Alapon

আসুন, ইসলামের বিধান নিয়ে অযথা টানাহেঁচড়া না করি...


"অন্যান্য আদর্শে যেসব কথা বলা আছে, ইসলামে সেসব কথাই জাস্ট আরবি শব্দে বলা আছে" ---- এমনটা সত্য নয়। বরং এখানে অন্তর্নিহিত চেতনার বড় একটা পার্থক্য থাকে।
ইগ্যালিটারিয়ান মতবাদগুলোতে যে সাম্যের কথা বলা হয়, সেটার সাথে ইসলামের সাম্যের ধারণা না-ও মিলতে পারে। সোশাল জাস্টিস বলতে যা বোঝায়, সেটা হাক্কুল ইবাদ (আল্লাহর বান্দাদের অধিকার) কনসেপ্টের সাথে না-ও মিলতে পারে। ওই যে বলা হলো, ভেতরে চেতনাগত অনেক পার্থক্য থাকতে পারে।

(দেখেন না, মুক্তিযুদ্ধ অনেকেই করল, কিন্তু সবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞা আলাদা? একদল আরেকদলের চেতনাকে বিদআতি চেতনা বলে গালি দেয়। নিজেদেরটাকেই সহীহ চেতনা বলে। সো, ডোন্ট আন্ডারএশটিমেট দা পাওয়ার অব চেতনা।)
কৌতুক শেষ। এখন আবার সিরিয়াস।

এই অন্তর্নিহিত চেতনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চেতনার পার্থক্যের কারণে বাহ্যিক কাজকর্মেও বিরাট পার্থক্য দেখা দেয়।

অমুসলিম, বিশেষত পশ্চিমা অমুসলিমদের মাঝে প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসার বিষয়টা দেখুন। চট করেই এর সাথে আপনি অনেক হাদীসের মিল পেয়ে যাবেন। তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি খাইয়ে নাজাত পাওয়া, বিড়ালকে অনাহারে বন্দি রেখে গুনাহগার হওয়া, এরকম বহু হাদীস মনে পড়ে যাবে আপনার।

কিন্তু অমুসলিমদের এই প্রাণীর প্রতি ভালোবাসাটা ইসলামি চেতনা থেকে উৎপন্ন হয়নি। অন্তরের চেতনার এই পার্থক্যের ফলে বাহ্যিক কাজগুলোও প্রভাবিত হয়। অনেকক্ষেত্রেই তাদের প্রাণী অধিকারের আলোচনা গিয়ে ঠেকে নিরামিষাশী মতবাদে। প্রাণীহত্যাকে তো সহিংসতা বলে মানেই, প্রাণীর ওলান থেকে দুধ বের করাকেও যৌন হয়রানি বলে আখ্যা দিয়ে বসে তারা। কিন্তু মুসলিম হিসেবে আপনি অনেক প্রাণীর মাংস ও দুধ পানাহার হালাল বলে মানেন।

আবার পানাহার ছাড়াও অন্য অনেক প্রয়োজনে মানুষ অন্যান্য প্রাণীকে হত্যা করে। মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি দেখছেন যে, সবকিছু মানুষের উপকারের জন্য সৃষ্ট, আর মানুষ আল্লাহর ইবাদতের জন্য সৃষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞানবাদী একজন অমুসলিমের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন। কোনো জীবের ওপর অন্য জীবের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাইই বিবর্তনের কোনো না কোনো পর্যায়ে থাকা অর্গানিজম। কে কাকে মারবে? কেন মারবে? কোনো মানদণ্ড নেই।
এছাড়াও, অনেক ক্ষেত্রে প্রাণীর প্রতি তাদের এই ভালোবাসাটা আসে মানুষের প্রতি ঘৃণার বিনিময়ে৷ ধর্মীয় নৈতিকতায় বিশ্বাস করে না, এরকম নিরীশ্বরবাদী একটা সমাজে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক খুব সহজেই অর্থহীন হয়ে যাওয়া সম্ভব। এবং মোটাদাগে এমনটাই হচ্ছে। পরিবারের ওপর বন্ধুকে, বা মানুষের ওপর প্রাণীকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা পুরো দৃশ্যমান। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রজন্মটা তাদের এ ধরনের চিন্তা অহরহ প্রকাশ করে থাকে। প্রায়ই তাদের বলতে/লিখতে দেখবেন "মানুষকে যতই চিনতে শিখি, ততই আমি কুকুর ভালোবাসতে শুরু করি।"

