Alapon

ইমাম রাগিব ইস্পাহানি (রহ.) এর রাজনৈতিক চিন্তাধারা...


আল্লামা রাগিব ইস্পাহানি (মৃত্যু-৫০২ হিজরি)।

তার পুরো নাম- আবুল কাসিম হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ রাগিব আল ইস্পাহানি। ইস্পাহান তার জন্মভূমি হওয়ায় তিনি রাগিব ইস্পাহানী নামে পরিচিত। একজন বিখ্যাত ফিকাহবিদ, ভাষ্যকার, সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ ছিলেন।তিনি প্রধানত আরবি ও ফারসি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার জীবন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যায় না।

তিনি আব্বাসীয় শাসনামলে জীবনের বেশিরভাগ মূল্যবান সময় বাগদাদ ও ইস্পাহানে কাটিয়েছেন। আল্লামা জামখশারি (রহ.) তার গ্রন্থ থেকে অনেক উপকৃত হয়েছেন। ইমাম রাগিব ছিলেন জ্ঞান সাধনায় মগ্ন এক মনিষী।যিনি বিস্তৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় রেখেছেন তাঁর স্বাক্ষর। সাহিত্যে ও দর্শনের পাশাপাশি জ্ঞানের সকল শাখায় ছিলেন দক্ষ। তিনি কুরআনের একটি দুর্দান্ত তাফসিরও লিখেছেন।

আল্লামা যাহাবি (রহ.) তাকে “তবাকাতুল মুফাসসিরিন”এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন।ইমাম সুয়ূতি (রহ.) তাকে অভিধান ও ব্যাকরণবিদ ইমামদের মধ্যে গণ্য করেছেন।
ইমাম রাগিব ইস্পাহানির অনেক রচনাবলি রয়েছে, যাতে ছড়িয়ে রয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের অসংখ্য মণি মুক্তো।

আরবি ও ফারসি সাহিত্যে সেগুলো বিশেষ মর্যাদার স্থান দখল করে আছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইমাম রাগিব ইস্পাহানির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি রাজনীতি সম্পর্কে চমৎকার বিবরণ উপস্থাপন করেছেন। যা আজকের দিনে মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজে লাগতে পারে। তার জ্ঞানপূর্ণ বক্তব্য অজ্ঞতার রোগাক্রান্ত মুসলিম মানসে এক অনন্য মেডিসিনের ভূমিকা পালন করতে পারে।

তিনি তৎকালীন সময়ে রাজনীতিকে চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি রাজনীতি তথা সিয়াসাতকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন, একটি হলো- সিয়াসাতে ফারদি তথা ব্যক্তিগত সিয়াসত এবং দ্বিতীয়টি হলো- সিয়াসাতে ইজতিমায়ি তথা সামষ্টিক সিয়াসত।সিয়াসাতে ইজতিমায়িকে আবার সিয়াসাতে খিলাফতও বলা হয়।

বস্তুত ব্যক্তিগঠনের পরই রাষ্ট্রগঠন করা যায়।ব্যক্তি যদি সঠিকভাবে নিজেকে পরিচালনা করতে না পারে তবে তার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনাও সম্ভব নয়। রসূল (সা.) এর কর্মপদ্ধতিও ঠিক তেমনই ছিলো। রসূল (সা.) মাক্কি জীবনে ব্যক্তিগঠনে মনোযোগী হয়েছিলেন। তার পর তিনি মদিনায় গিয়ে রাষ্ট্রগঠন করেছিলেন।

তার জীবনকে এজন্য দুটি ভাগে করা হয় একটি হলো ব্যক্তিগঠনের যুগ আর অন্যটি রাষ্ট্রগঠনের যুগ। আধুনিক যুগে যেসব মনীষী ইসলামের পুনর্জাগরণে সাংগঠনিক সিস্টেম কায়েম করেছেন তারাও ঠিক এই পদ্ধতিটাই অনুসরণ করছেন।

ইমাম হাসান আল বান্না,সাইদ নুরসি,সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদি, ড.নাজমুদ্দিন এরবাকান, সাইয়েদ কুতুব (রহ.) সবাই সাংগঠনিক সিস্টেমে ব্যক্তিগঠনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশ,পাকিস্তান,হিন্দুস্তান,মিসর,তিউনিসিয়া, ইন্দোনেশিয়া,পেলেস্টাইনসহ বিশ্বের যেখানেই ইসলামি আন্দোলনসমূহের কাজ চলছে সেখানেই রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে ব্যক্তিগঠনের কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তিগঠন ব্যতীত রাষ্ট্রগঠন সম্ভব নয়। যে ধরণের আখলাকসম্পন্ন ব্যক্তিগঠন করা হবে,সে ধরণের রাষ্ট্রব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। কারো ভেতরে ইসলামি নৈতিকতার অনুপস্থিতি দেখা গেলে তার দ্বারা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা সম্ভব নয়।

ইমাম রাগিব বলেন," যে ব্যক্তি নিজের সংশোধন ও তত্বাবধান( সিয়াসাতে নাফস) করতে পারে না সে ব্যক্তি অন্যের তত্বাবধান(সিয়াসাতে গাইর) করতে পারে না।"
এ কথাটি দেদীপ্যমান সূর্যের মতোই সত্য। রাষ্ট্রব্যবস্থায় যতো অনাচার,দুর্নীতি,অশান্তি,বেইনসাফি,যুলম পীড়ন তা সবই সম্ভব হয়েছে চরিত্রহীন ব্যক্তিদের ক্ষমতা লাভের কারণে বা ক্ষমতা দখলের কারণে।

অন্যদিকে উত্তম চরিত্র সম্পন্ন ব্যক্তিগণ যারা নিজেরা নিজেদের নফসকে খাহেশাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছে তাদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনায় কখনো দুষ্কৃতি করা সম্ভব হয় না।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের পূর্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রের সকল আইন কানুন সম্পর্কে বিজ্ঞ হতে হবে।ভূ-রাজনীতি (Geo-Politics) সম্পর্কে এবং আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কেও জানতে হয়।
ইমাম রাগিব ইস্পাহানি (রহ.) বলেছেন-"তোমরা ফিকহ ( আইন কানুন এবং গভীর প্রজ্ঞা) সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি অর্জন ব্যতীত এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হওয়া পর্যন্ত নেতৃত্ব দিতে পারবে বলে গণ্য হবে না।"

রাজনীতি ব্যতীত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা কী করে সম্ভব। অথচ আমাদের দেশের একপ্রকার আলিম সমাজ খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন কিন্তু নিজেরা রাজনীতি করতে চান না। তারা এটাকে দুনিয়াবি বিষয় মনে করেন।তারা তাদের পরিচয় দেন- আমরা অরাজনৈতিক। প্রকৃতপক্ষে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করা ফরয।
ইমাম রাগিব ইসপাহানী রহ. বলেছেন, "ইন্নামাল খিলাফাতা তাসতাহিক্কু বিস্সিয়াসাত। সিয়াসাত বা রাজনীতির মাধ্যমেই খিলাফতি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়িম করা সম্ভব।"( ইসলামী হুকুমত, হামিদুল আনসারী গাযী)

রাজনীতির মাধ্যমেই একটি দেশের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা সম্ভব। রাষ্ট্রের সংস্কার,নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হলে রাজনীতি ব্যতীত কল্পনাও করা যায় না। এজন্য আমাদেরকে একটি ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করতে হবে এবং নিজেদেরকে ইসলামি আখলাকের আলোয় সাজাতে হবে।

-জি.মোস্তফা

পঠিত : ১৬০৬ বার

মন্তব্য: ০