Alapon

বেদনা মধুর হয়ে যায়

বেদনা মধুর হয়ে যায়
--------------------

দেখতে দেখতে নাফিস অনেক বড় হয়েছে। টিনএইজের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও তার বাচ্চামো এতটুকু কমেনি। পারিবারিক ইতিহাসবেত্তাগণ বলে থাকেন, ছোটবেলায় আমি দুধ-কলা-দিয়ে-মাখা ভাতের সাথে ঝোলসমেত গোশত খেতাম। এই জুনুনি তার মধ্যেও আছর করেছে ভিন্নরূপ নিয়ে। সে তরকারির সাথে আঙ্গুর মিশিয়ে ভাত খায়। তিন-চার লোকমা পরপর একটা করে আঙ্গুর।

কোনো এক অজানা কারণে ভালোবাসার প্রকাশ ও বহিঃপ্রকাশে সবসময় সে অন্তঃপ্রাণ। আমাদের পারিবারিক ও আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে সচরাচর অনুপস্থিত - এমন অনেক বৈশিষ্ট্য তার ভেতরে বাসা বেঁধেছে। বসে বসে পড়ছি, কোত্থেকে হুট করে এসে হাতটা টেনে একটা চুমু খেয়ে যাবে। কোথাও বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, হঠাৎ এসে কিছুক্ষণ গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকবে চুপচাপ, গন্তব্য কাছাকাছি কোথাও হলে সাথে নেওয়ার আবদার করবে। কীবোর্ড চাপছি, চেহারায় হয়ত ক্লান্তির ছাপ ফুটেছে, দূর থেকে সেটা লক্ষ করে চা অথবা কফি বানিয়ে টেবিলে রেখে যাবে। কখনও মনে চাইলে জিজ্ঞাসা করবে, ‘ভাইয়া, চা না কফি?’ মনে না চাইলে সেটাও বলবে না; তার যা মনে চায়, বানিয়ে দিয়ে যাবে। তার উপস্থিতিতে নাসিমের কাছে চা-কফির আবদার করা সে খুব একটা পছন্দ করে না। বাসায় যে-কারুর বকা খেলে হয় অল্প কথায় জবাব দেয়, নইলে চুপচাপ থাকে। ব্যতিক্রম আমার বেলায়। যে কয়বার গলার স্বর উঁচু করেছি, প্রতিবারই একপ্রকার ফুঁপিয়ে কেঁদেছে।

আমার সাথে তার সম্পর্কের মাত্রা— অন্তত বাহ্যত— সামান্য হলেও বেশি, সন্দেহ নেই। এর কার্যকারণ আল্লাহ ভালো জানেন। আমি সজ্ঞানে ভাইবোনদের মাঝে ভালোবাসার আদান-প্রদানে তারতম্য করিনি।

