Alapon

নিষ্ঠুর শাসকদের পরিণতি কেমন হয়?

পৃথিবীতে অনেক বড় বড় অভ্যুত্থান হয়েছে কোন রকম রক্তপাত ছাড়াই। এমনই একটি অভ্যুত্থান ঘটেছিল ইরাকে, ১৯৬৮ সালে। দুই দফায় এই অভ্যুত্থান হয়। জনগণ তো দূরের কথা কাকপক্ষীও টের পায়নি। ভোরবেলা ঘুমন্ত প্রেসিডেন্ট টেলিফোন বেজে ওঠলে রিসিভার হাতে নিয়ে শুনলেন- 'অাপনি অার ক্ষমতায় নাই, প্রাসাদ ছাড়ুন। অামরা সব ঘেরাও করে রেখেছি। '

জনগণ ঘুম ভেঙ্গে দেখে তাদের ওপর নতুন নেতা নাযিল হয়েছে। একনায়কতান্ত্রিক রেজিমের পতন হয়েছে। বিদ্রোহী অফিসারদের কেন কোন গুলি ছুড়তে হয় নি সেদিন? কেন কাউকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়নি? কারণ যে কয়টা খুঁটির ওপর রেজিম টিকেছিল সব কয়টাই বিশ্বাসঘাতকতা করে বাথিস্টদের সাথে যোগ দিয়েছিল।

হাশেমি শাসন থেকে শুরু করে সাদ্দাম পর্যন্ত ইরাকে অসংখ্য অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। হাশেমিরা অন্তত সাতটি ক্যু মোকাবেলা করেছে। শেষ দফায় তাদের কেউ বাঁচেনি। ইরাকের হাশেমিরা গোড়াসুদ্ধ উৎখাত হয় রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন বিগ্রেডিয়ার কাসিম। অনেকে বলে থাকেন অভ্যুত্থানের অাসল নায়ক অাসলে তিনি নন। তার সেকেন্ড হ্যান্ড অাবদ অাল সালাম অারিফ ছিলেন অাসল কান্ডারি। কাসিমকে অন্তত ২১ দফায় মারার চেষ্টা হয় যার কয়েকটি অভিযানের নেতৃত্ব দেন সাদ্দাম হােসেন নিজেই।

মিশর অার সিরিয়াকে নিয়ে নাসের গড়তে চেয়েছিলেন ইউনাইটেড অাবর রিপাবলিক। তাদের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিপরীতে ইরাক অার জর্ডানের হাশেমিরাও একটা ঐক্য গড়ে তুলছিল। তাদের মিত্র হলো যুক্তরাষ্ট্র অার ব্রিটেন। ১৯৫৮ সালে নূরি পাশা অাল সৈয়দ কমান্ডার অাবদ অাল সালাম অারিফকে নির্দেশ দিলেন ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সৈন্য নিয়ে জর্ডানের দিকে মুভ করতে। সালাম মুভ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার বাহিনী জর্ডানের দিকে না গিয়ে, চলে অাসে রাজধানী বাগদাদে। পৃথিবীর অন্যতম একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থান পরিচালনা করে কাসিম ও অারিফরা। ইরাকি হাশেমির গোষ্ঠীসুদ্ধা মেরে সাফ করে ফেলা হয়। মহিলার পোশাকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন প্রধানমন্ত্রী নূরি অাল সৈয়দ। তাকেও বাঁচিয়ে রাখা হয়নি।

কিন্তু ইরাক নাসেরের জোটের দিকে যাবে কি যাবে না, এনিয়ে বিবাদ দেখা দেয় ইরাকি জাতীয়তাবাদী কাসিম অার অারব-জাতীয়তাবাদী সালামের মধ্যে। ফলে হাশেমিদের বিরুদ্ধে প্রথম সফল অভ্যুত্থানের পর অারেকটি অভ্যুত্থান হয় ১৯৬৩ সালে। কাসিমকে কবরে পাঠিয়ে ক্ষমতায় অাসেন সালাম। সাথে ছিল বাথিস্টরা। সালাম প্রেসিডেন্ট হন অার প্রধানমন্ত্রী করা হয় বাথিস্ট নেতা অাহমেদ হাসান অাল বকরকে। কিন্তু শিগগিরই বিরোধে জড়ায় বিপ্লবের পক্ষগুলো। বাথিস্টদের পুরোপুরি ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নেন সালাম।

