Alapon

আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন



আজকাল তো সবাই নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করেন। বাস্তবতা হলো বেশিরভাগ বাঙালি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে সবাই ভোল পাল্টে পাকিস্তান বিরোধী হয়ে পড়লেন। অনেকে মনে করেন অন্তত সকল আওয়ামী নেতা মুক্তিযুদ্ধ সাপোর্ট করেছেন। বিষয়টা আদতে সঠিক নয়। শুনতে ভিন্নরকম শোনালেও বেশিরভাগ আওয়ামী নেতা মুক্তিযুদ্ধ সাপোর্ট করেননি। এটাই বাস্তবতা।


১৯৭১ সালের এপ্রিল ও মে মাসে সেনাবাহিনী দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে পুরো দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপরই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে পূর্ব পাকিস্তান পরিচালনার ভার হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।


প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে গভর্নরের অফিসে রিপোর্ট করতে বলা হয়। পাকিস্তান জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন ১৬০ জন। এর মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন ৮২ জন যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিলেন। উপস্থিত হন নাই ৭৮ জন যারা হয় মুক্তিযুদ্ধ করছেন বা ভারতে পালিয়ে গেছেন।


পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সংসদে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছে ২৮৮ আসনে। এর মধ্যে ১৮৩ জন প্রাদেশিক মেম্বার দেশে থেকে পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। অনুপস্থিত ছিলেন ১০৫ জন যারা ভারতে পালিয়ে গেছেন বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান করেছেন।


গভর্নর টিক্কা খান ৭৮ জন জাতীয় পরিষদের মেম্বার ও ১০৫ জন প্রাদেশিক পরিষদের মেম্বারকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে হাজির না হওয়ায় তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব ছিল না।

এমতাবস্থায় টিক্কা খান দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করেন। সবার ঐক্যমতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতা ডা. আব্দুল মোতালিব মালেককে গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত করা হয়।


ডা. মালেক গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ৩১ আগস্ট। শপথ গ্রহণ করেন ৩ সেপ্টেম্বর। এরপর তিনি সব দলের অংশগ্রহনে ১৩ সদস্যের মন্ত্রীসভা গঠন করেন। এদিকে নির্বাচন কমিশন ৭৮ টি জাতীয় আসন ও ১০৫ টি প্রাদেশিক আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ১৯ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনের সম্ভাব্য ডেট ঘোষণা হয়। উপনির্বাচন কমপ্লিট হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে মালেক মন্ত্রীসভা। ততদিন পর্যন্ত তারাই পূর্ব পাকিস্তান পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে।


মে মাসের পরে দেশ থেকে কার্যত বিদ্রোহীরা হারিয়ে যায়। অনেকেই মারা পড়েছে, কিছু ভারতে পালিয়েছে আর কিছু আত্মগোপনে ছিল। দেশ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাঙালিরা আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। এতে ক্ষোভ বাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের। তাছাড়া ইতোমধ্যে কয়েক দল বিদ্রোহী মুশরিকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সাহায্য নিয়ে এসেছে।


মুক্তিবাহিনীর এখন মূল কাজ হিসেবে নিয়েছে নির্বাচন বানচাল করা। তারা ভোট কেন্দ্রগুলোতে অর্থাৎ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতর্কিত বোমা হামলা করছিলো। এতে বহু সাধারণ মানুষ হতাহত হচ্ছিল। মালেক সরকার ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তায় স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এদিকে দেশের অবস্থা পুরোপুরি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন বন্ধ রাখতে দাবি জানায় আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকী দলগুলো। অবশেষে নির্বাচন পিছিয়ে ১২ ডিসেম্বর নিয়ে যাওয়া হয়।


অনেকে মনে করেন বিশেষত বিএনপিপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করেন তারা সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করে ফেলেছিল। পরে ভারতীয় বাহিনী ৩ ডিসেম্বর আক্রমণ করে যুদ্ধের ক্রেডিট নিয়ে নেয়। এটাও সত্য দাবি নয়। বস্তুত বাঙালি বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ন্যুনতম প্রতিরোধই করতে সক্ষম হয়নি। তারা তাণ্ডব ও গণহত্যা যা করেছে তা মার্চ ও এপ্রিল মাসে।


মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট করা। তারা সুযোগ পেলেই রাস্তা কেটে ফেলতো, পুল/কালভার্ট ভেঙে ফেলতো, স্কুল কলেজে হামলা চালাতো, রেল স্টেশন, সেনা চৌকি ও বাজারে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতো। এসব টুকটাক গেরিলা হামলা ছাড়া তারা কোনো মুক্তাঞ্চল তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।


এদিকে যে গ্রামে বা গঞ্জে সেনা চৌকিতে হামলা হতো সে গ্রামে তার পরদিন হামলে পড়তো সেনাবাহিনী। বিদ্রোহী সন্দেহ হলেই অবলীলায় খুন করতো যুবকদের। এভাবে মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনী উভয়ের আক্রমণের শিকার হতো এদেশের সাধারণ মানুষ।


এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলো টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী। তিনি সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সাথে কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধ হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলে তখনই মুক্তিবাহিনী অর্থাৎ এদেশের বিদ্রোহী পাকিস্তান সেনারা ভালোভাবে একটিভ হয় এবং সম্মিলিত আক্রমণ করে।

পঠিত : ৪১৩ বার

মন্তব্য: ০