কিছুদিন আগের কথা। রোয়াইফা এসে বললো, মেজো ভাইয়া [নাসিম] আর ছোট ভাইয়া[নাফিস]কে সে জাগাতে পারছে না, আমাকে তার সাথে যেতে হবে। রাজকন্যার হুকুম, না করার জো নেই। গেলাম। মর্নিং ওয়াকে দুইজন মিলে অনেকদূরে চলে গিয়েছিল, দৌড়ে অনেক ঘাম ঝরিয়েছে, এসেই দিয়েছে কঠিন এক ঘুম। ওদিকে তাদের রুটিনে টেবিলে বসার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, আব্বু অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন, রোয়াইফা তাদেরকে বকা খাওয়া থেকে বাঁচাতে উঠিয়ে দিতে চাচ্ছে প্রাণপণে। বেচারি পেরে উঠলো না। আমি কায়দা কানুন করে একটাকে উঠালাম। আরেকটা তখনও ঘুমে বেঁহুশ। তার ঘুম ভাঙ্গানোর উপায় একটাই, জোরে জোরে মিনিটখানেক ডাকা লাগবে, চোখ খোলার পর পুনরায় ঘুমিয়ে-যাওয়া-রোধকল্পে ততোধিক বড়ো স্বরে একটা তাগাদা দিতে হবে। দ্বিতীয়টা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। টেবিলে একটা স্ক্রু ড্রাইভার দেখলাম (আল্লাহর তিরিশটা দিন দুইজনের কাছে নানাবিধ যন্ত্রপাতি আর কলকব্জা পর্যাপ্ত পরিমাণে মওজুদ থাকে)। ড্রাইভারটা সাইজে বেশ বড়। হাতে ধরার জায়গাটা বেশ শক্ত। প্লাস্টিক নয়, মেলামাইনও মনে হলো না, একরকম ভারী পদার্থে তৈরি। ওটা নিয়ে ঠক ঠক করে টেবিলে আওয়াজ করছি আর তাকে ডাকছি। না, কাজ হবে না। মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে হবে। তার বিছানা টেবিলের সাথে লাগোয়া। স্ক্রু ড্রাইভার টেবিলের প্রান্তে রেখে আমি ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় ড্রাইভারটা গড়িয়ে সোজা গিয়ে পড়লো তার পায়ের উপর। সে জেগে উঠলো এবং উফ বলে ব্যথার কথা জানান দিলো। সাইজে বেশ বড়, ওজনও একটু বেশি ছিল; পাটকাঠির মতো ঠ্যাঙে এই জিনিস পড়লে ব্যথা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। অনিচ্ছায় ব্যথা দেওয়ার জন্যে আমি স্যরি বললাম, পায়ে কিছুক্ষণ হালকা মালিশ করলাম। পুরোটা সময় সে অদ্ভুতভাবে হেসে যাচ্ছিল। হাসিমুখ নিয়েই সে পড়তে বসে গেলো। রোয়াইফা গেল আম্মুর কাছে পড়তে, আমি চলে এলাম আমার রুমে।

ঘণ্টাখানেক বাদে রোয়াইফা আমার কাছে এসে মোটামুটি কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করলো। ছোটভাইয়াকে ব্যথা দেয়ার জন্যে আমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হলো। শুধু তাই না, তার কাছেও এক দফা স্যরি বলতে হলো আমাকে।

খাবার টেবিলে বসেছি, রোয়াইফা আফসোস করছে ভাইয়ার ব্যথা পাওয়া নিয়ে। আব্বুর মজলিসে বসেছি, সেখানেও তার মায়া ঝরছে ভাইয়ার পায়ের জন্যে। একটু বিরক্ত লাগছিল আমার। একটা প্রকাণ্ড স্ক্রু ড্রাইভার কতটাই বা ব্যথা দেবে! ব্যথা পেলেও ওটা ঘণ্টা আধেকের বেশি থাকার না। এটা নিয়ে এতক্ষণ বাতচিত চলাটা আমার বেশ অপছন্দই হচ্ছিল। আবার এও ভাবছিলাম, সন্তানের ছোটখাট ব্যথাগুলো মায়ের কাছে যেমন বড় হয়ে ধরা দেয়, ভাইদের অল্প যাতনা বোনেরা অনেক সিরিয়াসলি ফীল করেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে আছাড় খেয়েছি আমি কিন্তু কাঁদছে রুবা - কতবারই তো ঘটেছে এমন। ওসবকিছু মনে পড়ায় রোয়াইফার অনুভূতিটা আমি বুঝতে পারছিলাম এবং তার এই তড়প দেখে সৃষ্ট বিরক্তিটাও গেলো উবে। তার দুশ্চিন্তা আর সহমর্মিতা একপর্যায়ে আমাকে অনুশোচনাতেই ফেলে দিলো।

লক্ষ করলাম, রোয়াইফা যতবার আফসোস করে, নাফিস ততবার হেসে ওঠে। ওর হাসির মধ্যে একটা ‘তৃপ্তিবোধ’ আমার দৃষ্টিতে ধরা দেয়। সেই হাসিটা ফুটে ওঠার সময় ওর চোখের চাহনিতে পরিতোষের প্রবল উপস্থিতি আমি টের পাই। যদি বলেন, হাসি থেকে এতকিছু ক্যামনে বের করে, আমার কোনো উত্তর নেই আসলে।

