Alapon

একটি ভ্রমন ও কিছু কথা!

সুন্দরবন ট্রেন। কমলাপুর থেকে খুলনার পথে। আমার গন্তব্য টাঙ্গাইল। আড়াই ঘন্টার ট্রেন সফরে যেন এক টুকরো বাংলাদেশ দেখলাম।


৫.৩০ এর ট্রেন। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ৫ টায় পৌছলাম। সাদা পোষাকের টিকেট হাতে একজনকে কাউন্টারের সামনেই পেয়ে গেলাম। কাউন্টার থেকে টিকেট নেয়ার চেয়ে ভদ্রলোকের থেকে টিকেট নেয়াই সময় সাশ্রয়ী। ভদ্রলোককে শুধু বললাম- আমার সিট কনফার্ম চাই। হেসে বললেন, নিশ্চয়। সরল বিশ্বাসে আমিও হেসে ধন্যবাদ দিয়ে ৭ নং প্ল্যাটফর্মে দৌড় দিলাম। ট্রেনে উঠে বুঝলাম, এটা স্টান্ডিং টিকেট। অনেক ফাঁকা সিটের একটাতে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ভদ্রলোক আমাকে কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কেটে সিট কনফার্মেশন করার এক লাইনের পরামর্শ দিতে পারতো। আমি জানি না, স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটে ওনারা কোন কমিশন পান কিনা। যাত্রী সাধারণকে এতটুকু কো-অপারেট করতে আত্মস্বার্থের সাদা পোষাকধারীরা বড্ড কৃপণ! নিজের আহম্মকী কবুল করে, এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে দাঁড়িয়েই যেতে থাকলাম।


এক মহিলা দারুণ সুরে গজল গেয়ে ভিক্ষা করছে। গজলের লিরিক্সগুলো এতটাই প্যাথেটিক, আপনিও পকেটে হাত ঢুকাতে বাধ্য হবেন! কিছু পরেই এক হকার আসলেন। ৭০ টাকার প্রোডাক্ট কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে ২০ টাকায় বিলিয়ে দিচ্ছেন। প্যাকেজে আছে, ১টা ব্রাশ, ২ টা চিরুনি, ১ প্যাকেট দাঁতের খিলাল, ২টি সুঁই, ১টি কলম। তার উপস্থাপনা ও শব্দচয়ন দেখে সত্যিই আমি ইম্প্রেসড। এই লোকগুলো কত দারুণ করে প্রেজেন্টেশন দিতে পারে! আমরা তাদের হকার বানিয়ে রেখেছি। তাদের যদি ভাল কোন প্রোমোশনাল কাজে লাগাতে পারতাম।


ট্রেনের নাস্তার ব্যাপারটা আজ স্বচক্ষে দেখলাম। গল্প শুনেছিলাম, রাবিতে এডমিশন দিতে যাওয়া ৪ বন্ধু ট্রেনে মুখোমুখি বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওয়েটার এসে বললো- স্যার এই নিন আপনাদের নাস্তা। ট্রেনে প্রথমবার সফরকারী বন্ধুরা এই অফারকে ট্রেনের পক্ষ থেকে বিনামূল্যের সৌজন্য নাস্তা হিসেবে আরামে পেটে চালান করে দিয়েছিল। ঘন্টাখানিক বাদে যখন ১২ শত টাকার বিল শুনিয়ে দেয়া হলো, তখন পরিস্থিতি কী হয়েছিল- কল্পনা করুন। আজও তারা যেভাবে নাস্তা অফার করছিল, তাতে বারবার আমার শাশুড়ির সকালের নাস্তার টেবিলে ডাকাডাকির স্মৃতি মনে পড়ছিল।


আমাদের দেশে এক রাজনৈতিক সাহিত্যিক আছে না? লোকে বলে বাংলার ফাটাকেস্ট। চাপা যা পিডাই, তাতে বুঝি পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন বাংলাদেশে বিরাজমান। ট্রেন থেকে গাজিপুর, টাঙ্গাইলের গ্রামীণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে অগোচরে, সংগোপনে বললাম- 'বর্ষার রাস্তায় কাঁদা না থাকলে যৌবনের পিছলে যাওয়া হবে কী করে? রাস্তা ভাংগা থাকতেই পারে। এ নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নাই। নৌযানে ভরসা রাখুন'।


যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পাশের সিটে উত্তরা স্টেশন থেকে অষ্টাদশী উঠেছিলেন। ৩০ মিনিটের মত ফোনালাপ চললো। হা হা, হি হি, শুনে মেজাজ যা হবার হয়ে গেল। মেয়েটিকে তো নসিহত করাটাও রিস্কি। ৫ হাত দূরে একজন। চল্লিশোর্ধ মহিলা বাচ্চাসহ দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাই যখন নিজ নিজ সিটে আয়েশে বসে বাচ্চার কষ্ট দেখছে, তখন সেই মেয়েটিই নিজ সিট ছেড়ে বাচ্চা ও তার মা কে বসার জায়গা করে দিলো। একটু আগের মেজাজ বাহিরের বর্ষায় ধুয়ে মুছে গেল। মেয়েটির এই ছোট্ট মানবিকতায় আমি শব্দহীন কৃতজ্ঞতা শূণ্যে ছেড়ে দিলাম। পৃথিবীর তাবৎ সংবেদনশীল মানবিক চেতনার মানুষগুলোর কাছে এই কৃতজ্ঞতা পৌছে যাক।


কিছুদূর যেতেই একজন পাঞ্জাবী, টুপি পরিহিত দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক এতিমখানা ও হাফেজী মাদ্রার জন্য কালেকশন করে বেড়াচ্ছেন। হাতে মানি রিসিট। টাকা পেয়ে মানি রিসিট না দিলেও দাতাকে জান্নাতের দরজার কাছাকাছি রেখে আসতে কার্পণ্য করছেন না। এই কাজটিকে আমি জঘন্য ঘৃণা করি। যখনই এসব হুজুরবেশী ধান্দাবাজরা পাবলিক প্লেসে কালেকশন শুরু করে, তখন আমি লজ্জায় অন্যদিকে তাকাই। মনে হয়, আমার ইসলাম, আমার মসজিদ, আমার মাদ্রাসাকে এরা ভিক্ষাবৃত্তির ইন্সট্রুমেন্ট বানিয়ে ফেলেছে। ইসলাম, মসজিদ, মাদ্রাসা তো এত অসহায় অবস্থায় নাই যে দয়ার দান নিয়ে চলতে হবে। আমার রিলিজিয়ন অনেক স্মার্ট। অর্থের সংকুলান দিতে নানা স্টেকহোল্ডার আছে। একজন আওলিয়ার জীবনীতে পড়েছিলাম, ভিক্ষা দিতে না পারলে ওনি 'আল্লাহর ওয়াস্তেয়াস্তে মাফ করুন' টার্ম ব্যবহার করতেন না। ভিক্ষুক ভিক্ষা না পেলে নেগেটিভ এপ্রোচে চলে যান। 'আল্লাহও ওয়াস্তে' শুনে তখন আল্লাহ তায়ালার প্রতিও ক্ষেদোক্তি ঝেড়ে দিতে পারেন। তাকওয়াবান মানুষ ভিক্ষা দিতে না পারলে, কাউকে দান করতে না পারলে, সেখানে আল্লাহ তায়ালাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন না। আমি আশ্চর্য হই, ভিক্ষুকরা কেন দিনের পর দিন আল্লাহ তায়ালা ও ইসলামকে ঢাল বানিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে আর তাকওয়াবানরা এই কাজটা সহ্য করে যাচ্ছে।


ট্রেনের ভেতরেই কল্পনা করছিলাম। বাংলাদেশ সরকারে ভিক্ষাবৃত্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে; আমি সেই মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী! সবার আগে কোমরে গামছা বেঁধে এই ধর্মীয় লেবাসে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতাম।


মন্ত্রণালয় নিয়ে আরো কিছু ভাবনার দুয়ারে যেতেই টাঙ্গাইল স্টেশন এসে গেল। মন্ত্রী হওয়া তো হলো না; আমি নেমে গেলাম আর ট্রেনের ভেতরে হরেক মানুষের হরেক আয়োজন চলতে থাকলো।


আমি তখন রিক্সা খুঁজি।

পঠিত : ১১৪৩ বার

মন্তব্য: ০