Alapon

স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও মূর্তি-প্রতিমার সাত কাহন...



আমার ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের 'চারুকলায়' পড়ব। আমার এই আগ্রহ যে, বিষময় হয়ে উঠবে ভাবতে পারিনি। এই বিষয়টাকে নিয়ে বেশীর ভাগ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। যা আমি হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি করেছিলাম। আমার বাবাকে ভাই সাহেব (দুলাভাই) বলে সন্ধোধন করতেন এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তার মাথায় ঢুকিয়েছিল যে, চারুকলায় তো গৌতম বুদ্ধের কল্লাই বানানো হয়! এটার সাথে শিক্ষার কি সম্পর্ক! বাবা ১৮০ ডিগ্রীতে বেঁকে বসলেন। গোস্বা করে বললাম, 'তাহলে পরীক্ষাই দিব না!' মা-বাবা একসাথে উত্তর দিলেন, "বিপথে যাবার চেয়ে সেটাই ভাল"। অবশেষে আমার অভিমানের জিত হল। এটাই ছিল আমাদের সময়ের লেখাপড়ার হালচাল!

ভাস্কর্য ও মূর্তি নিয়ে বহু কথা ফেসবুকে ঘুরপাক খায়। যে যার মত বক্তব্য মন্তব্য করে যাচ্ছে। সে সব বিতর্ক উষ্কিয়ে দেবার জন্য এই পোষ্ট নয়। মূলত কোনটি কি জিনিষ ও কোন ধরনের কাজ সেটা তুলে ধরাই এই পোষ্টের লক্ষ্য।

স্থাপত্য:

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যার নাম। যাকে ইংরেজিতে Architecture বলা হয়। একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির কল্পনা, চিন্তা ও মন-মস্তিষ্কে ঘুর-পাক খাওয়া কোন বস্তুকে বাস্তবে রূপ দিতে পারার নামই স্থাপত্য বিদ্যা। এভাবে যিনি কল্পনাকে বাস্তবে রূপায়ন করেন তাকে স্থপতি বলা হয়। একজন প্রাজ্ঞ স্থপতি শুধু নিজের কল্পনাকে রূপায়িত করেন না। তিনি অন্যের কল্পনার কথা শুনে, বুদ্ধি-বিবেচনার মাধ্যমে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে, সেটাকেও বাস্তব স্থাপনায় পরিণত করতে পারেন। তখন তিনিই হতে পারেন একজন নামকরা স্থপতি। যা আগে ছিলনা, সেখানে নতুন করে গড়ার কারিগর হলেন একজন স্থপতি। দালান, ভবন, ব্রিজ, রাস্তা, শপিং মল সহ দুনিয়ার নির্মাণ কাজ তাদের হাতেই হয়ে থাকে। অন্যের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে বলেই দুনিয়াতে স্থপতিদের নাম, যশ, খ্যাতি ও কদর বেশী।

ভাস্কর্য:

ভাস্কর্যের ভাবনাটি স্থাপত্যশৈলীর অনেকটা উল্টো। এখানেও কল্পনার স্থান আছে বটে, তবে বেশীরভাগ সময় সৃষ্ট কোন কিছুর প্রতিকৃতিকে সামনে রেখেই ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। ভাস্কর্য কে ইংরেজিতে বলা হয় Sculpture. দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার সমন্বয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট আকৃতির মধ্যেই ভাস্কর্যের কার্যবিধি নিয়ন্ত্রিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভাস্কর্য বিদ্যা’ বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করা যায়। ইংরেজিতে এই বিষয়টিকে The art of carving বা খোদাই বিদ্যা বলা হয়। স্থপতিদের মত ভাস্কর্যেও অভিনবত্ব আছে। বর্তমানের ধনীরা নিজেদের হলরুমে নানাবিধ ভাস্কর্য রেখে ঘরের ডিজাইন পরিবর্তন করে। ভাস্করের চিন্তার উপর নির্ভর করেই ভাস্কর্যের ধরণ হয়। কাদামাটি, কাঠ, ধাতব বস্তুকে খোদাই করে যিনি একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতি দিতে পারেন তাকে বলা হয় ‘ভাস্কর’। আমাদের দেশে অনেকেই নিজের নামে আগে টাইটেল হিসেবে 'ভাস্কর' লিখে থাকে। দোয়েল, বেগুন, ঘড়ি সহ বহু ধরনের ভাস্কর্য আমাদের দেশে আছে। সে হিসেবে আমাদের জাতীয় স্মৃতি সৌধ, শহীদ মিনার সহ বহু নিদর্শনও ভাস্কর্যের অন্তর্ভুক্ত। কোন স্থাপনাকে দর্শনীয় করে নিদ্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ করারই ভাষ্কর্যের অন্যতম লক্ষ্য।

