Alapon

ব্রিটিশদের মুসলিম নির্যাতনঃ ইতিহাসের আড়ালে থেকে যাওয়া নৃশংস বাস্তবতা



১৮৫৭ সাল। বিপ্লবে উত্তাল পুরো হিন্দুস্তান। শোষক বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে সমগ্র হিন্দুস্তানের মুসলিমরা। বালাকোটে সাইয়্যেদ আহমেদ রাহ. এর শাহাদাতের পর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। বাংলার সাধারণ মুসলিমরা জিহাদের জযবাকে সাথে নিয়ে নিজেদের সর্বাত্মক দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একদিকে ব্রিটিশদের দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রাম অন্যদিকে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ফলে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যকার শক্তি খুইয়ে যাচ্ছিল। এরপর হাজী শরিয়তুল্লাহের আন্দোলন এবং সমসাময়িক সময়ে তিতুমীরের বাশেরকেল্লা হয়ে উঠেছিল বাংলার মুসলিমদের বিপ্লবের প্রতীক। যেই বিপ্লবের সর্বশেষ বিস্ফোরণ ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ।

ব্যর্থ বিপ্লবের পর মুসলিমদের উপর নেমে আসে স্মরণকালের ভয়াবহ নির্যাতন ও নীপিড়ন যার বর্ণনা সাধারণের হৃদয়কে কাপিয়ে দেয়। সভ্যতার ধব্জাধারী আজকের বৃটেন তথা বৃটিশ বাহিনীর অত্যাচার হাজার বছরের বাংলার মুসলিম ঐতিহ্যকে নিঃশেষ করে দেয়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের ক্ষোভের মূল কারণ ছিল- মুসলিমদের স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং জিহাদী জযবা। ১৯০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সকল বড় বড় আন্দোলনের মূলে ছিলেন মুসলিমরা তথা মুসলিম আলেমরা।

তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহের মূল কারণ সুরাহা করতে না পেরে কোম্পানিকে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে বলে।
ড. উইলিয়াম লিওর তার রিপোর্টে বলেছিলেন- "১৮৫৭ সালের গণবিদ্রোহ হচ্ছে মুসলিমদের আন্দোলন, এর নেতৃত্ব দিচ্ছে আলেম সমাজ। তাই বিদ্রোহ নির্মূল করতে হলে মুসলমানদের জিহাদী চেতনাকে দমন করতে হবে। আর সে চেতনার মূলমন্ত্র হচ্ছে আল-কুর'আন এবং তার বাহক আলেম উলামাদেরকে নির্মূল করে দিতে হবে।*
রিপোর্টকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে ইংরেজ সরকার নিজেদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণমানুষের উপর বইয়ে দেয় রক্তের বন্যা।

আমাদের হারানো সম্পদঃ(আলেম-উলামা)
১৮৫৭ সালের পর শুরু হয় এ নিধন উৎসব। ইতিহাসের লোমহর্ষক গণহত্যা পরিচালিত হয় উপমহাদেশের মুসলিম আলেম উলামাদের উপর। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫০ হাজারের অধিক আলেম উলামাদেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে ইংরেজ সরকার। হাজার হাজার আলেমকে নির্বাসনে পাঠায় আন্দামান, সাইপ্রাস ও মাল্টাতে। বন্দী আলেমদের উপর চলে নৃশংস নির্যাতন।*
তৎকালীন সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের(১৮৫৭) ১৪ বছর পূর্বে, ভারতে নিযুক্ত গভর্নর জেনারেল বলেছিলেন- "মূলত, মুসলমানরাই যে আমাদের একমাত্র শত্রু এ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না"। শুধুমাত্র ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ লক্ষ মুসলিম শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে আলেমদের সংখ্যা ছিল ৫১ হাজারের অধিক।*

