Alapon

একজন সত্যান্বেষির গল্প...


মাওলানা তারেক জামিলের নাম শুনেননি এমন মানুষ খুবই কম। যার কথার মূর্ছনার হৃদয়ের ঝর্না ধারার এক অপুর্ব সুর ভেসে ওঠে। খেই হারিয়ে চলে যেতে হয় ভাবনার গহীন থেকে গহীনে। নিজের অস্তিত্ব, এবং জীবনের উদ্দেশ্যের চরমতম অনুভূতির মাধ্যমে বারবার মনে হতে থাকে -

• হায় আজ আমি কোথায়!

• আমার প্রতিপালক থেকে কতো দূরে!

• অথচ কতোই না ভালোবাসেন তিনি আমায়!

• তাকে পেতে অবশ্যই কিছু করা উচিত আমার!

• আমি ফিরে আসতে চাই এই অন্ধকারে জরাজীর্ণ অশান্তির ঘাঁটি থেকে।

যার বয়ান শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের গুনাহের কথা ভেবে অনুশোচনায় ভোগেন, কাঁদেন, গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে পরেন। যার কথায় হৃদয়ের গহীনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ খেলে যায় অচেনা এক অনুভূতি! যে অনুভূতি রাব্বে কারিমের দিকে ফেরাতে বারবার ছটফট করে তোলে নিজেকে। হৃদয়ের প্রতিটি কোনে কোনে আন্দোলনের ঝড় ওঠে একটি প্রশ্ন বারংবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে বলে- "আজ তুই কোথায়!, এ কোন পথে! জান্নাত থেকে কতোদূর?" । তখন মনে হয় জীবনে কি যেনো একটা নেই! কিসের যেনো একটা শূণ্যতা! সেই শূণ্যতা যে মহান রবকে পাওয়ার, চেনার এবং মানার শূণ্যতা, সেটাই বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি।

সর্বমহলে ব্যাপক সমাদৃত এবং গোটা বিশ্বে জনপ্রিয় এই বরেণ্য দায়ীর জন্ম পাকিস্তানের পাঞ্জাব শহরে। সেখানে তিনি ১৯৫১ সালের পহেলা জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হিসেবে সোনার চামুচ মুখে দিয়ে তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানানো। এবং তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবীও। বাবা মায়ের সেই স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। করাচি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং এএফসি পিএস শেষ করেন তিনি।

তো এখন প্রশ্ন হলো, মানুষের শরীরের চিকিৎসক থেকে কিভাবে হলেন তিনি উম্মতের রূহের চিকিৎসক! কোন জয়েন কাঁঠির সংস্পর্শেই বা বদলে গেলো তাঁর জীবনের বাঁক! কিভাবে তিনি একজন ডাক্তার থেকে, জেনারেল শিক্ষিত হয়ে, ইসলামের গন্ডির বাইরে থেকে সত্যের পথে পা বাড়ালেন?

জানলে আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। তারেক জামিল সাহেব কারো বয়ান শুনে পরিবর্তন হননি, কারো বই পড়ে পরিবর্তন হননি, কারো মুযেযা বা কেরামতি দেখেও পরিবর্তন হননি। তিনি পরিবর্তন হয়েছেন একজন মানুষের নামাজ দেখে! অবাক হলেন তাইনা! ভাবছেন নামাজ দেখে আবার জীবন পরিবর্তন হয় কিভাবে! আর সেটা কার নামাজ ছিলো জানেন? আপনি সম্ভবত ভাবছেন বড় কোনো অলি আউলিয়া বা বিখ্যাত কোনো হুজুরের নামাজ দেখে! জ্বি না পাঠক। নামাজটি ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নাঈম। আরও অবাক হয়ে গেলেন তাইনা! আসুন সেই গল্পটি শুনি।

তিনি তখন করাচি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তখন বাংলাদেশ থেকে এক তাবলীগ জামাত গিয়েছিলো সেখানে। এ সময় তাঁর এক দ্বীনদার বন্ধু এই তাবলীগ জামায়াতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তাকে জোড় করে মসজিদে নিয়ে আসেন। তিনি অনিচ্ছা সত্বেও মসজিদে ঢুকলেন এবং সেদিন জুমার দিন ছিলো তাই জুমার নামাজ পড়লেন। নামাজ পড়ে বসে আছেন তিনি। হঠাৎ একজন বাংলাদেশীর নামাজ দেখে চোখ আটকে গেলো তাঁর। ধাক্কার মতো খেলেন তিনি, আশ্চর্য তো! মানুষ কিভাবে এতো সুন্দর করে তাঁর রবের প্রার্থনা করতে পারে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড.নাঈম এর এই নামাজ দেখেই তাঁর চেতনা বদলে গেলো। জীবনের মোর ঘুরে গেলো।