১৯৬৬ সালে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় সালাম মারা গেলে প্রেসিডেন্ট পদে অাসীন হয় তার ভাই অাবদ অাল রহমান অারিফ। ততদিনে ইরাক বেশ উত্তপ্ত। বাথিস্টদের উৎপাত, কমিউনিস্টদের উৎপাত - সবকিছু সামলে ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় অনভিজ্ঞ রহমান অারিফের। দুই ভাই মিলে যে রেজিম গড়ে তুলেছে তার ভিত্তি ছিল চার কর্নেল। তারা হলেন সামরিক গোয়েন্দা প্রধান অাবদ অাল রাজ্জাক নায়িফ, রিপাবলিকান গার্ডের কমান্ডার অাবদ অাল রহমান দাউদ ও সাইদুন গেইদান এবং বাগদাদ সেনানিবাসের প্রধান হামাদ শিহাব।

ভাই এর তুলনায় রহমান বিরোধীদের প্রতি নমনীয় হলে বাথিস্টরা পুনরায় সক্রিয় হয়। এরা অনেক দিন ধরে রেজিম উপড়ে ফেলার ছক কষতে ছিল। ১৯৬৮ এর জুলাই এর এক ভোরে রহমান জেগে দেখেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাথিস্টরা ক্যু করেছে, তিনি অার প্রেসিডেন্ট পদে নেই। এই অভ্যুত্থানে কোনও গুলি ছুড়তে হয়নি। কী কারণ? অারিফ রেজিম এর চার শক্ত খুঁটি ( অার্মি অফিসার) বিশ্বাসঘাতকতা করে যোগ দিয়েছিল বাথিস্টদের সাথে। ফলে ৬৮ এর বিপ্লব পুরােপুরি বাথিষ্টদের ছিল না, যে কারণে অতীত রেজিমের দুই অফিসার নায়িফ ও দাউদও ক্ষমতার অংশীদার হয়। এটা এক ধরনের কোয়ালিশন যেখানে নায়িফ হন প্রধানমন্ত্রী যিনি বাথিস্ট নন। অার প্রেসিডেন্ট হন বাথিস্ট নেতা অাল বকর। বাথিস্টরা দেখলো বিপ্লবী দুই নন-বাথিস্টকে না সরালে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা যাচ্ছে না।

বিপ্লবের দুই সপ্তাহ পেরোয় নি। কূটচালে জর্ডান পাঠিয়ে দেয়া হয় দাউদকে। সেখানে ইরাকি অার্মি মিশনের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। অবসরের পরও দেশে ফিরতে পারেন নি দাউদ। জোরপূর্বক মরক্কাে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নায়িফকে। তার দিকে রিভলভার তাক করেছিলেন স্বয়ং সাদ্দাম হােসেন। নায়িফ হন মরক্কােতে ইরাকের রাষ্ট্রদূত। অাসলে এটা ছিল তার নির্বাসন। ১০ বছর বাদে সাদ্দামের ক্ষমতায় অারোহনের অাগের বছর লন্ডনে খুন হন নায়িফ।

১৯৬৮ এর মতই প্রায় রক্তপাতহীন দুটি অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৯৫২ ও ৫৪ তে মিশরে। এমনকি লিবিয়াতে গাদ্দাফির অভ্যুত্থানও প্রায় রক্তপাতহীন ছিল। তবে ইরাকের বাথ অার লিবিয়ার গাদ্দাফি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় এলেও তারা নিজেদের শাসনামলকে বেশ রক্তাক্ত করেছে। দুই রেজিমই বিরোধীদের শায়েস্তা করতে বেছে নিয়েছিল গুম, খুন অার প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার মত নির্মম পথকে। তাদেরও বিদায় নিতে হয়েছে অত্যন্ত নির্মমভাবে।

ইরাকের ৬৮ এর বিপ্লবের সাথে তুলনা করা যায় অাফগানিস্তানের সরদার দাউদ খান বিরোধী অভ্যুত্থানকে। দুটোতেই কাছের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতা অভ্যুত্থানের পথকে সহজ করে দিয়েছিল। তবে প্রথমটি রক্তপাতহীন হলেও দাউদ খান বিরোধী অভ্যুত্থান ছিল ভয়ংকর। যেসব সহযোগীকে নিয়ে নিজের কাজিন বাদশাহ জহির শাহ এর বিরুদ্ধে সফল অভ্যুত্থান করেছিলেন দাউদ, সেই সহযোগীরাই অাবার তার প্রাসাদ চুরমার করে দেয়। সপরিবারে নিহত হন এই একনায়ক।

পঠিত : ৪২০ বার

মন্তব্য: ০