Alapon

আসুন, আগে নিজে শুদ্ধ হই!!



অন্যকে আঘাত করতে ভালো লাগে। অন্যের মর্যদাহানী করতে আনন্দ লাগে। অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আনন্দ পাই। অন্যকে উপহাস করে তৃপ্তি পাই। আরেকজনকে ক্ষুদ্রজ্ঞান করতে মজা লাগে! অপরের দোষ চর্চায়, দোষ খোঁজায়, ত্রুটি আবিস্কারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়ে আমরা। মতের অমিল হলেই বলি দালালি করছে, পিঠ বাঁচাচ্ছে, গা বাঁচাচ্ছে। ভালো সাজার চেষ্টা করছে। ভিন্ন চিন্তার কাউকে পেলেই নাজেহাল করার চেষ্টা করি। সেই নাজেহাল করার মাঝেই অদ্ভুত এক প্রশান্তি খুঁজি।

লোকে ভালো বললে ভালো লাগে। নিজেকে জ্ঞানী, বিজ্ঞ আর বিচক্ষণ প্রমাণে সবরকমের সাধনা করি। আমাকে কেউ বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান আর বিচক্ষণ বললে মনে মনে এক অপূর্ব প্রশান্তি পাই । হাজারো অপকর্মের সাইক্লোন বইয়ে দিয়েও জগতের সমানে সুফি- দরবেশ-সাধু সাজার এক অদ্ভুত কারিশমা করি! মানুষের সামনে নিজেকে মুমিন, মুহসীন ও মুত্তাকি হিশেবে উপস্থাপন করি। উদরতা, সহনশীলতা আর প্রগতিশীলতার কথা বললেও নিজে থেকে সে সবের কোনো নযীর স্থাপন করি না। সুযোগ পেলেই মানুষের ইমোশনে আক্রমণ করি। মানুষকে ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করি। লেবাসধারণ করে মানুষের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করি। কেউ যখন মুখোশ উন্মোচন করে ফেলে, তখন ইনিয়েবিনিয়ে ভয়ংকর মিথ্যের আশ্রয় গ্রহণ করি। আবার এই আমিই অন্যকে দুর্দান্ত ঈমান জাগানিয়া, চেতনা জাগানিয়া সব উপদেশ দিই!

মানুষকে বয়ান করি হিংসা, গীবত ও পরশ্রীকাতরতা বন্ধ করতে। কিন্তু নিজেই অন্যের দোষ, অন্যের বদনাম, অন্যের ওপর হিংসার বশবর্তী হয়ে সেইম কাজগুলোই করি। বরং ক্ষেত্র বিশেষ তারচে বেশিই করি! পরশ্রীকাতরতা যেনো রক্ত-মাংসে গেঁথে রয়েছে আমাদের। অন্যের ভালো সহ্য হয় না। অন্যের উন্নতি আমার ভালো লাগে না। কারো জনপ্রিয়তা আমার হজম হয় না। অন্যের পেছনে জোঁকের মতো লেগেই থাকি হরদম! আর আমিই সে মানুষটা সেসব থেকে মানুষের সংশোধন করার কী মহা কোশেশই না করছি! এই বিষয়টা যে আল্লাহর কাছে কতো বড়ো অপছন্দনীয় তা কি জানি না? আল্লাহ যে আমাকে বলেছেন যা করো না নিজে তা অন্যকে বলো না- তাকি আমি জানি না?[০১] অবশ্যই জানি। তবুও মানি না।


আমরা কুরআনের কথা বলি। কুরআন পড়ি। আল-কুরআন আমাদের উপদেশ দেয়, আদেশ দেয় যে -অন্যকে ঠাট্টা কোরো না। অন্যের পেছনে লেগে থেকো না। অন্যের বদনাম করতে যেওনা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অপরের দোষ খুঁজতে যেওনা। তুমি যাকে বিদ্রুপ করছো, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছো হতে পারে সে তোমার চেয়ে উত্তম![০২]


আল্লাহ বলেছেন, ধ্বংস তার জন্য, দুর্ভোগ সেসব লোকের যে বা যারা সামনে এবং পেছনে মানুষের নিন্দা করে বেড়ায়! দোষ বলে বেড়ায়! [০৩]

