Alapon

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ প্রকৃতিপাগল এক শক্তিমান কথাশিল্পী.....

জীবন যখন কঠিন হয়ে সামনে আসে, চারদিক যখন দম বন্ধ লাগে, যখন শহরের ‍নিষ্ঠুর কোলাহলে প্রাণ হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত, তখন আমার মনে পড়ে নিরেট সহজ-সরল-সাধারণ এক গ্রাম্য ছবির চিত্র। অবারিত সবুজ গ্রামবাংলা, বাঁশঝাড়ের ফাঁক গলে রোদের উঁকি দেয়া আর ধানগাছের মন মাতানো শির দোলানোর নৈপূণ্য দেখে মনে হতে থাকে, বুঝিবা বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনো দৃশ্য। এমন দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে যায় তাঁর কথা। অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকই প্রকৃতিকে ভালোবেসে অনেক রচনা বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে উপহার দিয়েছেন, কিন্তু বিভূতিভূষণের মতো্ করে এমন আপন সুষমায় প্রকৃতিকে কলমের আঁচড়ে অক্ষিকোটরের সম্মুখে তুলে ধরতে পেরেছেন খুব কম কথা সাহিত্যিকই।


বাংলা গদ্য সাহিত্যে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জনপ্রিয়তায় বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পরে যদি কারো নাম জিজ্ঞাসা করা হয় তবে নিঃসন্দেহে তিনি হলেন- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা উপন্যাসে শ্রেষ্ঠত্বের আসন যিনি নিজ গুণে দখল করে নিয়েছেন, তাঁর রচনায় মধুর ও কাব্যধর্মী ভাষাশৈলী প্রয়োগের মাধ্যমে। গ্রামীণ জীবনের অসামান্য রূপকার, নিম্নবর্গের কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আদি প্রাণের আধুনিক বন্দনাকার বিভূতিভূষণ নিসর্গ চেতনার বাতিঘর। মানব জীবনের রহস্য, জটিলতা, কিছু সুখ, অল্প হাসি-কান্না আর কিছুটা মান-অভিমানকে যিনি স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখনীর ভেতর দিয়ে।


সাহিত্য সমালোচকদের মতে, বিভূতিভূষণ যে মানবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা সারল্যে অসাধারণ। সনাতন গ্রামবাংলার জনজীবনের চিরায়ত ছবি তিনি এঁকেছেন নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায়। গভীর মমতায়, শ্রমে তিনি এই কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে আশ্চর্য রকম সফল তিনি। গ্রামীণ জীবনের শান্ত, সরল, স্নিগ্ধ ও বিশ্বস্ত ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নিরাসক্ত কথকতা ও বয়ানে, চুম্বকের মতো টেনে নেয় পাঠককে। মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। অথচ পথের পাঁচালি, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতির মতো অসামান্য সব উপন্যাসের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখির জীবন ছিল স্বল্প। মাত্র ২৮ বছর। এই লেখকের আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর। তার রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ১৫টি উপন্যাস, ২০টি গল্পগ্রন্থ', ৭টি কিশোর উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী এবং দিনলিপি।


বিভূতিভূষণ বিয়ে করেছিলেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে। ১৯১৯ সালে বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের সুখ তাঁর কপালে বেশি দিন ছিলো না। বিয়ের মা্রে এক বছর পরই গৌরী দেবী নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই ছোট বোন মণি সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়। এই দুটি মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে মারাত্মক আঘাত পান। পরবর্তী সময়ে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর দীর্ঘ ২৩ বছর পর ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে তার সাহিত্য জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিয়ের সাত বছর পর একমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তারাদাস পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রবেশ করেন সাহিত্যের সুরম্য অরণ্যে।


ভাগলপুরে কাজ করার সময় ১৯২৫ সালে তিনি “পথের পাঁচালি” রচনা শুরু করেন। এই বই লেখার কাজ শেষ হয় ১৯২৮ সালে। আদি ও বর্তমান সামাজিক উত্থান-পতন ও সামাজিক কুসংস্কারেরই প্রতিচ্ছবি এই উপন্যাস। এরপর “অপরাজিত” রচনা করেন- যা “পথের পাঁচালির”ই পরবর্তী অংশ। উভয় উপন্যাসেই তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। 'পথের পাঁচালি' বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।' জীবনকে মোহহীনভাবে দেখার নিদারুণ সত্যকেই হয়তো বা বুঝাতে চেয়েছেন কবিগুরু তার কথাতে। আঞ্চলিক জনজীবন নির্ভর 'ইছামতী' উপন্যাসটিও বিভূতিভূষণের আরেকটি সেরা রচনা।


মানুষের মতোই প্রকৃতিও রহস্যময় এবং বৈচিত্র্যময়। এই রহস্যময়ী মানুষ ও প্রকৃতিকে পৃথক স্বাধীন মাত্রা দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। প্রকৃতির নিগূঢ় সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তার শিল্পজগৎ প্রকৃতির বিচিত্র রূপ-রস অনুভূতির আনন্দে বিহ্বল। তিনি অধিকাংশ নিসর্গ কবিদের মতো প্রকৃতির জড়-সৌন্দর্য শুধু নয়, জৈবিক মানবজীবনকেও এঁকেছেন একই ক্যানভাসে। প্রকৃতি সম্পর্কে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তার একান্ত নিজস্ব মৌলিকতা। বিভূতিভূষণের কাছে কোনো নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধের কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থ ছিল না, যদি না সেসব নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধ মানুষকে আশ্রয় দিতে না পারে।


বিভূতিভূষণের নিজস্ব ধরনের গদ্যে আবৃত ভাষাভঙ্গি ও এর অন্তর্নিহিত কারুকুশলতা গুণে তার কথাসাহিত্য, দিনলিপি, পত্রাদি এবং ভ্রমণকাহিনীগুলো পাঠককে বারবার মোহিত করে। সে কারণেই তার লেখায় বারবার ভেসে ওঠে এমন এক জগতের আহ্বান, যা লুকিয়ে রয়েছে তার মনের গহিনে, কল্পলোকের ভুবন হয়ে। নিত্যদিনের একঘেয়ে বাস্তবতার মাঝেও প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনের সঙ্গে বিগত দিনের স্মৃতিকাতরতার যে অনবদ্য সমাহার, বিভূতিভূষণের লেখনীতে তা বারবার মূর্তময় হয়ে ওঠে। তাই তিনি সমকালে এবং উত্তরকালেও পাঠকনন্দিত, আপন মহিমায় ভাস্বর।

পঠিত : ৬৯৮ বার

মন্তব্য: ০