আপনিও স্বীকার করেন যে, মানুষের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করা ক্লান্তিকর। অনেক কিছু মানিয়ে নিয়ে, বিসর্জন দিয়ে একেকটা সম্পর্ক ঠিক রাখা লাগে। পোষা প্রাণীর সাথে সম্পর্কে এত জটিলতা নেই। কিন্তু মুসলিম হিসেবে আপনি মানুষের একটা ভ্যালুতে বিশ্বাস করেন। পরিবার, আত্মীয়তা, সামাজিক বন্ধনের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব স্বীকার করেন। তাই শত টানাপোড়েন সামলেও মানুষের সাথে, সমাজের সাথে জুড়ে থাকার একটা দায়বোধ আপনার মাঝে আছে।

মোটকথা, প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা আপনারও আছে, ওই অমুসলিমটিরও আছে। কিন্তু আপনি প্রাণীটাকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভালোবাসেন, অমুসলিমের চিন্তাধারা এখানে ভিন্ন। এই চেতনাগত পার্থক্যের সূত্র ধরে আরো অনেক পার্থক্য দাঁড়িয়ে গেছে।
এখন আপনার দায়িত্ব হলো এই চেতনার জায়গায় ইসলামকে অক্ষুণ্ণ রাখা। ইসলামকে কেন্দ্র ধরে প্রাণীপ্রীতি আবর্তিত হবে। প্রাণীপ্রীতিকে কেন্দ্র করে ইসলাম আবর্তিত হবে না। দ্বিতীয়টা হলে সমস্যা কী হবে, জানেন? তখন আপনি প্রাণীপ্রীতির স্ট্যান্ডার্ডের সাথে ইসলামকে খাপ খাওয়ানোর জন্য ইসলামকে মনমতো ঘোরাতে শুরু করবেন।
ইসলামে তাহির-নাজিস (আমরা সাধারণত "পাক-নাপাক" বলতে যা বুঝি) এর একটা কনসেপ্ট আছে। এটা শুধু পরিচ্ছন্নতা-অপরিচ্ছন্নতার ওপর ভিত্তি করে হয় না। আরো অন্যান্য ব্যাপার আছে। যেমন- কুকুর-বিড়াল দুটোই চারপেয়ে প্রাণী। কিন্তু পাক-নাপাকের ক্ষেত্রে দুটা সমান না।

বিড়াল তাহির বা পাক। তাই সিম্পল একটা গুগল সার্চ করেই এমন হাজার হাজার ছবি পাবেন, যেখানে মসজিদের কার্পেটে বা মুসল্লির কোলে বিড়াল বসে আছে। কুকুরের ছবি এরকম অহরহ পাবেন না। অনেক কষ্টেসৃষ্টে হয়ত একটা-দুটা পাবেন, যেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা পোষা কুকুর মসজিদ বিল্ডিংয়ের বাইরে পাকা রাস্তায়, নামাজের জায়গার বাইরে বসে আছে। কারণ কুকুরের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত নাপাকের পক্ষে। এদেরকে মসজিদের ভিতরে নেওয়া হয় না।

