Alapon

ইসলামের প্রথম গায়েবানা জানাযা




১.শিফু আর নিপু। দুজনের ভারি মিল-মুহাব্বাত। শিফু ক্লাস ফাইভ শেষ করে মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও নিপু স্কুলেই রয়ে গেছে। দুর্দান্ত মেধাবী শিফু। স্রোতের মাঝে গা এলিয়ে দেয় নি। নিজেকে হেফাজতে রেখেছে। স্রোতের বিপরীতেই টিকে আছে। কিন্তু নিপু ঠিক উল্টো। শিফু যতোটা স্রোতের বিপরীতে নিজেকে ধরে রেখেছে, নিপু ততোটাই স্রোতের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে, বেফরোয়াভাবে। একেবারে উল্টো যাকে বলে।

এই পর্যন্ত সে অর্ধ-ডজন প্রেম তো করেছেই। কাউকে সে ছেড়েছে কেউ-বা তাকে ছেড়েছে। ব্রেকআপের গল্পে জীবন ভরপুর একেবারে। পর্দা, স্বলাত, সিয়াম এসবে তো নিপুর আজন্ম অনীহা। এমন বল্গাহীন জীবনাচারণ থেকে ফিরে আসার কতো যে আহ্বান শিফু তাকে করেছে তার কোনো হিসেব নেই।

পড়াশোনার ব্যস্ততাসহ নানাবিধ কারণে দেখা-সাক্ষাত হয়ে ওঠে না তাদের দুজনার । আগামীকাল দুজনেই ফ্রি আছে। তাই উভয়ই সাক্ষাতের ইচ্ছে প্রকাশ করলো।

২.শরতের আকাশ। আকাশে শাদা শাদা মেঘ। মেঘগুলো দেখতে ভালোই লাগে। মন চায় মেঘের সাথে উড়ে উড়ে আকাশে ভেসে বেড়াতে। সেই শরতের বিকেলে যাত্রাবাড়ি ওয়াপদায় দুজনে এসেছে মনের সুখে গল্প করতে, আড্ডা দিতে। কতোদিন দেখা হয় না দু'জনার....

ওয়াপদায় বিকেল হলে হাজারো মানুষের আনাগোনা। কংক্রিটের দেয়ালে ঘেরা শহরটাতে একটু প্রকৃতির স্বাদ-ছোঁয়া এখানে কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। কয়েকটা খেলার মাঠ। গাছগাছালির ছাঁয়া মোড়ানো টুকরো টুকরো সবুজবীথি। সারি সারি কাশফুল। সেই কাশফুলের শুভ্রতা! মনটা ভরে যায় স্রষ্টা-প্রদত্ত প্রকৃতির এতোসব রূপ-যৌবনের ছোঁয়ায়!

শিফুর আগেই সেখানে গিয়ে হাজির নিপু। দক্ষিণ-পশ্চিম কর্ণারে সফেদ কাশফুলে ঘেরা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছে আর মেসেজে নিজের অবস্থানের জানান দিচ্ছে শিফুকে!

.... দেখা হতেই নিপুর চোখেমুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠলেও মুখে বলে উঠলো আরেহ শিফু! তুই এখনো এরকম বস্তাবন্দি চলাচল করিস? আজব তো! কী বিচ্ছিরি গরম পড়ছে তবুও তুই.....

নিপুর কথা শেষ না করতেই শিফু কথাটা মুখ থেকে কেঁড়ে নিয়ে বললো, '' তবুও বস্তাবন্দী হয়ে রাস্তায় বের হয়েছি, এই তো! আর কোনো কথা বললো না নিপু। বললো ঠিকাছে বাপু জলদি বস! দুজনেই বসে পড়লো। সবুজ ঘাসের কোমল ডগায়।

নিপুর ইদানীং ইসলামের বিধিমালার ওপর নানারকম প্রশ্ন! নানন ধরনের অভিযোগ!

নিপু বসেই বললো দেখলি ইসলাম তো তোকে বস্তাবন্দি করেই রাখতে চায়! বলতো ইসলাম আসোলে নারীদের কী'বা মূল্যয়ান করে? কোন দৃষ্টিতে দ্যাখে!