সে নামাজ তাহলে কেমন ছিলো ভাবুন একবার! আমাদের মতো উদাসীন ওয়ালা? শ্রীহীন? কয় রাকাআত পরলাম মনে থাকে না, এমন! না প্রিয় পাঠক। সে নামাজ তো ছিলো খুশু-খুজু ওয়ালা বিনয়ে বিগলিত নামাজ, সেজদায় অশ্রুসিক্ত নামাজ, রাব্বে কারিমের স্মরণ ওয়ালা নামাজ। এই নামাজ দেখেই তিনি ৩ দিনের জন্য চলে যান রাব্বে কারিমের সুন্দর প্রার্থনা শেখার জন্য, সুন্দর ভাবে নামাজ শেখার জন্য। তাঁর কাছে মনে হলো এটা ৩ দিনে শেখার বিষয় নয়। ফাইনাল পরিক্ষা শেষ করে ৪০ দিনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় গেলেন। এবং বুঝতে পারলেন জীবনের আসল রহস্যকে, জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে। সেখান থেকে ফিরে এসে মাকে বললেন - "আম্মা তোমার ছেলে শুধু করাচির মানুষের হার্টের ডাক্তার হতে চায় না বরং পুরো উম্মতের রূহের ডাক্তার হতে চাই।" শুরু হলো পরিবার থেকে বিভিন্ন চাপ। তাঁর বাবা মা কিছুতেই তাকে ইসলামের এলেম শিখতে দিবে না। মাওলানা হতে দিবে না। বিভিন্ন গালিগালাজ করতো। শেষে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। তাঁর বাবা বললো- মাওলানা হবি তো বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। দিনটি ছিলো ১৯৭২ সালের ২৩ নভেম্বর।

তারপর ভর্তি হলেন মাদ্রাসায়। হযরতজ্বী আব্দুল ওহাব সাহেবের সহবতে নিজেকে রাঙিয়ে তুললেন অন্য এক মানুষ রূপে। দাওরায় হাদিস পাশের পর ইফতা তাফসীর হাদিস নিয়ে আরও পড়াশোনা করলে।পরিশেষে তিনি এমন আলেম হলেন, শুধু অমুসলিমরাই তাঁর কাছে ইসলামের দীক্ষা নিয়ে সৌভাগ্য অর্জন করেছেন এমন নয়, বরং মুসলমানদেরকেও তিনি খাঁটি মুসলমান বানাতে পরিপূর্ণ দ্বীনের পথে আনতে যান, মাল কোরবানি দিয়ে মেহনত করেই যাচ্ছেন।

তারই ফলাফল সরূপ পাকিস্তানের বিখ্যাত পপ সিঙার জুনায়েদ জমশেদ, যার গানের জন্য তখনকার প্রসিডেন্ট পর্যন্ত রিকুয়েষ্ট করতো। সেই জুনায়েদ জমশেদ তারেক জামিলের সংস্পর্শে পরিবর্তন হয়ে যান। জীবনের মোর ঘুরে যায় জান্নাতের দিকে। তারেক জামিলের ছোঁয়ায় বিখ্যাত ক্রিকেটার ইন্দ্রা মাহমুদ হক, সাকলাইন মুস্তাক, মুস্তাক আহমেদ, সাঈদ আনোয়ার তাদের জীবন দ্বীনের জন্য ব্যায় করা শুরু করেছেন। এমনকি পাকিস্তানের এক জাতীয় দলের খেলোয়াড় ইউসুফ ইহোনা তার ধর্ম ত্যাগ করে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে মোহাম্মদ ইউসুফ হয়ে গেলেন। তাঁর সংস্পর্শে পাল্টে গেছেন বিখ্যাত ক্রিকেটার শহিদ আফ্রিদিও। মাওলানা তারেক জামিলের এই দ্বীনি দাওয়াতি মেহনতে শুধু তারাই নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের দ্বীনি চেতান জাগ্রত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ দ্বীনের দায়ীতে পরিনত হয়ে গেছেন।

শুধু তাই নয়, তিনি লিখেছেন অসংখ্য বই পুস্তকও। সে বইগুলোর সাহিত্যমান, লেখনশৈলী, কথা গুচ্ছ হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। "The Muslim Five Hundred" বক্তাদের তালিকায় সবার উপরে তাঁর নাম। ইউটিউবে তিনি সারাবিশ্বে জনপ্রিয়। এরই মধ্যে অর্জন করেছেন গোল্ডেন বাটন।

ইসলামের দাওয়াত প্রচারে মানুষের ইমান এবং নিজের ইমানি শক্তিকে দৃঢ় করতে তিনি মেহনত করেই যাচ্ছেন। তাঁর হৃদয়স্পর্শী বয়ান গুলো শুনলে আপনি তাক লাগিয়ে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য। তাঁর বয়ান শুনে কান্না করেননি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। কেনোনা এমন বয়ান শুনলে আপনি নিজেকে উপলব্ধি করতে পারবেন, আপনি কতোটা রব থেকে দূরে আছেন, কতোটা ভুলের পথে আছেন এবং কি করা উচিত সবকিছু চোখের সামনে ভাসতে থাকবে আপনার। রবকে পাওয়ার জন্য, তার দিকে ছোটার জন্য হৃদয়টা ছটফটিয়ে উঠবে। আপনি বলতে বাধ্য হবেন- হায়! এতো ভালোবাসার রবকে ছেড়ে, এ কোন পথে চলছি আমি!

- সংগৃহিত

পঠিত : ৫৩২ বার

মন্তব্য: ০