Alapon

নাজিুমদ্দিন এরবাকান ও নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রস্তাবক ও মহান মুজাহিদ

বাংলাদেশের জনগন শেরে-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এর একটি বিখ্যাত উক্তি সবসময় স্মরন করে থাকে। শেরে বাংলা বলেছিলো,

যখন দেখবে যে কলকাতার দাদা বাবুরা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ,তখন মনে করবে আমি আমার দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি !

কলকাতার দাদাবাবুরা এদেশের তাদেরকেই প্রশংসায় মুখরিত করে থাকে যারা সর্বদা নিজে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় ।

প্রফেসর ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে গেলে বইপর্যালোচনা আর থাকবে না। একটা বইয়ের অধ্যায় হয়ে যাবে। একটা মন্তব্যই আপনাকে বুঝাতে সাহায্য করবে সে আসলে কেমন!

৭০ দশকের CIA এর একসময়ের মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তুরষ্কের গোয়েন্দা প্রধানকে বলেছিলো, ‘তোমাদের দেশে শুধু মাত্র একজন লোক রয়েছে যার কারনে আমাদের সকল পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে তোমাদের রাজনীতিবীদদেরকে শূণ্যে নাচানো কোন ব্যাপার ছিলো না। সেই ব্যক্তি হচ্ছেন প্রফেসর নাজিমুদ্দিন এরবাকান।’

‘নাজিুমদ্দিন এরবাকান ও নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রস্তাবক ও মহান মুজাহিদ’ বইটিতে খেলাফত পরবর্তী তুরষ্কের একশ বছরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। প্রফেসর এরবাকানের জীবনীর চেয়ে তুরষ্কের মাটিতে ইসলামের পূর্নজাগরন, আদনান মেন্দেরেস কর্তৃক আরবিতে আযান পূনরায় চালু করা, ইসলামপন্থীদের রাজনীতিতে প্রবেশ ও ক্ষমতায় যাওয়া, একদিনের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমেরিকার হুশিয়ারী তোয়াক্কা না করে সাইপ্রাসে বিজয় অর্জন করা, তুরষ্কের ভঙ্কুর অর্থনীতির চাকাকে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া, তুরষ্কে আমেরিকার প্রভাব সহ বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।


৭০ সালের দিকে তুরুষ্কে মিল্লিগরুশ আন্দোলন যখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, তখন বাধ্য হয়ে আমেরিকা গোয়েন্দা সংস্থা CIA তুরষ্কের মাটিতে নিজেদের কর্তৃৃত্ব ধরে রাখার জন্য ক্যু করে কোয়ালিকেশন সরকারকে নামাতে বাধ্য হয় ।

প্রফেসর এরবাকান সেসময় বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ এ মিল্লি গরুশ যেন ক্ষমতায় না আসতে পারে সেজন্য মসজিদে জুমআর খুতবা দিতে সক্ষম এরকম একজনকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাবে। মিল্লি গুরুশ যেন ক্ষমতায় না আসে সেজন্য ইসলাম ঘরনার যে কোন একজনকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে আমেরিকা। প্রফেসর এরবাকানের দূরদৃষ্টি বুঝতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়েনি। মিল্লি গরুশ থেকে বেরিয়ে নুতন দল গঠন করেন তরুন নেতা তরজুত ওজিল। বেরিয়ে গিয়ে আমেরিকা সহায়তায় ৪৫% ভোটে ক্ষমতায় বসেন।

মিল্লিগুরুশকে দমিয়ে রাখতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও ইসরাইলের স্বার্থ সুসংহত হবে। ২৮ জুন ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন নাজিমুদ্দিন এরবাকান। তিনি বলেন, শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অফিসে আসলে তার সাথে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ করতে আসে। সে প্রধানমন্ত্রী এরবাকানকে বলেন, আমরা জানি আপনার দাওয়াহ হলো ইসলাম, আর আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এটা অবশ্যই আমরা পছন্দ করি নি। তিনি (আমেরিকা) নাজিমুদ্দিন এরবাকান এর সাথে কাজ করার জন্য ৬ টি শর্ত জুড়ে দেন।
০১. ইরানের সাথে ৫০ মিলিয়র ডলারের বেশি বানিজ্য করতে পারবে না।
০২. ইরানে যেতে পারবে না।
০৩. মুসলিম দেশ গুলোর সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক বেশি বাড়াতে পারবেননা।
০৪. তুরষ্কে আমেরিকা ও ইসরায়েলের সংগঠন ‍গুলো নিষিদ্ধ করতে পারবেনা
০৫. তুরষ্কে অভ্যন্তরে সামরিক শক্তি সমূহে বহিস্খার করতে পারবেনা।
০৬. ইরাকের পাইপলাইন গুলো উন্মুক্ত করতে পারবেনান।