মূর্তি:

মূর্তির অর্থ হল ছায়া, আকার, ছবি। ইংরেজিতে Shape, Figure, Image হিসেবে ধরা হয়। কারো ছবিকে হুবহু আকার-আকৃতির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার নামই মূর্তি। সৃষ্টির বাস্তব ছবির সাথে মাটির বানানো দেহের যদি অবিকল মিল পাওয়া যায়, তখনই তাকে মূর্তি বলা হয়। কারো ভাস্কর্য দেখার সাথে সাথেই কেউ যদি বলে বসে যে, এটা তো ঐ ব্যক্তিরই দেহাকৃতি। তাহলে সেটার অবস্থান ভাস্কর্যে থাকলেও তার প্রকৃত পরিচয় হবে মূর্তি হিসেবে। ধর্মীয় আবেগে কোন প্রতিকৃতির পরিচিতি ঘোষনার মাধ্যমে, অদেখা জিনিষও কখনও মূর্তি হতে পারে। প্রাণী আকৃতির অবয়বের দুটো পরিচিতি থাকে। প্রথমত, যদি কারো অবিকল প্রতিকৃতি হয় তাহলে সেটা মূর্তি। দ্বিতীয়ত, সেটাকে যখন প্রদর্শনের জন্য বসানো হবে তখন সেটা ভাস্কর্য। সুতরাং এধরনের স্থাপনা মূর্তি ও ভাস্কর্য উভয় মানদণ্ডে পরিচয় পায়।

প্রতিমা:

আমাদের দেখে হিন্দুরা প্রতিমা পূজা করে। যাকে লক্ষ্য করে এই মূর্তি বানানো তাকে কেউ মর্ত্যের মানুষ দেখেনি। বিবরণ শুনে, মানুষ ধারণা করে একটি আকৃতিতে বানিয়েছে। তাই পূজা মণ্ডপের সকল মূর্তির ছবি ও চেহারা এক ও অভিন্ন হয়না। ভিন্ন জনের হাতে বানানো দেবতার মূর্তির ছবিও হুবহু মিলে না। চেহারার মিল নাই কিন্তু চিন্তার মিল থাকার কারণে, তারা এ ধরণের মূর্তিকে প্রতিমা বলে থাকে। প্রাচীন কালে কাঠের টুকরো দিয়েও প্রতিমা বানাত। এগুলোতে প্রাণীর আকৃতি আসত না কিন্তু মানুষ দেবতার উপাসনা করছে বলে বিশ্বাস করেই এসবের পূজা করত। তাই এগুলোকে প্রতিমা বলা হয়।

প্রতিকৃতি:

ডিজিটাল জমানা আসার পরে প্রতিকৃতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রতিকৃতি হল দেহায়বের অঙ্কিত ছবি। কারো মৃত্যু দিবসে তার ছবিতে ফুলের মালা দেওয়া হয়। এটা হল প্রতিকৃতির ব্যবহার। তাছাড়া কিছু ধর্মীয় উপাসনালয়েও দেখা যায়, তাদের উপাস্যের প্রতিকৃতিকে কেন্দ্র করেই উপাসনা করা হয়। বর্তমান কালে প্রতিকৃতিকে অপমান করে নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর মনে ঝাল নিবারণ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম একটি আইটেম হল কুশপুত্তলিকা দাহ কিংবা উন্মুক্ত স্থানে ছবি রেখে তার সাথে অপমান জনক আচরণ করা।

- Tipu

পঠিত : ৫৫৬ বার

মন্তব্য: ০