আজকের সভ্যতার দাবীদার ইংরেজদের সভ্যতার কিছু নমুনাঃ
১) ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর, স্বয়ং ইংরেজ লেখক এডওয়ার্ড থমাসের মতে- শুধুমাত্র দিল্লীতেই ৫০০ আলিমকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল।*
২) ১৮৫৭ সালের ১৮ ই নভেম্বর দিল্লীর জামে মসজিদের আঙ্গিনায় একই দিনে প্রায় ২৭ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে আজকের সভ্যতার দাবীদার নিকৃষ্ট ব্রিটিশরা।*
৩) নিকৃষ্ট ইংরেজরা মুসলিমদের যখন হত্যা করত, তখন শুকরের চামড়ার মধ্যে পুরে সেলাই করে দিত এবং হত্যার পূর্বে শুকরের চর্বি গায়ে মাখিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিত।*
৪) লেফটেন্যান্ট মান্ডাজীর লিখেছিলেন- একজন মুসলিম সিপাহীর মুখমন্ডল সংগীনের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়, অতঃপর তাকে অল্প আগুনে ভুনা করা হয়। জ্বলন্ত মানুষের দুর্গন্ধে আমার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।*
৫) খাজা হাসান নিজামী সে সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে লিখেছেন- হাজার হাজার মুসলিম নারী ইংরেজদের পৈশাচিক নির্যাতনের ভয়ে নিজেদেরকে কূপে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করেছিল। অনেক পুরুষ পরিবারের সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে।*
৬) দিল্লীর অলিগলি হত্যাকান্ডের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ঘরবাড়ি পরিণত হয়েছিল জেলখানায়। প্রতিদিন হুগলী নদীর স্রোতে হাজার হাজার মুসলমানের লাশ ভেসে যেত আর নরপিশাচ ইংরেজরা মনোরম উদ্যানে বসে মুসলিমদের লাশ দেখে উপভোগ করতো।*
৭) অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও আগ্রাসনের ইতিহাস আরও দীর্ঘ বেদনার সৃষ্টি করে। ১৭৭২ সালের মধ্যে শুধুমাত্র নবাবদের নিকট হতে মোট লুটের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৩ মিলিয়ন পাউন্ড!!!*
৮) অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ফলে মুসলিমদের অবস্থা এতটাই অসহায় হয়েছিল যে, সে সম্পর্কে স্যার সৈয়দ আহমদ বলেন- "দৈনিক দেড় আনা অথবা আধা সের শস্যের বিনিময়ে একজন ভারতীয় স্বেচ্ছায় নিজের গর্দান কর্তন করাতেও প্রস্তুত ছিল"।*
৯) W.S. Blint বলেছিলেন- "আমরা যদি লুটপাটের এ ধারা অব্যাহত রাখি তা হলে এমন এক সময় আসবে যখন ভারতীয়রা বাধ্য হয়ে একে অপরকে ভক্ষণ করবে"।*

ব্রিটিশদের নির্যাতনের এসকল ইতিহাস খুব সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আলোচনায় আসলেও তা আমাদের মানসপটে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো মনে করিয়ে দেয়া হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, যুবসমাজ সেই ইতিহাস ভুলতে বসেছে। আজকের যুবকদের নিকট বাংলার ইতিহাস ৭১ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
অথচ হে যুবক, তোমার ইতিহাস শুধু ৭১ নয়, তোমার ইতিহাস বালাকোটের ইতিহাস, তোমার ইতিহাস সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস, তোমার ইতিহাস বাশেরকেল্লার ইতিহাস।
আমাদের সভ্যতা ও ইতিহাসের মূল অনেক গভীরে গ্রোথিত। আমরা ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর উত্তরসূরী, আমরা তিতুমীরের উত্তরসূরী, সাইয়্যেদ আহমেদের উত্তরসূরী, হাজী শরিয়তুল্লাহর উত্তরসূরী। আমরা ফাসির কাষ্ঠে ঝুলন্ত সেসকল শহীদদের উত্তরসূরী যারা মানুষের স্বাধীনতার জন্য মানুষের মুক্তির জন্য, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, মুক্ত এক বাংলা আসমান উপহার দেয়ার জন্য নিজেদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করে গিয়েছেন রণাঙ্গনে।
সেই ইতিহাস ও চেতনাকে ভুলে গিয়ে যারা আজও পাশ্চাত্যের চাকচিক্যময় দালানকোঠায় আবিষ্ট হয়ে যায় তাদের তরে...
কবি মন বলে-
"সেই সভ্যতার পূজারী তুমি, যা করেছে তোমাকে বধির অন্ধ,
পাথরে পাথরে আজো খুজো, পাবে রক্তের সোদা গন্ধ।"

-------------------------------
*সূত্র- দেওবন্দ আন্দোলন, ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান

পঠিত : ১১১৬ বার

মন্তব্য: ০