Alapon

একজন মানুষ! একটি ইতিহাস।

১৯৩৫ সাল। ব্রিটিশ শাসিত নিখিল ভারতে মুসলিমদের ভাগ্যে সরকারী চাকরী জুটতো না বললেই চলে। তারপরও নিজের যোগ্যতা দিয়ে সরকারী চাকরী পেয়ে গেলেন, জয়পুরহাটের এক মুসলিম যুবক। চাকরীতে জয়েন করতে তিনি চলে গেলেন কলকাতায়।


ভালোই চলছিল। একদিন অফিসের বড় বাবু এসে দেখলেন, সেই মুসলিম যুবক তার ডেস্কে নেই। তখন যোহর ওয়াক্ত চলছিল। বড়বাবু খোঁজ নিয়ে দেখলেন, সেই মুসলিম যুবক যোহরের সালাত আদায় করতে গেছেন। তিনি ফিরে আসলে বড় বাবু বলেন, ‘আমার অফিসে চাকরী করতে চাইলে এইসব নামায-কালাম পড়া চলবেনে, এই আমি বলে দিলুম’!


অফিসের বড়বাবু ভাবলেন, মুসলিমরা তো এমনিতেই চাকরী পায় না। সাতজম্মের ভাইগ্যে করে সে এই চাকরীটা জুটিয়েছে। চাকরী যাওয়ার ভয়ে এইবার নিশ্চয়ই নামাযটাও ছেড়ে দিবেন। পরেরদিন অফিসে এসেই বড়বাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন। সেই মুসলিম যুবক বড়বাবুর হাতে রিজাইন লেটার ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যেখানে আমি নামায পড়তে পারব না সেখানে আমি চাকরীও করব না।’


এই সাহসী মুসলিম যুবকের নাম জয়পুরহাট জেলার অন্যতম পরিচয়বাহক ব্যক্তিত্ব মরহুম আব্বাস আলী খান। এই মানুষটার প্রতি ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম ভালোবাসা কাজ করত। সেই ভালোবাসা থেকেই তাঁর কবর জিয়ারত করবার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কবর জিয়ারত করবার উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করা হারাম। কিন্তু জয়পুরহাটে যাওয়ার মত বিশেষ কোন কারণও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একদিন আল্লাহপাক সেই সুযোগ করে দিলেন। এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে আল্লাহপাক মরহুম আব্বাস আলী খান সাহেবের কবর জিয়ারত করবার সুযোগ করে দিলেন।


আমি যখন তাঁর বাড়িসংলগ্ন কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তখন তাঁর লেখা ‘স্মৃতি সাগরের ঢেউ’ বই থেকে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবার পর খান সাহেব পূর্বপাকিস্তানে ফিরে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে তাঁকে সার্কেল অফিসার করা হলেও তিনি সেই চাকরী ছেড়ে দেন। জয়পুরহাটে ফিরে তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি এমন একটি স্কুলের দায়িত্বপান যে স্কুল থেকে গত পাঁচ বছরে একজনও মেট্টিক পাশ করতে পারেন নি।


সেই সময় মুসলিম শিক্ষার্থীদের সবচে ভীতিকর সাবজেক্ট ছিল ইংরেজি। মূলত এই সাবজেক্টেই সবাই ফেইল করত। আব্বাস আলী খান সাহেব প্রধান শিক্ষক হবার পরও ক্লাস টেনের ইংরেজি ক্লাস নিতেন। তিনি এতো দারুন ক্লাস নিতেন যে ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে ক্লাস করতেন। আব্বাস আলী খান সাহেব প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব নেবার পরের বছরই সেই স্কুল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র সববিষয়ে পাশ মার্ক নিয়ে মেট্টিক পাশ করে।


এভাবে চলতে থাকে অনেকদিন। ১৯৫৬ সালে সাংগঠনিক কারণে আব্বাস আলী খান প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিলেন। তিনি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কাছে, ইস্তফা পত্র দিয়ে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। একটু পরেই খান সাহেবের সহধর্মীনী এসে তাঁকে হন্তোদন্তো হয়ে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তারপর বলেন, ‘আপনি স্কুলে কি করে এসেছেন? দয়া করে বাহিরে যাবেন না। ছাত্ররা এমন ক্ষেপে আছে যে সামনে পেলে খুব খারাপি কিছু করে ফেলবে।’


খান সাহেব বাড়ির বাহিরে গিয়ে দেখেন, তাঁর স্কুলের সমস্ত শিক্ষার্থীরা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। খান সাহেব বললেন, ‘তোমরা কি চাও? এভাবে আমার বাড়ি ঘিলে ফেলেছো কেন?’
শিক্ষার্থীরা সমস্বরে বলে, ‘আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি আমাদের ইস্কুল ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারবেন না।’
এরূপ অবস্থায় খান সাহেব তাদের যতোই বুঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তারা ততোই গোঁ ধরে বসে রইল। শেষমেষ ইস্কুলের শিক্ষকরা আসল শিক্ষার্থীদের বোঝানোর জন্য। আব্বাস আলী খান তাদের কাছে ওয়াদা করলেন, ‘আমি তোমাদের প্রধান শিক্ষক হয়তো হতে পারব না। কিন্তু আমি বাড়ি ফিরলে মাঝে মাঝেই তোমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতে যাবে।’


সুবহান আল্লাহ! কি অসাধারণ মানুষ। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান মানুষটিকে আমি কখনো নিজ চোখে দেখিনি। কিন্তু তারপরও এই মানুষটি না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি। কত্তোটা বিনয়ী মানুষ হলে, পুরো একটি স্কুলের শিক্ষার্থীর মন জয় করা সম্ভব। আর এইসকল মানুষগুলোর জন্য অন্তর থেকে এমনিতেই দোয়া চলে আসে। আল্লাহপাক এই অসাধারণ বিনয়ী মানুষটাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমীন।

পঠিত : ১১৪৮ বার

মন্তব্য: ০