বিকালে বেরিয়েছিলাম। নাফিস ও রোয়াইফা আগেরদিন দুইটা বই শেষ করে দিয়েছিল, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ট্যাবটা এক ঘণ্টার জন্যে ওদের হাতে দিয়ে দিলাম। ফেরার পর ড্রইং রুমের দরোজা দিয়ে ঢুকবো, এমন সময় দুজনের কথাবার্তা কানে এলো। রোয়াইফা নাশিদ শোনার মধ্যেও নাফিসের কাছে জিজ্ঞাসা করছে ব্যথা কেমন। সে খুব বোল্ডলি উত্তর দিচ্ছে, ‘বড়ভাইয়া ব্যথা দিলে ব্যথা হয় না।’ আমি ওর হাসি থেকে যা অনুমান করেছিলাম, সেটা তাহলে মিথ্যা নয়! আবেগী মানুষ, এই মুহূর্তে দরোজা ঠেলে ঢুকলে আমি হয়তো ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিতে পারি [ইয়ে মানে অশ্রু কিন্তু ঝরবে না]। সব অনুভূতি সবসময় প্রকাশ করতে নেই। বাসায় না ঢুকে চলে গেলাম ছাদে।

সন্ধ্যার পরে নাফিস যথারীতি কফি বানিয়ে দিয়ে গেলো। জিজ্ঞাসা করলাম, পায়ের ব্যথা এখন কেমন? একগাল হেসে বললো, আমি তো ব্যথা পাইনি!

তাকে কিছু বললাম না। ইউজিসি’র একটা প্রোজেক্টে এসাইনড ছিলাম। সেই রাতে আমার অংশটা ফাইন্যাল হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আমার কিছু লিখতে ইচ্ছে করছিল না। চোখে ঘুম আসার আগতক নানারকম দোলাচলে দুলেছি। পৃথিবীতে ভালোবাসা জিনিসটা ওজনহীন হচ্ছে রোজ রোজ, যত দিন যাচ্ছে, মানুষের আবেগানুভূতির সাথে সাথে মায়া-মমতাও কমছে পাল্লা দিয়ে; এমন দুর্দিনে অযাচিতভাবে একটু বেশি ভালোবাসা পাওয়া আমার জন্যে নেহাত সৌভাগ্যের। কিন্তু আপন সহোদরের মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসায় খুশি যতটা হয়েছি, তারচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম এই ভেবে যে, এই প্রত্যাশাতীত নির্ভরতার ভার বহন করার শক্তি আমি রাখি কি-না। স্বস্তি আর শংকা দু পাশ থেকে চেপে ধরলে অস্বস্তিটাই বাকি থাকে। অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে, এত হিসেব-নিকেশ করে আসলে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা-কে সীমার মধ্যে বেহিসেবি রাখাই সুন্দর। সম্ভবত সেই সুন্দরের দেখা পাইয়ে দিয়েছেন আল্লাহ, অতএব, অস্বস্তিতে না ভুগে শোকরগুজার হই।