তুরষ্কের আলী পাশার প্রবাদ আছে। সেটা হলো, ‘আমি যে রাষ্ট্রীয় কাজ করতে যাইনা কেন আগে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাত করি তারপর সে যা বলে আমি তার উল্টোটা করি।’ প্রফেসর নাজিুমদ্দিন এরবাকান এমনটাই করেছিলেন। তিনি আমারিকার সাথে করা সকল চুক্তি স্ট্যান্ডবাই করে রেখেছিলেন। ইসরােইলের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তুরুষ্কে অবস্থিত আমেরিকার সকল ঘাটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যা আমেরিকা ও ইসরাইলের জন্য মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়ায়।

বেশ কয়েকবার মিল্লি গুরুশ নিষিদ্ধ হবার পর তারা নতুন নামে রাজনীতিতে দ্বিগুন শক্তিতে ফিরে আসে। আমেরিকা ভালো করেই জানে মিল্লি গুরুশ নিষিদ্ধ করলে জনপ্রিয়তা বাড়বে, কমবে না। সেজন্য CIA নতুন পলিসি গ্রহন করে। মিল্লি গুরুশকে দমাতে হলে দরকার দলের ভিতর অভ্যন্তরীন ভাঙ্গন। সেই পথে CIA হাটা শুরু করে। সেজন্য দলের তরুন দু’নেতা আব্দুল্লাহ গুল ও এরদোয়ানকে প্রথম পছন্দ আমেরকিার। বেশ কয়েকবার গোপনে এরদোয়ান আমেরিকা সফরও করে।

তৎকালীন তুরষ্কের প্রখ্যাত সাংবাদিক বানু আভার বলেন, ‘রেফাহ পার্টি যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন রেফাহ পার্টির প্রথম সাড়ির কোন নেতাকে বিবিসি আমন্ত্রন না জানিয়ে সর্বদা এরদোয়ান ও গুলকে আমন্ত্রন জানাতো যে কোন বিষয়ে টকশোর জন্য। অথচ এদের কেউ পরিচিতি মুখ ছিলেন না। বিবিসির কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করা হলে কর্তৃপক্ষ বলেছিলো এনাদের দুজনকে উপরের মহলের পছন্দ।

পরবর্তীতে ২০০৩ সালে আমেরিকার পছন্দ মোতাবেক এরদোয়ান ক্ষমতায় আসে। ২০০৩ সালে এরদোয়নাকে ক্ষমতা বসানোর অন্যতম শর্তছিলো ‘ওয়ার অন টেরর’ নামে তথাকথিত যুদ্ধে আমেরিকাকে সহযোগিতা করা। ২০০৩ এর পূর্বে ক্ষমতায় ছিলো CHP নেতা বুলেন্ত এজেবিদ। প্রফেসর এরবাকানের প্রভাবেই বুলেন্ত এজেবিদ আমেরিকার এ প্রস্তাবে রাজী হয়নি। আমেরিকা সেনাবাহিনী ইরাকের উপর আক্রমন চালানোর জন্য তুরুষ্কের ভূমি ব্যবহার করার প্রস্তাব সংসদে গড়ালে নাজিমুদ্দিন এরবাকান Ak পার্টির সকল সংসদ সদস্যকে এক ঐতিহাসি উপদেশ প্রদান করেন। তিনি বলেন,

আপনারা যেভাবেই হোক ক্ষমতায় পৌছেছেন। কীভাবে পৌছেছেন সেটা বলতে চাচ্ছিনা। শুধুমাত্র এ কথা মনে রাখবেন, আগামিকাল সংসদে যে প্রস্তাবনা দেয়া হয়ে অর্থাৎ আমেরিকাকে যদি সংসদের পক্ষ থেকে ইরাক হামলার অনুমতি প্রদান করা হয় এবং আপনারা যদি পক্ষে ভোট প্রদান করেন তবে জেনে রাখুন এ পর্যন্ত যত ভালো কাজ করেছেন কিয়াতের দিন যদি তা এক পাল্লায় রাখা হয় এবং আপনাদের হ্যা ভোটের কারনে ইরাকে হামলার অনুমিতর ফলে হামলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন শিশুর দেহের একফোটা রক্ত যদি অপর পাল্লায় রাখা হয় , আল্লাহ সাক্ষী এক ফোটা রক্ত হাজার গুন ভারী হবে।

