Alapon

আমার কাছে অধিক আবেদন সৃষ্টিকারী হলো নামহীনরা...



জেনেভা, ব্রাজিল, ভারত, সেনেগাল, কিংবা বুরকিনা ফাসোতে সেই সহমির্মতার অঙ্গীকার আমাতে অনেক সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা সিঞ্চন করে। দালাইলামা, ডোম হেল্ডার ক্যামেরা, আবে পিয়ারে, পিয়ারে, পিয়ারে ডুফরেন্স, কিংবা সাঙ্কারার মতো ব্যক্তিত্ব আমাকে চরম মুগ্ধ করেছে এবং তাদের কাছে আমি অনেক ঋণী। কিন্তু আমার কাছে তাদের চেয়ে অধিক আবেদন সৃষ্টিকারী হলো নামহীনরা : নীরব বীর, যারা প্রতিরোধ করে চলছে অন্ধকারে। মিডিয়া ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ থেকে দূরে থাকতে তারা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।

অনেক আগে, আমি একবার একজন কলম্বিয়ান সমাজ কর্মীকে আমাদের স্কুলে সংহতি সভার ডিনারে আমন্ত্রণ করেছিলাম। অনুমিত ছিল তিনি তার দেশের অবিচার, দারিদ্র ও সংকট নিয়ে কথা বলবেন। আমি পেছনে বসে তার আলোচনা শুনছিলাম। তার বক্তব্যের প্রথম অর্ধেক তিনি কলম্বিয়ান ঐতিহ্যবাহী নাচ, মিউজিক ও ললিতকলা নিয়ে কথা বলেন। আমি তাকিয়েছিলাম এবং আনমনে ভিড়ভিড় করে বলি আমার প্রত্যাশা তিনি বুঝতে পারেনি। হঠাৎ তিনি থেমে যান এবং তিনি স্টুডেন্টদের নিকট ব্যাখ্যা করেন : আমি তোমাদের কলম্বিয়ান মিউজিক ও নাচ সম্পর্কে বলতে চেয়েছি যাতে তোমরা জানতে পারে যে সমস্যার পাশাপাশি আমাদের কলম্বিয়ানদের রয়েছে একটি আত্ম-পরিচয়, একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন এবং একটি সংস্কৃতি। তার এরূপ ঝলমলে প্রত্যাবর্তনে আমরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়ি এবং প্রাণবন্ত হয়ে উঠি। ত্রিশ মিনিটে তিনি আমাকে শিখিয়েছেন এক অপ্রত্যাশিত পাঠ। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন- সমস্যা, দারিদ্র কিংবা সংকটের কারণে বাকি সবকছিুকে আমার কল্পলোক থেকে কখনো বাতিল করে দিই না।

আমি ভুল ভেবে ছিলাম। এরপর আমি জেনেভার স্কুলসমূহে সত্যিকার ‘সংহতির শিক্ষাদান’-এর নিমিত্তে একটি আন্দোলন শুরু করি। আমাদের শুরু করা উচিত আত্মসত্তা, হাসি, সম্ভ্রম, সংস্কৃতি ও সমাজকর্মীর সেই পদ্ধতিতে যাকে আমি বাতিল করে দেওয়ার পূর্বে আমাকে উদ্দীপ্ত করেছিল। সেই ত্রিশ মিনিট অন্যের প্রতি ও জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিয়েছিল। সেই টুইস্ট আমাকে জীবন ও ক্ষত, আশা ও ভঙ্গুরতা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমাকে শিখিয়েছে জ্ঞানের ক্ষমতা, আবেগের শক্তি, ধৈর্য্যরে অপরিহার্যতা এবং শোনার প্রয়োজনীয়তা। আমি সবসময় কোনো কিছু বিস্মৃত না হতে চেষ্টা করি।

বছর কয়েক পর, আমি ডিন পোস্ট ও হেল্পিং হেন্ড কো-অপারেটিভ-এর সভাপতির পদ থেকে থেকে ইস্তফা দিই। আমার পরিবর্তন হওয়া এবং বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার উৎসে ফিরে আসা প্রয়োজন ছিল। অধিকন্তু, আমার চারপাশে ইসলামি ইস্যুর গুরুত্ব বিগত ১০ বছর ধরে ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর থেকে রুশদি বিতর্ক কিংবা ১৯৮৯ সালে ফ্রান্সে ইসলামি হেড স্কার্ফ বিতক তুমুল আকার ধারণ করে। ইসলাম ও মুসলিমরা জনপ্রিয় আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। সে সময় আমি ইসলামি ইস্যুতে সম্পৃক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি ইতোমধ্যে এটাকে ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করি।

মুসলিম ও পাশ্চাত্য উভয় জাহানের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা, ইসলামের ব্যাখ্যা এবং তাকে অধিকতর বোধগম্য করে তোলা, সেখানে বসবাস করা ও ফ্রেন্স সাহিত্য এবং পাশ্চাত্য দর্শন অধ্যয়নের কারণে পাশ্চাত্য ছিল আমার নিকট সুপরিচিত। আমার মাস্টার্সের থিসিসের শিরোনাম ছিল 'The notion of suffering in Nietzsche's Philosophy'. আমার পিএইচডি থিসিসের শিরোনাম ছিল- “দর্শনের একজন ইতিহাসবিদ হিসাবে নিটশে”। এটা আমাকে সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল থেকে সোপেনআওয়ার পর্যন্ত বিখ্যাতসব পশ্চিমা দার্শনিকদের গভীর ও আন্তরিক পাঠে সম্পৃক্ত করে। নিটশের ব্যাখ্যায় দেকার্ত, স্পিনোজা, কান্ট, হেগেল ও মাক্স-এর অভিমতের সারাংশকে মাঝে মাঝে আমি ব্যবহার করেছি । তখন আমার সময় কাটতো পড়াশোনা (এবং কিছুটা খেলাধুলা করে) এবং ৫-৮ ঘন্টা টেকস্ট নিয়ে চিন্তা করে। আমি ইসলামি বিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আমি নিজের জন্য একটি বিশেষায়িত অধ্যয়ন প্রোগ্রাম প্রণয়ন করি, অতঃপর আমি সপরিবারে মিসর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এর মাধ্যমে আমরা সকলে উপকৃত হই। আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা আরবি ভাষা শিখা, দেশটির সাথে পরিচিত হওয়া এবং ইসলামকে অধ্যয়ন করার অধিকতর সুযোগ লাভ করে। যেমন- আমি নিজের জন্য ৫ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমকে ২০ মাসে সম্পন্ন করার একটি চমৎকার আবেদনময় প্রোগ্রাম নির্ধারণ করি। ঐতিহ্যবাহী প্রশিক্ষণ পদ্ধতি (একজন স্কলার কর্তৃক একজন ছাত্রকে পাঠদান) আমাকে অধ্যয়নের এক নিবিড় অনির্বচনীয় ছন্দে আবদ্ধ করে; প্রতিদান সকলে পাঁচটা থেকে শুরু করে রাত এগারোটা কিংবা মধ্যরাতে পড়াশুনা শেষ করতাম। সেই প্রশিক্ষণকালীন সময় আমি কখনো ভুলব না। এটা ছিল নিবিড় ও কঠিন, কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও ঝলমলে। মহান মনিবের অশেষ শুকরিয়া, আমি আমার লক্ষ্য অর্জন করেছি।

মূল : ড. তারিক রামাদান
অনুবাদ : মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ

পঠিত : ৩৪৫ বার

মন্তব্য: ০