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পাঠালেন। হাজ্জাজ এসে এক মাস মক্কা শরীফ অবরোধ করে রাখে আর শহরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মিনযানিক (কামান) স্থাপন করে। অবরোধের পর আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রা.-এর সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রা. পরাজিত হন। হাজ্জাজ নির্মমভাবে তাঁকে শূলে ছড়িয়ে হত্যা করে। প্রায় ১২ বছর প্রসিদ্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের মক্কার খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

তায়েফে জন্ম নেওয়া হাজ্জাজ খুবই সাহসী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রা.-কে হত্যা করার পর তার সামনে আর কিছুই বাধা হয়ে থাকে নি। তিনি উমাইয়া শাসনের সমস্ত বিদ্রোহীকে কঠোরভাবে দমন করেন। তাকে আব্দুল মালিক ইয়েমেনের দায়িত্ব প্রদান করেন। আব্দুল মালিকের শাসনামলে তিনি বহু যুদ্ধে এটেইন করেন এবং ইসলামের সীমানা বাড়ান। তিনি ইরাকের গভর্ণর ছিলেন। ইরাকের গভর্ণর থাকাকালে তিনি আরবি ভাষায় হরকত সংযোজনের প্রস্তাব দেন। আব্দুল মালিক ও হাজ্জাজের ব্যবস্থাপনায় অনারবদের কুরআন পাঠের অসুবিধা দূর হয়।

আব্দুল মালিকের পর ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে আল ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক। আল ওয়ালিদ আব্দুল মালিকের মতো যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না। তিনি ৭০৫ থেকে ৭১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এই সময় মূলত মুসলিম বিশ্ব হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দ্বারাই শাসিত হয়েছে। হাজ্জাজ খুবই অত্যাচারী ও কঠোর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি নওমুসলিমদের জিজিয়া দিতে বাধ্য করতেন। তার ধারণা ছিলো জিজিয়ার ভয়ে কাফিররা মুসলিম হচ্ছে, আর তাতে রাজস্ব আয় কম হচ্ছে। তার সময়ে আমাদের ভারতবর্ষে মুসলিম বাহিনী পোঁছে যায়। আর এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তারই ভাতিজা ও মেয়ের জামাই মুহাম্মদ বিন কাসিম।

মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর চাচার মতো অত্যাচারী ছিলেন না। তবে তাঁর চাচার অন্যায়ের ভাগ তাকে নিতে হয়েছে। উমাইয়া শাসক আল ওয়ালিদের ভাই সুলাইমান হাজ্জাজের কঠোরতাকে পছন্দ করতেন না। একইসাথে তার ভাই আল ওয়ালিদকে ব্যবহার করে ক্ষমতার ছড়ি ঘুরানো পছন্দ করতেন না। যেসব বীর যোদ্ধা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতকে শক্তিশালী করেছিলো এর মধ্যে মুহাম্মদ বিন কাসিম একজন।

৭১৪ সালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইন্তেকাল করেন। তার এক বছর পর আল ওয়ালিদ ইন্তেকাল করেন। তারপর ক্ষমতায় আসেন তার ভাই সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক। সুলাইমান ক্ষমতায় এসে যারা হাজ্জাজের সহযোগী ছিলো তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। হাজ্জাজের শাস্তি তার আত্মীয় ও তার কাছের লোকদের দিয়েছেন। সেই হিসেবে সুলাইমান মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ভারত থেকে ডেকে পাঠান এবং নানান অত্যাচারের অভিযোগ এনে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেন।

সুলাইমানের চাচাতো ভাই উমার বিন আব্দুল আজিজ (দ্বিতীয় উমার) এই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং তা রহিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। ৭১৫ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিম খুন হন। এই খুন সুলাইমানের বিরুদ্ধে সবাইকে উত্তেজিত করে। হাজ্জাজের পক্ষ থেকে সুবিধাভোগীরা সুলাইমানকে হত্যা করে এবং বিখ্যাত ইসলামী স্কলার ও মদিনার গভর্ণর উমার বিন আব্দুল আজিজকে ক্ষমতায় আসার জন্য আহ্বান করেন।

উমার বিন আব্দুল আজিজ এই অবস্থায় নিজেকে মুসলিমদের সামনে পেশ করেন। তারা যদি তাঁকে স্বতস্ফূর্তভাবে শাসক মনে করেন তবেই তিনি নিজেকে শাসক হিসেবে মানতে রাজি আছেন। এই মতে উমাইয়া বংশের লোকেরা তাঁকে শাসক হিসেবে মেনে নিলো। কিন্তু এটা তাদের জন্য সুখকর হয়নি। তিনি খুলাফায়ে রাশেদার মতো করে শাসন পরিচালনা শুরু করেন। রাষ্ট্রের সম্পত্তির মালিক এতোদিন উমাইয়া বংশের গণ্যমান্যরা ছিলো তিনি তা রহিত করে দেন। সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রভাবশালী সব লোকদের থেকে দেশের সম্পদ উদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন।

তাঁর স্বজাতি উমাইয়ারা তাঁকে সহ্য করতে পারেননি। তিনি ৭১৭ সালে ক্ষমতায় আসেন। ৭২০ সালে তাঁকে শহীদ করা হয়।

পঠিত : ৭১৯ বার

মন্তব্য: ০