অধিক সংসদ সদস্য কনভিন্স হয়ে ‘না’ ভোট প্রদান করার ফলে ‘না’ ভোট জয়যুক্ত হয়। এটা এরদোয়ান নিজের ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় সংসদের কথা তোয়াক্কা না করে আমেরিকাকে হামলার অনুমতি প্রদান করেন। আমেরিকার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী Pol Wolfowits তুরষ্ক সফরে বলেন, আমরা ইরাকের অপারেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছিলাম, কিন্তু এরদোয়ান আমাদের অপারেশন করার সাহস জুগিয়েছে।

বসনিয়া গনহত্যার সময় নাজিমুদ্দিন এরবাকান বিরোদী দলে থাকা সত্ত্বেও বসনিয়াতে অস্র তৈরী করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার প্রেরন করেন। বসনিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি যিনি সরাসরি রনাঙ্গনের যোদ্ধা ছিলেন তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
বসনিয়াতে যখন একটি পাখিও প্রবেশ করতে পারতো না ঠিক সে সময় প্রফেমর এরবাকান আমাদের জন্র অস্র পাঠিয়েছেন এবং অস্রের ফ্যাক্টরী নির্মান করে দিয়েছেন।

নাজিমুদ্দিন এরবাকান একটি নাম নয়, এই নামই যেন মুসলিম উম্মাহর সেই সোনালী ইতিহাস ফিরে পাবার এক প্রেরনার বাতিঘর। মুসলিম দেশ গুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক ভাবে D8 গঠন করেন। তিনিই প্রথম কমন মুদ্রা ইসলামিক দিনার এর প্রস্তবনা করেন। কথিত আছে তার কমন মুদ্রার প্রস্তবানার ধারনা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর কমন মুদ্রার প্রচলন করেন।

তার সমন্ধে সুদানের ইসলামী আন্দোলনের নেতা হাসান তেরাবী বলেছিলেন, প্রফেসর ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান এবং তার প্রতিষ্ঠত আন্দোলন মিল্লি গরুশ পাশ্চাত্য দর্শন ও সভ্যতার সবচেয়ে বড় হুমকি। আমি নি:সন্দেহে বলতে পারি, এই বই আপনার চিন্তাকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর ব্যর্থতার ভিরে পূনরায় জাগরনের নতুন করে আশার আলো দেখাবে বলেও বিশ্বাস করি।

বই নিয়ে নিজের কিছু কথা:
০১. প্রফেসর নাজিমুদ্দিন এরবাকান কে নিয়ে একটা মাস্টার পিস বই। এত সুন্দর বইটি পেপারব্যাক তুলনায় হার্ডকভার হলে বইকে আরোও পূর্নতা দিবে বলে মনে করি।রপ্রকাশনীর কাছে আশা করবো পরবর্তী সংস্করনে হার্ডকভার যেন সংযোজন করে।
০২. তুরষ্ককে স্বনির্ভরতায় আনতে প্রফেসর নাজিমুদ্দিন এরবাকান যে সব প্রকল্প বা তার অর্থনীতি মডেল কি ছিলো/ কিভাবে কোন সেক্টরে বাস্তবায়ন করেছে সেটা বিস্তারিত উল্লেখ করলে বইয়ের নাম এর সাথে বই যথার্থ রুপ নিত বলে মনে করছি। এখানে লেখক ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগের কথা বলেছে (আদিম/আদেল- কি যেন এক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিলো মনে নেই) কিন্তু আমাদের মতন যারা পাঠক আছে, যারা ইসলামী অর্থনীতি সমন্ধে শুধু একাডেমিক পড়ার ভিতর সীমাবদ্ধ ছিলো বাস্তবে সত্যি সম্ভব কিভাবে, বিষয়টা ক্লিয়ার হতো যদি নাজিমুদ্দিন এরবাকানের মডেল টা বিস্তারিত উত্থাপন করা হতো। লেখকের নিকট আশা থাকবে নাজিমুদ্দিন এরবাকানের অর্থনীতি মডেল বিস্তারিত আমাদের সামনে নিয়ে আসবে।

সবশেষে ধন্যবাদ জানাই লেখক আবিদ ভাইকে ও মক্তব প্রকাশনীকে। মক্তব প্রকাশনীর প্রত্যেকটা বই চিন্তার খোড়াক যোগায়। এরকম প্রকাশনা অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ তায়ালা লেখক এবং প্রকাশনীর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে উত্তম প্রতিদান দান করুক। (আমিন)

পঠিত : ১০৫২ বার

মন্তব্য: ০