Alapon

বাংলাদেশের বিবেক মরে গেছে...



আগে শীতকালে গ্রামগুলোতে যাত্রাপালা হতো। মানুষ দলবেঁধে কেউ কেউ পরিবার নিয়ে যাত্রা দেখতে যেতো। যাত্রায় একটা আবশ্যিক পাঠ থাকতো ‘বিবেকের পাঠ’। বিবেকের পাঠ দেখে মানুষ অনুতপ্ত হতো, নিজের কর্মকান্ড নিয়ে ভাবতো কখনো কখনো কান্নাও করতো। সেই যাত্রাপালাও নেই, বিবেকের পাঠও নেই। সেই সাথে আমাদের সমাজ থেকেও বিবেক বিদায় নিয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন সামাজিক অপরাধগুলো নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবসময় সোচ্চার ছিলেন। ড. হুমায়ূন আজাদ থেকে শুরু করে আহমদ ছফা পর্যন্ত প্রত্যেকেই অপরাধ, অন্যায়, জুলুমের বিপক্ষে সোচ্চার থেকেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন। তারা কখনো বাছ-বিচার করতেন না, অন্যায়টা সরকারী দলের লোক করেছে নাকি বিরোধী দলের লোক করেছে। তারা অন্যায়কে অন্যায়ই বলতেন। কারণ, তাদের বিবেক ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে আহমদ ছফার মত এমন একজনও বিবেকবান সাংবাদিক পাওয়া যাবে না, যে সরকার প্রধানকে সরাসরি প্রশ্ন করবে, ‘আপনার দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীদ দেশটাকে ধর্ষণের দেশে পরিণত করেছে। এর প্রতিকার করুন, অথবা নিজের অযোগ্যতা ও অক্ষমতা স্বীকার করুন।’ উপরন্তু আজকের সাংবাদিকরা সরকার প্রধানের সামনে হাত দুখানা জোড় করে গদগদ হয়ে বলে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনার এবং আপনার দলের কারণে বাংলাদেশে আজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা কল্পনাতীত!’ কল্পনাতীতই বটে। বাংলাদেশ কখনো ধর্ষণের দেশে পরিণত হবে, তা কেউই কখনো কল্পনা করেনি।

শিক্ষকরাই নাকি মানুষগড়ার কারিগর! অথচ দেশে এতো অরাজকতা, অন্যায়, জুলুম, গুম, খুন এবং পরিশেষে ধর্ষণ মহামারি রূপ ধারণ করেছে তা নিয়ে বলিষ্ঠ স্বরে কথা বলার হিম্মত রাখে না। একটা সময় পত্রিকার কলাম নিয়মিত পড়তাম। অন্তত কলামগুলোতে দেশের প্রকৃত অবস্থা ও প্রতিকার উল্লেখ থাকতো। কিন্তু সেই কলামগুলো এখন আর পড়ার যোগ্য নয়। কলামিস্টরাও যেন এখন সুবিধাবাদী জিন্দাবাদ বনে গেছে। আর যাবেই বা না কেন, জীবনের মায়া বড়ো মায়া। আর এই মায়ার বাধনে আটকা পড়ে সবাই শুধু জি হুজুর জি হুজুর জপতেছে। সেখানেও আজ বিবেকের শূণ্যতা বিরাজ করছে।

সিলেট এমসি কলেজ! এই কলেজেরই ঐতিহ্যবাহি হোস্টেল পুড়িয়ে দিয়েছিল ছাত্রলীগ। তখন তাদের কারোরই বিচার হয়নি। উপরন্তু নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে তৎকালীণ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কান্না করেছিলেন। সেদিন যদি কান্না না করে, মন্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখার লোভ না করে সঠিক অ্যাকশন নিতেন তাহলে আজকে আর এমন ধর্ষণের ঘটনা ঘটতো না। ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে দেওয়ার পরও যখন কারো বিচার হয় না, তখন তো বেপোরায়া হবেই। আর এটাই তো স্বাভাবিক। আর সেই স্বাভাবিকতা থেকেই তারা গৃহবধূকে ছাত্রাবাসে আটকে রেখে ধর্ষণ করার সাহস করে। ধর্ষণ করার পরও তারা ছাত্রাবাসে বসেই মাদক সেবন করে, আর কলেজ ক্যাম্পাসের বাহিরে পুলিশের ওসি সিগারেট ফুকে। এটাই হল আইনের বিবেক!

আমাদের রাজনীতিবিদদেরও আজ বিবেক বলতে কিছু নেই। আজ তাদের বিবেকও হারিয়ে গেছে। ধর্ষণ এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সামাজিক সমস্যাও নয়। বরঞ্জ ধর্ষণ এখন জাতীয় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আর জাতীয় সমস্যাগুলো একজোট হয়েই মোকাবেলা ও সমাধান করতে হয়। কিন্তু এই জাতীয় সমস্যাকে অনুধাবন করার মত বিবেক আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের আছে বলে মনে হয় না! নচেত এমতাবস্থায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দলে নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে জাতির কথা ভেবে এক মঞ্চে সামিল হয়ে ধর্ষণ প্রতিরোধ করার ডাক দিতো। ধর্ষকদের দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি এবং শাস্তি কার্যকরের দাবি জানাতো। কিন্তু সকল রাজনৈতিক দল শুধু দ্বায়সারা একখানা বিবৃতি দিয়েই নিজেদের দ্বায়মুক্ত করেছেন। তবে দু একটা দল সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

এক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে নিপীড়নের স্বীকার রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামি ছাত্রশিবির ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজপথে আন্দোলন করছে। অথচ বিবেক থাকলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও এই আন্দোলনে সামিল হতো। কিন্তু আমাদের বিবেক মরে গেছে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের বিবেকও মরে গেছে। প্রত্যেকেই কেবল নিজের ভালো থাকার চিন্তা করছি! কিন্তু সমাজ ভালো না থাকলে, দেশ ভালো না থাকলে যে আমরা কেউই ভালো থাকতে পারবো না, এ কথা কেউই অনুধাবন করতে পারছি না। কারণ, আমাদের বিবেকও যে মরে গেছে।

পঠিত : ৪৯২ বার

মন্তব্য: ০