আমরা জানি হিংসা মানুষের আমল সমূহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। আগুন যেমন যেমন শুকনো কাঠকে কয়লা করে দেয়। [০৪] তবুও আমরা তা করি। মানুষের ভুল দেখলে তা ভালোবেসে সংশোধন করার চেষ্টা করা যেতেই পারে। কিন্তু আমি এবং আমরা কি তা করি? করি না। অন্যের মর্যদাকে যতোটা পারা যায় টেনেহিঁচড়ে নাশ করার সবরকম প্রচেষ্টা করি। দয়া-মায়া মনে আমাদের বিলকুল নেই। অথচ আল্লাহর রহমত আর দয়া পাবার পূর্ব শর্ত হচ্ছে জমিন বাসীর প্রতি মানুষের প্রতি দয়া করা। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘আল্লাহ পাক বান্দার সহযোগিতায় ততক্ষণ থাকেন যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে।’ [০৫]

আচ্ছা আমরা কি আমার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকি? তাঁর ব্যক্তিত্ত্বের হেফাজত করাটা, তার মান মর্যদার দিকে খেয়াল করাটাও তো আমার দায়িত্ব। তার প্রতি এটা একটা সহযোগিতাও বটে। আমরা কি এই বিষয়ের দিকে খেয়াল করি? সত্য হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে করি না।


যতোই ভালো কাজ আর ভালো কথা বলি না ক্যান, অধিকাংশ করি নিজের স্বার্থে। আমাদের জীবনে যতোটুকু ভালো কাজ করি তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেকে হিরো হিশেবে উপস্থাপন করতেই। নিজেকে ভালো প্রমাণ করতেই! অথচ মুখে বলি আল্লাহর জন্য, কিন্তু বাস্তবে এটা একটা ডাহা অসত্য কথা হয়ে গেছে। আজকের গ্লোবালাইজেশনের যুগে এটা আরো একটা বড়ো নির্মম সত্য -আমরা কিচ্ছু আল্লাহর জন্য করি না। কিচ্ছু না। ইল্লা মা শা আল্লাহ -কিছু লোক তো ব্যতিক্রম আছেই।


নিজের ওপর আঘাত আসলে তথা আমাকে আঘাত করলে তখন আর সহ্য হয় না। আমাকে কটুক্তি করলে তখন আর ভালো লাগে না। আমাকে অপবাদ দিলে তখন আর মন মানে না। তাই তখন আমার মুখ থেকে সুন্দর সুন্দর বয়ানের হিড়িক ছুটে। কিন্তু এই আমিই -যখন আমার সামনে অন্যের বদনাম করা হতো, অন্যকে অপমান করা হতো, অপরকে অপবাদ দেয়া হতো- তখন চুপচাপ বসে বসেতা উপভোগ করতাম। নিজের আখের গোছানোর কাজে মশগুল থাকতাম। আমাকে আঘাতের আগে, আমার ওপর বিপদের বিমান চাপার আগে আমি নিরব ছিলাম, নিথর ছিলাম, নিস্তব্ধ ছিলাম.....! অথচ এখন আমি এই মানুষটাই ছুটিয়ে নাসীহা করে যাচ্ছি। বয়ান দিয়ে যাচ্ছি!

আহারে.!!কী আজিব একটা জাতি -মানুষ জাতি- তাই না??

এই যে আমাদের এমন হাল, এ থেকে আগে নিজেরা উত্তরণ হবার প্রচেষ্টা করতে পারি না? মানুষকে শুদ্ধ করার আগে তো আমাকেই আগে শুদ্ধ হতে হবে। তাই না? তাই আসুন, আগে নিজে শুদ্ধ হই! অন্যকে সম্মান দিই। মর্যদা দিই। অন্যের ক্ষতি, অমর্যদা আর অপমান দেখে মিটমিটিয়ে না হাসি। অন্যের উন্নতি, সমৃদ্ধ, জনপ্রিয়তা, কল্যাণকামিতা আর ভালো দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে না মরে বরং আনন্দিত হই। উৎফুল্ল হই! আল্লাহও আমাদের মর্যদা বাড়িয়ে দেবেন। সমৃদ্ধি আর প্রাচুর্যে জীবনটা কানায় কানায় পূর্ণ করে দিবেন। ইন শা আল্লাহ!


||আসুন, আগে নিজে শুদ্ধ হই||
~রেদওয়ান রাওয়াহা


[০১] সুরা সফ-০২-০৩
[০২] সুরা হুজুরাত-১১
[০৩] সুরা হুমাজাহ-০১
[০৪] সুনানে আবু দাউদ-৪৯০৫
০৫]-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯

পঠিত : ৫৪৯ বার

মন্তব্য: ০