নাফিসের সেদিনকার আচরণ ও অনুভূতি মনে করিয়ে দিলো, পূর্বতন আলিমদের মধ্যে অনেক আল্লাহপ্রিয় মানুষ এমন ছিলেন, যাঁরা ‘সবরের’ চেয়ে ‘রিদা’কে বেশি প্রেফার করতেন। রিদা বিল কাদা। যুহদ ও রাকাইকের প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে এ সংক্রান্ত অনেক আলোচনা ও নজির বিদ্যমান। সহজ কথায়, কোনো বিপদে আপতিত হলে তাতে ধৈর্যধারণ (ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়) এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে তা থেকে উত্তরণের যথাসাধ্য চেষ্টাকে সমন্বিতভাবে ‘সবর’ বলা হয়। ‘রিদা’ হলো যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সানন্দে বরণ করে নিয়ে সেটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা উপহার হিসেবে গণ্য করা এবং মনের মধ্যে ‘নির্লিপ্ত সন্তুষ্টি’র উপস্থিতি অনুভব করা। আমরা সবর করার জন্যে আদিষ্ট, সবর করা আমাদের জন্যে ওয়াজিব। রিদা আবশ্যকীয় কিছু নয়, আবার কেউ এ ধরনের অনুভূতি অনুভব করলে তা দোষণীয়ও নয়। ভালোবাসার প্রাবল্য এমনতরো অনুভূতির জন্ম দেয়। ‘রিদা’ ধারণকারীরা চিন্তা করেন, যে কষ্টে আপতিত হয়েছি, এ তো আল্লাহরই দেয়া; এই কষ্ট সহসা মুছে না যাক, আল্লাহর দেয়া উপহার হয়ে আমার হৃদয়ে আসন গেড়ে বসুক। এই রিদা বিভিন্ন ক্ষেত্র ও প্রেক্ষিতভেদে নানাভাবে প্রতিফলিত হতো তাঁদের কথায় ও কাজে; যেমন, সালফে সালিহিনদের একজন বলছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে চেয়ে যা পেয়েছি, সেটা আমার চাওয়া। আল্লাহর কাছে চাওয়ার পরে তিনি যদি না দেন, ওই না-দেওয়াটা কিন্তু আল্লাহর চাওয়া। আমার চাওয়াটা জীবনে এলে খুশি হই, আল্লাহর চাওয়াটা আমার কাছে এলে দ্বিগুণ খুশি হই।’

সাবির [যিনি সবর করেন] ও রাদি [যাঁর মনে রিদা আছে] - দিনশেষে দুইজনই কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেন। তবে সূক্ষ্ম পার্থক্যটা হলো: কষ্ট হলেও, কষ্ট পেলেও ধৈর্য ধরাকে বলা হয় সবর; অন্যদিকে রিদা’র অনুভূতি ধারণকারীগণ সেই কষ্টকে কষ্টই মনে করেন না। ফিতার ক্যাসেটের যুগে মেজো মামার চার-ব্যাটারি-প্লেয়ারে শুনেছিলাম: ‘বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও।’ রিদা হয়তো তেমনই কিছু।

আল্লাহর প্রতি আমার ভালোবাসা ওই পর্যায়ের নয়। ‘রিদা’ তো অনেক দূরের জিনিস, ‘সবর’ পর্যন্ত পৌঁছতেই হিমশিম খাই; তাও কিনা আম্মু নেপথ্যে ধাক্কাটাক্কা দিয়ে এই পর্যন্ত ঠেলে দেন। ‘রিদা’র অনুভূতি কেমন, সেটা অনুভব করা আমার সাধ্যের বাইরে।

নিছক বইয়ের পাতায় ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম যে অনুভূতিকে, নাফিসের প্রতিক্রিয়ায় সেই অনুভূতিটাই আমাকে খুব কাছে এসে ছুঁয়ে গেলো। আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম, ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আল্লাহপ্রেমীরা এমন নিঃশর্ত নিখাদ সন্তোষে মাথা ঝোঁকাতেন, ঠিক কোন ধরনের আবেগ থেকে দুঃখ-যাতনাগুলোকে আলিঙ্গন করতেন হাসিমুখে।

ঠিক করে রেখেছি, আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন, এই গল্পটা নাফিসকে মনে করিয়ে দেবো তার ভরা তারুণ্যের দিনে। ভাইয়াকে ভালোবেসে তার দেয়া ব্যথাকে যেমন সহাস্যে বরণ করেছিল, আল্লাহকে ততোধিক ভালোবেসে তাঁর যে কোনো ফায়সালার প্রতি যেন সমর্পিত হয় সন্তুষ্টচিত্তে ও হাসিমুখে। আল্লাহ আমার ভাইটাকে সবুজ রাখুন, তার মনের আকীকে কালজ শ্যাওলা স্পর্শ করলে আসমানি বর্ষণে যেন তা ধুয়ে দেন ভালোবেসে।


~আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব

পঠিত : ১৩১৫ বার

মন্তব্য: ০