তার এমন অজ্ঞতা এবং শিশুসুলভ প্রশ্ন আর মন্তব্য শুনে শিফুর মাথায় যেনো ভিমরি খেয়ে গেলো! মন চাইলো কষে একটা চড় মেরে দিতে! কিন্তু দা'ঈদের ফুল হতে হয়। কাঁটা নয়। দা'ঈরা কাঁটার আঘাত খাবে। সেই আঘাতে প্রয়োজনে ক্ষত-বিক্ষত হবে। তবুও তাঁরা সুরভী ছড়াবে। তাই সে কিছুই করে নি। কিছু বলেও নি। মাথা যথেষ্ট পরিমাণ ঠান্ডা রেখেছে। তার মনে পড়লো আল-কুরআনের সেই আয়াতখানি, " আপনি মানুষকে আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা ডাকুন এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়। " [১]

তাই শিফু কোনো কথা রাগের মাথায় না বলে বললো, শুন নিপু; আজকে তোকে একটা গল্প বলি। সত্যি গল্প। কবির কল্পনার কল্পিত গল্প নয়! গল্পটা হলো ইসলামের প্রথম গায়েবানা জানাযার গল্প। তা হলে মন দিয়ে শুনবি। কোনো কথা নয়, ঠিক আছে?

৩. "মাসজিদে নববীতে ঝাড়ু দিতেন একজন মহিলা সাহাবী। ওনার নাম উম্মে মাহজান। তিনি ছিলেন অবসিনিয়ার কৃতদাসী। আমরা আজকে যেটাকে ইথিওপিয়া বলে চিনি। তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে যেমন আনন্দের উচ্ছলতায় আবেগী হয়ে উঠেছেন, তেমনি এক টুকরো দুশ্চিন্তার ঘন কালো মেঘও জমা হয়েছে কপালের ভাজে। মনের কোণে। কারণ, তিনি তো নারী। এমন সময় ও সমাজের নারী - যে সমাজে আবার নারীর কোনো কদর নেই। একটা পশুর যে মূল্য আছে, নারীর সেটাও নেই তখনকার দিনে। সেই পরিবেশে। সেই সমাজে। আরো হলো তিনি কৃতদাসী। অসহায়। দুর্বল। সম্বলহীন। স্বজনহীন।

তিনি কোথায় যাবেন ভাবতে লাগলো। হঠাৎ শুনতে পেলেন মদিনায় একজন মানুষ আছেন। সেই মানুষটা মানুষকে ডাকছেন। সেই ডাকা সত্যের দিকে। আলোর দিকে। অন্ধকারকে ঝেড়ে ফেলার দিকে। কল্যাণের দিকে। সফলতার দিকে। মজার ব্যাপারহচ্ছে ওনার আহ্বানে সাড়া দেওয়া বেশিরভাগ অনুসারী দরিদ্র। দূর্বল। ক্রীতদাস। নির্যাতিত। এককথায় পিছিয়ে থাকা সব সাধারণ মানুষ। এই মানুষেরাই হলো তাঁর অনুসারী। অনুগামী। অনুগত।

তিনি ছুটলেন মদীনার পথে । সেই মহান মানুষটার দিকে --যিনি মানুষকে ডাকে সত্যের দিকে। আলোর দিকে। কল্যাণের দিকে। মুক্তির দিকে।

ধু ধু মরুভূমি! মরুভূমির বিশাল পথ। সেই পথ পেরিয়ে তিনি পৌঁছলেন মদীনায়। নবিজীর কাছে।

তাঁকে তো ( উম্মে মাহজান) দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলো। তিনি মুক্তি পেলেন। মুক্তি পাওয়ার আগেই তাঁকে তাঁর মালিক চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত করেছেন। জর্জরিত করেছেন। চাবুকের আঘাতের যেই ক্ষত, সে ক্ষত তখনও শুকোয়নি । ছিন্ন বস্ত্র। জীর্ণ-শীর্ণ কালো দেহ। ক্ষুধার্ত পেট। নবীয়ে রহমত সেই সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সেই সকরুণ অসহায় চাহনির দিকে তাকালেন। সেই ক্রীতদাসীকে চিনে নিতে কোনো কষ্ট হয়নি মহামানব মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লামের।

সেখানেই সেই কৃতদাসী ঘোষণা দিলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহম্মাদুর রসুলুল্লাহ ।’

দ্যাখ তিনি কালো। অসহায়। সম্বলহীন। দুর্বল। ক্রিতদাসী। ইসলামের ছাঁয়াতলে আসতে চেয়েছেন। আসতে পেরেছেন।
নারী বলে, ক্রিতদাসী বলে বিন্দু-বিসর্গ পরিমাণও অবহেলা করা হয় নি তাঁকে।

আচ্ছা তিনি যে ইসলামের ছাঁয়ায় এসেছেন, সে মানুষটাকে তো থাকতে হবে। তাই না? নবীজি সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম ওনার থাকারও ব্যাবস্থা করে দিলেন। কোথায় দিয়েছেন জানো? মাসাজিদে নববীতেই দিয়েছেন। রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওনার খোঁজ-খবর রাখতেন। প্রতিদিন। নিয়মতই...

