Alapon

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?

আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশেই গোটা কতক হিন্দু পরিবারের বাস। নিম্নবর্ণের হিন্দু পরিবার নয়, বেশ রুচিশীলতার ছাপ আছে তাদের জীবনধারায়। শৈশবে দিনের অধিকাংশ সময়ই এসব হিন্দু বাড়িতে পদচারণা ছিলো আমার। এর অন্যতম কারণ হলো, আমাদের পুরো গ্রাম মিলে তাদের বাড়িতেই প্রথম টেলিভিশন আসে। সেই টেলিভিশন দেখার লোভে আমি সারাক্ষণই পড়ে থাকতাম সেসব বাড়িতে। তারাও ঢের আদর করতেন বলে আার বাড়িতে আসার নামই থাকতো না।


বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখানোর দিন সকাল থেকে আম্মু আমার টিকিটিও খুঁজে পেতেন না। সেদিন সারাদিন আমার পড়াশুনা লাটে উঠে যাবে বলে আম্মু আমাকে ধরে আনতে বোরখা পরে উপস্থিত হতেন সেসব হিন্দু বাড়িতে। আম্মুর উপস্থিতি গোটা হিন্দু বাড়িটার পরিবেশ বদলে দিতো। তারা ঠিক কিভাবে আম্মুকে সমাদর করবেন তার পদ্ধতি উদঘাটনে সাজ সাজ রব পড়ে যেতো।


আম্মু চা নাস্তা খেতে খেতে খানিকক্ষণ হাসি হাসি মুখে গল্প করে যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন তাঁর হাতে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরা থাকতো, যেন কিছুতেই পালিয়ে যেতে না পারি। বাংলা সিনেমার বদলে আমাকে যে এখন বাংলা ব্যাকরণ বই নিয়ে বসতে হবে; তা ভাবতেই চোখে পানি চলে আসার জোগাড় হতো। আম্মুর তাতে কোনোই ভাবান্তর হতো না। মনে মনে বলতাম, “এই নিষ্ঠুর নারীকে কেন আমার মা বানাতে গেলে মাবুদ!”


সেসব হিন্দু বাড়ির মহিলারা আমাদের বাড়িতেও বেড়াতে আসতেন কোনো কোনো সন্ধ্যায়। আম্মু তখন তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কত হরেক রকম যে গল্প করতেন তারা, তার ইয়ত্তা নেই! এক ফাঁকে মাগরীবের আজান হলে আম্মু বিনীত ভঙ্গিতে বলতেন, “কাকীমা, আপনারা নাস্তা করুন। আমি নামাজটা পড়ে আসি।” আম্মুর সেই কাকীমাগণ বিনয়ে গলে গিয়ে এতো জোরে মাথা ঝাঁকাতেন যে মনে হতো, মাথাটা খুলেই পড়ে যাবে!


আম্মুর নামাজ ছিলো খুবই ধীর স্থির প্রকৃতির। ফলে অনেক সময় লাগতো। আম্মুর কাকীমাগণ সেই দীর্ঘ্য সময় ধরে আম্মুর জন্য অপেক্ষা করতেন। নামাজ শেষ হলে আবারও জমে উঠতো গল্পের আসর। আম্মু ব্যক্তিজীবনে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ইসলাম মেনে চলার ব্যাপারে প্রচন্ড সচেতন ছিলেন। তাঁর পর্দার প্রশ্নে আপোষহীনতার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো এবং মানুষের কাছে প্রবল শ্রদ্ধা ও সমীহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন।


সম্পূর্ণ দুই মেরুর ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যকার এহেন অভুতপূর্ব বন্ধনের গল্পঘেরা সেই সন্ধ্যাগুলোর ছবি এখনও আমার চোখে ভাসে। যারা আজ এদেশে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার কল্পনাপ্রসুত সম্ভাবনা দেখতে পান, তাদের সেসব বক্তব্যের সঙ্গে আমার শৈশব কৈশোরে দেখা সেই সন্ধ্যাগুলোর ছবি কিছুতেই মেলাতে পারি না। আবহমানকাল ধরে এদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় যে শান্তি এবং সম্প্রীতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে, তা ফাটলের ষড়যন্ত্রের কলকাঠি কোনো বিশেষ গোষ্ঠী কোনো বিশেষ গোপন জায়গা থেকে নাড়ছে বলে প্রতীয়মান হয়।


২০১৬ সালের এক মধ্যরাতে কোনো রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই এক বন্ধুকে নিয়ে উপস্থিত হলাম কুড়িগ্রাম শহরে। কোথায় উঠবো জানি না। রাত তখন ১২ টা পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ আমার এক হিন্দু বন্ধুর কথা মনে পড়লো। ফোন করতেই বাসায় আসতে বললো। এতো রাতে কারো বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া সভ্য মানুষের কাজ নয়। আমরা সেই অসভ্য কাজটিই করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু বন্ধুর পরিবারের কারোর চোখে মুখে সামান্যতম বিরক্তির ছাপও লক্ষ্য করলাম না।


সেদিন রাতে সেই হিন্দু পরিবারটি আমাদের জন্য তাদের কামরাটিই ছেড়ে দিয়েছিলো। পরদিন সকালে এতো হরেক পদের খাবার আমাদের সামনে পরিবেশন করলো যে, আমরা হকচকিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। বিদায় বেলায় তারা এমন একটা ভঙ্গি করতে লাগলেন, যেন কিছুই খাওয়াতে পারেন নি। এর জন্য তাদের লজ্জার শেষ নেই। তারা লজ্জায় পারলে মাটির সঙ্গে মিশে যান।


বাড়ির ছোট্ট মেয়েটির নাম স্রোত। ওর সঙ্গে আমার মুহূর্তেই এমন ঘনিষ্টতা তৈরী হয়ে গেলো যে, ছেড়ে আসতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিলো। বিদায়ের জন্য পা বাড়াতেই দেখলাম, স্রোতের চোখে অশ্রুর স্রোত টলমল করছে। সে অশ্রুর সঙ্গে আমার নিজের আদরের ছোট বোনটির অশ্রুর সামান্যতম পার্থক্যও করতে পারলাম না। যারা এ অশ্রুতে পার্থক্য করতে চান, যারা এ রক্তে পার্থক্য করতে চান, যারা বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এ বন্ধনকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে চান, তাদের জন্য আমাদের উচ্চারণ,

“এক সাথে আছি, এক সাথে বাঁচি
আরও এক সাথে থাকবোই,
বিভেদের সব রেখা মুছে দিয়ে
সাম্যের ছবি আঁকবোই।”

পঠিত : ৬৪৩ বার

মন্তব্য: ১

২০২১-০২-২০ ২১:৩৬

User
সাবিহা

জীবনবোধের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যতিক্রম ভাবে ভাবতে পারা টা ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্য। নিয়মিত লিখবেন।

submit