কিন্তু যিনি গুগল সার্চ করছেন, তার কাছে হয়ত ইসলাম গৌণ, প্রাণীপ্রীতি মূখ্য। পাক-নাপাকের ফিকহি বিষয়ের জটিলতা বা সূক্ষ্মতাকে তিনি আমলেও নেন না। তার ওপর সিটি করপোরেশনের কিছু সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপাতত প্রচণ্ড রেগে আছেন। তিনি কী করবেন? বিড়ালের ওই ১০০টা ছবি নামাবেন, কুকুরের ওই একটা ছবিও নামাবেন। তারপর সবগুলো একসাথে মিক্স করে আপনার মুসলমানিত্বকে তুলাধুনা শুরু করবেন, "দেখেছেন? দেখেছেন? অমুকস্তানে *কুকুর* আর বিড়াল মসজিদের কার্পেটে শুয়ে থাকে। ওদের নামাজ নষ্ট হয় না। ওরা নাপাক হয় না। আর আপনি কী এক্কারে মুসলমান হইছেন কুকুরকে নাপাক বলেন। খারাপ মানুষ ছাড়া আর কিছুই নাপাক না। ইত্যাদি।"

এ ধরনের হাতসাফাই খুবই নিম্ন মানের অ্যাপ্রোচ। আপনি বেওয়ারিশ কুকুর নিধন/স্থানান্তর করার সরকারি সিদ্ধান্তের সাথে ঘোরতর দ্বিমত, ফাইন। ইসলামের পাক-নাপাকের ফিকহকে টেনে না এনেই আপনি আপনার মতের স্বপক্ষে অনেক শক্ত শক্ত যুক্তি দিতে পারতেন। তা না করে এমন এক জায়গায় হাত দিয়েছেন, যা আপনার দক্ষতার জায়গা না।

কুকুরকে পাক বলতে চাইলেও আপনি ক্লাসিকাল ইসলামিক স্কলারদের থেকেই এর স্বপক্ষে মত পাবেন। মাইনোরিটি মত হলেও পাবেন। শুধু পাক না, জবাই করে খাওয়া হালাল হওয়ার পক্ষেও মত পাবেন (তখন অবশ্য ঢাকা সিটি করপোরেশন নতুন আইডিয়া পেয়ে যাবে বেওয়ারিশ কুকুর কমানোর)। কিন্তু তখন তো আপনাকে অন্তত ইসলামী জ্ঞানের ফ্রেইমওয়ার্ক মেনে আলোচনা শুরু ও শেষ করতে হবে। গুগল থেকে অমুকস্তানের কয়েকটা ছবি আর নিজের মনের আক্রোশ মিশিয়ে কিছু লিখে দিলেই তো হবে না।

অনেক ব্যাপারেই ওয়াহি সরাসরি কিছু বলে দেবে না৷ মানবীয় বুদ্ধি দিয়েই কাজ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য, মানুষের সুবিধা, প্রাণীর প্রাণ সবকিছু বিবেচনা করে সর্বোত্তম সমাধান কোনটা হওয়া উচিত, এ নিয়ে সব পক্ষই আলোচনা করবে। কর্তৃপক্ষকে নিজ মতের পক্ষে কনভিন্স করতে চাইবে, প্রয়োজনে চাপ দেবে। কর্তৃপক্ষ সব বিবেচনায় নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসবে। তারপরও সেই সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, মহাভুল হতে পারে। দশ বছর পর গিয়ে সেটার মারাত্মক কোনো কুপ্রভাব দেখা দিতে পারে৷ কিন্তু কোনো প্রকার জুলুমের নিয়ত না থাকলে কোনো পক্ষেরই গুনাহ হবে না ইনশাআল্লাহ। কারণ, মানবীয় জ্ঞান ও প্রচেষ্টা এরকমই। সীমাবদ্ধ। ত্রুটিপূর্ণ। সর্বোচ্চ চেষ্টার বেশি কিছু করার নেই।

কিন্তু ইসলামের বিধান নিয়ে অযথা, অজ্ঞের মতো টানাহেঁচড়া না করি। আল্লাহর দীনকে অন্য কেন্দ্রের পরিধি না বানাই। তখন গুনাহ হবে৷ নিজের মুসলমানিত্ব নিয়ে আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতা করা লাগবে।

সংগৃহিত

পঠিত : ৪৪৮ বার

মন্তব্য: ০