এমন একজন মানুষের খোঁজখবর আজকে তোকে যারা কথিত নারীবাদিতার সবক শেখায়, ইসলাম বিদ্বেষের মন্ত্র শেখায় তাঁরা নেবে? না নেয়? না নিয়েছে! খুঁজে দ্যাখ তাঁরা কাজের লোক, দুর্বল-অসহায় পেলে আরো জেঁকে ধরে। নির্যাতন করে। বউ রেখে-বর রেখে হাজারো মানুষের বিছানা কাঁপায়। অন্তরালে তাঁদের আছে আরো শতো-সহস্র ঘুটঘুটে অন্ধকারের আনোগোনা। অসংখ্যসব নষ্টামোর হাতছানি। যাই হোক কারো ভেতরটা খোঁজা আমাদের কাজ নয়। দায়িত্ব নয়। উদ্দেশ্যও নয়। তোকে জাস্ট ধারণা দেবার জন্যই বলেছি।

মানুষ তো অমর নয়। মরনশীল। কেউ আগে কেউ পরে, এই হলো ফাঁরাক। তো একদিন সারাদিনেও তাঁর দেখা পেলেন না নবীজি। দেখা না পেয়ে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চাইলেন ওনার কথা। সাহাবায়ে কিরাম রাদিআল্লাহু আনহুমা জানালেন যে, তিনি অসুস্থ হয়ে আগের রাতে মারা গিয়েছেন। রাত বেশি ছিলো। নবীজি ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত বেশি হওয়াতে তাঁকে কেউ আর ঘুম থেকে ডাকতে চায়নি। রাতের আঁধারেই দাফন দিলেন উম্মে মাহজানকে।

বিষয়টা জেনে নবীজি সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম দারুণ দুঃখ পেলেন মনে। সাথে সাথেই তার কবরে গিয়ে বাকি সাহাবীদের নিয়ে আবার জানাযা পড়লেন তিনি।[২]

জানিস, ইসলামে দ্বিতীয় জানাযা এটাই প্রথম। এই যে দ্বিতীয় জানাযা, এই দ্বিতীয় জানাযা কোনো সেলিব্রেটির জন্য নয়। নয় কোনো প্রভাবশালী বা কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির জন্য। জাস্ট একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসীর জন্যই আমাদের প্রিয় নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়িয়েছেন ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গায়েবানা জানাযা! বুঝলি, এটাই হলো ইসলাম। এটাই হলো আমাদের প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম। এরকমই ইসলামে নারীর অবস্থান। এরকমই মূল্যায়ন। ইসলাম এরকম বা তারচেয়েও বেশি দেয় নারীর মর্যদা, মর্তবা, সম্মান। হালকা হলেও এই গল্প হতে বুঝতে পেরেছিস!

তা হলে বল্! কার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে, কাদের দ্বারা ধোঁকা খেয়ে এসব উল্টো-পাল্টা বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিস, বলতো? তুই তো এমনই ব্যস্ত যে আল-কুরআনটাও ঠিকঠাক ধরিস না। জীবনে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লামের নরমাল ছোটোখাটো একটা সীরাহও পড়িস নি।
তাহলে ক্যানো অযথা মানুষের দ্বারা প্রভাবিত আর প্ররোচিত হয়ে এমন সব কথা বলিস? ক্যানো তাদের সাথে চলিস, তাদের কথা শুনিস -যারা নিজেরা তো নিজদের নরকের কীট বানাচ্ছেই, সাথে তোর-আমার মতো অসংখ্য যুবক-যুবতিদেরও নিচ্ছে সে পথে -যে পথ যে চিন্তে চিরস্থায়ী অনলের উন্মাদ লেলিহানের!!

নিপুর ভাবনার জগতে যেনো আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ খেলে উঠলো!
একেবারে সে চুপসে গেলো। দৃষ্টি অবনমিত। চোখজোড়া ফেলে রাখলো নিচের দিকে। ঘাসের ডগায়।

-রেফারেন্স-
--------------------

[১] আলকুরআন: ১৬/১২৫
[২] সহীহ্ বুখারী : ৪৩৯

||ইসলামের প্রথম গায়েবানা জানাযা||
~রেদওয়ান রওয়াহা

পঠিত : ৭২৬ বার

মন্তব্য: ০