Alapon

মহাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ও মুসলিম বিশ্বের লাভক্ষতি...


চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি। চীন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। চীন বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তার করছে। প্রতিবছর চীন সামরিক খাতে প্রচুর ব্যয় করে থাকে। মহাশক্তি হিসেবে কী চীনের উত্থান ঘটছে? মহাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানে মুসলিম বিশ্বের লাভক্ষতি কতটুকু?


চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বৃহৎ রাষ্ট্র। চীন দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতিতে ভালো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। চীনের বৃহৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যা ও কম মজুরির সুবিধায় কম মূল্যে পণ্য উৎপাদনের জন্য সারা বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা চীনে বিনিয়োগ করেন। ফলে চীনে জড়ো হয় এশিয়ার শিল্পোন্নত দেশ জাপানের চেয়েও তিনগুণ বেশী বিনিয়োগ। ফলে ধীরে ধীরে চীন হয়ে উঠে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি। যার রয়েছে পকেট ভর্তি প্রচুর টাকা। বর্তমানের চীন আজ থেকে ৩০ বছর আগে এত ধনী ছিলো না। চীন ছিলো এশিয়ার দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর একটি। মাও সে তুং এর সমাজতান্ত্রিক শাসনামলের বেশ কয়েকটি ভুল সিদ্বান্ত চীনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ১৯৭৬ সালে মাও সে তুং এর মৃত্যুর পর চীনের ক্ষমতায় আসেন ডেং জিয়াও পিং। ডেং জিয়াও পিং ক্ষমতায় আসার পর তিনি চীনকে নিজস্ব নীতি অনুযায়ী চীনকে পরিচালিত করেন। ডেং জিয়াও পিং বুঝতে পারেন ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া অর্থনীতি শক্তিশালী হবে না।


ডেং জিয়াও পিং মাও সে তুং এর নীতির বিরোধীতা করে ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। ১৯৮৯ সালে ডেং জিয়াও পিং বিদেশী বিনিয়োগের জন্য চীনকে উন্মুক্ত করেন। ঐ বছরেই চীনে ১১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আসে। তারপর থেকে প্রতি বছর চীনের জিডিপি প্রচন্ড হারে বাড়তে থাকে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পৌঁছায় বছরে ১৪ শতাংশ। যা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী। ১৯৯৭ সালে চীনের দ্বীপ হংকং এ ব্রিটিশদের ১০০ বছরের ইজারা চুক্তি হয়। আর হংকং ছিলো তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম ধনী এলাকা। যা ব্রিটিশদের হাত থেকে পাকা মিষ্টি ফলের মতো চীনের ঝুলিতে এসে পড়ে। তারপর থেকে চীনের অর্থনীতি শক্তিশালী হতে থাকে। আর চীনের এসে দাঁড়ায় ১৪.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সালে এসে চীনা প্রেসিডেন্ট শিং জিন পিং ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নামক বিশাল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। যা সংযুক্ত করবে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে। এই পরিকল্পনাকে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। চীন ইতিমধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ২১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড হচ্ছে চীনের মহাশক্তি হয়ে উঠার পরিকল্পনার অংশ। এছাড়াও ক্রমাগত চীনের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আচরণ, বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায় আমেরিকা ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো বিষয় চীনকে নতুন পরাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।


ইউরোপীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চীন হয়তো বা আগামী ২০ বছরে আমেরিকাকে অর্থনীতিতে হারিয়ে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠবে। কিন্তু সবক্ষেত্রে আমেরিকাকে হারানো চীনের পক্ষে সম্ভব না। এর বেশ কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, আমেরিকা বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা সবক্ষেত্রেই সেরাদের সেরা। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি, মহাকাশ গবেষণা সবকিছুতেই আমেরিকা এগিয়ে। আর দ্বিতীয়ত বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীন বিশ্বকে কোন নতুন মতাদর্শ উপহার দিতে পারবে না। কারণ চীনের অধিকাংশ লোকই সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ পছন্দ করে না। চীন নিজ দেশের ভিতর মানবাধিকার লঙ্গনের অভিযোগে অভিযুক্তও। ফলে চীন বিশ্বকে নতুন মতাদর্শ উপহার দিতে পারবে না। যেমনটা পেরেছিলো - ব্রিটিশ সম্রাজ্য ও আমেরিকা। তৃতীয়ত চীন সামরিক শক্তিতে এখনো আমেরিকার কাছে কিছুই না। আর চীনের সামরিক ব্যয় আমেরিকার সামরিক ব্যয়ের ৩ ভাগের ১ ভাগ। যা চীনের পরাশক্তি হয়ে উঠার পথে বাঁধা। চতুর্থত চীন গবেষণা খাতে আমেরিকার মতো বিশাল ব্যয় করতে সক্ষম নয়। সর্বোপরি চীন আমেরিকার চেয়ে ভিন্নভাবে যে কোন বিষয়কে বিবেচনা করে। তাই এটা বলা যায় যে, চীন এই শতাব্দীতে না হোক আগামী শতাব্দীতে হয়তো পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারে, যদি সে উপরোক্ত বিষয়গুলোর সমাধান করতে সক্ষম হয়।


চীন যদি পরাশক্তি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে, তাও মুসলিম বিশ্বের জন্য তেমন কোন সুখবর নেই। কারণ মুসলিম বিশ্বের সাথে অনেকটা আমেরিকার মতোই আচরণ করবে। কারণ আমেরিকা ও চীন উভয়ই মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে সিদ্বহস্ত। চীন পরাশক্তি হলে মুসলিম বিশ্বের তেমন কোন লাভ নেই। চীন ফিলিস্তিন ইস্যু, কিংবা কাশ্মীর ইস্যুর সমধান তখনই করবে, যখন মুসলিম বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে। মুসলিম বিশ্ব পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানকালে চীন ও আমেরিকার দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। পাকিস্তানে রয়েছে চীনের ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ। সম্প্রতি চীন ইরানের সাথে ২৫ বছর মেয়াদী ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। আর তুরস্কের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি চীনের সাথে মিলে অর্থনীতি আরও শক্তিশালী করতে চায়। যদিও উইঘুর মুসলিম নির্যাতনের ইস্যুতে চীন ও তুরস্কের বৈরিতাও আছে।


সর্বোপরি পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান হলেও মুসলিম বিশ্বের তেমন একটা লাভ হবে না। যদি মুসলিম বিশ্বের দেশসমূহের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি শক্তিশালী না হয়।


তথ্যসূত্রঃ History Of China

Business Insider

China Revealed

One Belt One Road - Wikipedia

World Bank (Official Website)

TRT WORLD

- জান্নাত

পঠিত : ৫২০ বার

মন্তব্য: ০